ভ্যাক্সিন বা টিকা কি?
মানবদেহে কোন জীবাণু প্রবেশ করলে এর বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি(নিরাপত্তা) সৃষ্টি করার জন্য কৃত্রিমভাবে যা প্রদান করা হয় তাই ভ্যাক্সিন (Vaccine)। পৃথিবীজুড়ে স্মলপক্স (Smallpox) রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল এবং পোলিও (Poleomyelitis), হাম (Measles) বা ধনুষ্টংকার (Tetanus)-এর মত রোগের প্রায় নির্মূলকরণ সম্ভব হয়েছে ভ্যাক্সিনেশন (Vaccination) বা টিকাপ্রদানের মাধ্যমে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্যমতে ২৫ টি রোগ আছে যাদেরকে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ভ্যাক্সিনের ইতিহাস
৪২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডিডেস (Thucydides) লক্ষ্য করেন যে এথেন্স শহরে যেসব রোগী স্মলপক্স আক্রান্ত হবার পর বেঁচে যাচ্ছে তাদের পুনরায় আর এই রোগটি হচ্ছে না। পরবর্তীতে চীনারা সর্বপ্রথম ১০ম শতাব্দীর শুরুতে ভ্যাক্সিনেশন এর আদিরূপ ভ্যারিওলেশন (Variolation) আবিষ্কার করে। এই প্রক্রিয়ায় স্মলপক্স রোগে আক্রান্তদের দেহের পাঁচড়া (Scrab) হতে টিস্যু নিয়ে সুস্থ মানুষদেরকে এর সংস্পর্শে আনা হত। ধীরে ধীরে তুরস্ক এবং ইংল্যান্ডেও ভ্যারিওলেশন বিস্তার লাভ করে। ১৭৯৬ সালে বৃটিশ চিকিৎসক ডাঃ এডওয়ার্ড জেনার আধুনিক ভ্যাক্সিনেশন আবিষ্কার করেন, এজন্যে তাঁকে “ফাদার অব ইম্যুনিলোজি” বলা হয়। শিক্ষানবীশকালে জেনার লক্ষ্য করেন যে গ্রাম্য এলাকায় গোয়ালাদের স্মলপক্স হয় না কারণ ইতোমধ্যেই তারা কাউপক্স আক্রান্ত হয়ে আছে। ১৭৯৬ সালে তিনি এক গোয়ালিনীর হাত হতে পুঁজ নিয়ে ৮ বছর বয়সী এক ছেলের বাহুতে আঁচড়ে দেন এবং ৬ সপ্তাহ পর তার শরীরে স্মলপক্স জীবাণু প্রবেশ করান। সৌভাগ্যবশত বাচ্চাটির স্মলপক্স হলনা। জেনার আরো গবেষণা করতে থাকেন এবং ১৭৯৮ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে স্মলপক্স ভ্যাক্সিন বাচ্চা-ছেলে-বুড়ো সবার জন্য নিরাপদ। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালে লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের(Rabies) ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেন এবং ভ্যাক্সিন জগতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা যখন বিভিন্ন রোগের কার্যকারণ আবিষ্কার করতে থাকেন তখন ভ্যাক্সিন তৈরীর পথও সুগম হয়ে যায়। জার্মান বিজ্ঞানী এমিল ভন বেহরিং ডিপথেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত সিরাম থেরাপি (Serum therapy) আবিষ্কারের জন্য ১৯০১ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান। জাপানী চিকিৎসক শিবাসাবুরো কিতাসাতো ডিপথেরিয়া এবং ধনুষ্টংকারের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেন।
এডওয়ার্ড জেনার
১৯২০ সালের শেষদিকে ডিপথেরিয়া, ধনুষ্টংকার এবং যক্ষার ভ্যাক্সিন সহজলভ্য হয়ে যায়। পুরো পৃথিবীজুড়ে ভ্যাক্সিনেশন বা টিকাদান কর্মসূচী ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম পোলিও ভ্যক্সিনেশন কর্মসূচী জাদুকরী ফল দেয়। ১৯৫৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা স্মলপক্স নির্মূলের জন্য বিশ্বব্যপী ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচীর উদ্যোগ নেয়। অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ফেনার এই প্রকল্পের প্রধান ছিলেন। ১৯৮০ সালে সমগ্র পৃথিবীকে স্মলপক্স মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যেটা চিকিৎসাবিজ্ঞানে এযাবতকালের সেরা অর্জন বলে বিবেচিত। প্রফেসর হ্যারল্ড জার হাউজেন আবিষ্কার করেন যে একটিমাত্র ভাইরাস জরায়ুর ক্যান্সারের জন্য দায়ী এবং এর বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন প্রস্তুত করা সম্ভব। পরবর্তীতে এই ভ্যাক্সিন তৈরী করা হয়(HPV Vaccine) যা এখনো পর্যন্ত লাখ লাখ নারীর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করছে।
ভ্যাক্সিন কিভাবে কাজ করে?
জীবাণু থেকেই তার দ্বারা সৃষ্ট রোগের ভ্যাক্সিন প্রস্তুত করা হয়। যেকোন জীবাণুর আছে দুইটি বৈশিষ্ট্য- একটি হল রোগ সৃষ্টি করা (Pathogenecity)। অন্যটি দেহের অভ্যন্তরে ঐ একই রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কিছু পদার্থ (Antibody) তৈরী করা। ভ্যাক্সিন তৈরীর সময় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু অন্য বৈশিষ্ট্যটি ঠিক রাখা হয়। সোজা বাংলায় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাহীন জীবাণুকেই ভ্যাক্সিন হিসেবে দেহে প্রবেশ করানো হয়। ফলশ্রুতিতে এই জীবাণু দেহে রোগের কারণ হয় না, উল্টো রোগটি যেন না হয় তার জন্য বিশেষ পদার্থ(Antibody) তৈরী করতে থাকে। আরেকটি সুবিধা হল এই জীবাণুগুলো মেমরি সেল গঠন করে ফলে পরবর্তীতে একই জীবাণু পুনরায় প্রবেশ করলে সহজে সনাক্ত করতে পারে। এভাবে ভ্যাক্সিন শরীরের ইম্যুনিটি-কে বাড়িয়ে দেয়। ইঞ্জেকশন বা মুখে খাওয়ার মাধ্যমে ভ্যাক্সিন দেয়া যায়। ভ্যাক্সিনেশন দুই প্রকার- রোগ হবার আগেই ভ্যাক্সিন দেয়া (Active) আর রোগ হবার পরে দেয়া(Passive)।
অনেক সময় একটি ভ্যাক্সিনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এর সাথে আরেকটি ভ্যাক্সিন যোগ করা হয়। একে এডজুভেন্ট (Adjuvant) বলে। যেমন অ্যানথ্রাক্স ভ্যাক্সিনের সাথে পারটুসিস ভ্যাক্সিন যোগ করলে অ্যানথ্রাক্সের কাজ করার গতি বৃদ্ধি পায়। আবার ভ্যাক্সিন যাতে দূষিত না হয় এজন্য অনেক সময় এর সাথে প্রিজারভেটিভ (Preservative) মেশানো হয়।
ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে কি কি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব?
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ২৫ টি রোগের তালিকা করেছে যেগুলোকে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভবঃ
১ অ্যানথ্রাক্স (Anthrax)
২ হাম (Measles)
৩ রুবেলা (Rubella)
৪ কলেরা (Cholera)
৫ মেনিংগোকক্কাল ডিজিজ (Meningococcal disease)
৬ ইনফ্লুয়েঞ্জা (Influenza)
৭ ডিপথেরিয়া (Diptheria)
৮ মাম্পস (Mumps)
৯ ধনুষ্টংকার (Tetanus)
১০ হেপাটাইটিস এ (Hepatitis A)
১১ পারটুসিস (Pertussis)
১২ যক্ষা (Tuberculosis)
১৩ হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B)
১৪ নিউমোকক্কাল ডিজিজ (Pneumococcal disease)
১৫ টাইফয়েড (Typhoid fever)
১৬ হেপাটাইটিস ই (Hepatitis E)
১৭ পোলিও (Poleomyelitis)
১৮ টিক-বর্ণ এনকেফালাইটিস (Tick-born encephalitis)
১৯ হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (Haemophilus encephalitis type-B)
২০ জলাতংক (Rabies)
২১ ভেরিসেলা এবং হার্পিস (Varicella & herpes zoster)
২২ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (Human papilloma virus)
২৩ রোটাভাইরাস (Rotavirus gastroenteritis)
২৪ ইয়েলো ফিভার (Yellow fever)
২৫ জাপানীজ এনকেফালাইটিস (Japanese encephalitis)
ভ্যাক্সিনের প্রভাবঃ
২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্যমতে প্রতিবছর ভ্যাক্সিনেশনের ফলে আড়াই মিলিয়ন মৃত্যু প্রতিরোধ হয়। ভ্যাক্সিনেশনের পরিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি সাতটির মধ্যে একটি শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। এটা বলা যায় যে শিশুকালে যেসব রোগের ভ্যাক্সিন দেয়া হয় তা মোটামুটি ৯০-১০০% ইম্যুনিটি তৈরী করতে পারে। আরেকটি মজার ব্যপার হল একটি কম্যুনিটির বেশীরভাগ (মোটামুটি ৮০-৮৫%) মানুষকে ভ্যাক্সিনেশন করা গেলে ঐ কম্যুনিটির প্রায় সব সদস্য একই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভ করে (Herd immunity/Community immunity)। এই প্রক্রিয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম ইত্যাদি রোগের প্রতিরোধ করা যায়।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী (EPI – Expanded Program on Immunization):
৭ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ইপিআই প্রকল্পের শুরু। ড: এ, কে, এম লুতফর রহমান তালুকদার “আপনার শিশুকে টিকা দিন” যুগান্তকারী প্রকল্পটি শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে ৮০.২ ভাগ শিশুকে ভ্যাক্সিন দেয়া সম্ভবপর হয়েছে। ১৯৯০ সালে এই প্রকল্পে ভিটামিন এ সংযুক্ত করা হয়। ১৯৯৩ সাল হতে নারীদের পাঁচ ডোজের ধনুষ্টংকার ভ্যাক্সিন এবং ২০০৩ সালে হেপাটাইটিস এ দেয়া শুরু হয়। ২০০৯ সালে আগের ট্রাইভ্যালেন্ট-এর স্থলে পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাক্সিন এবং ২০১২ সালে হাম, মাম্পস ও রুবেলা-র ২য় ডোজের আরম্ভ হয়।
ড: এ, কে, এম লুতফর রহমান তালুকদার
ইপিআই সাফল্য দক্ষিণ এশিয়াতে অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। ১৯৮৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ইপিআই কর্মসূচী প্রায় ১.২ মিলিয়ন মৃত্যু প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে ইপিআই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য রোগ হচ্ছেঃ
১ শিশুদের যক্ষা
২ পোলিও
৩ ডিপথেরিয়া
৪ হুপিং কাশি
৫ মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার
৬ হেপাটাইটিস বি
৭ হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা জনিত রোগসমূহ
৮ হাম
৯ রুবেলা
১০ নিউমোকক্কাল ডিজিজ
ইপিআই ডোজ শিডিউলঃ
জন্মের পরপরইঃ বিসিজি
৬ সপ্তাহঃ পেন্টাভ্যালেন্ট-১, ওপিভি-১, পিসিভি-১
১০ সপ্তাহঃ পেন্টাভ্যালেন্ট-২, ওপিভি-২, পিসিভি-২
১৪ সপ্তাহঃ পেন্টাভ্যালেন্ট-৩, ওপিভি-৩, আইপিভি
১৮ সপ্তাহঃ পিসিভি-৩
৯ মাসঃ এম,আর, পোলিও-৪
১৫ মাসঃ হাম
( এছাড়াও জন্মের ১৪ দিনের মধ্যে পোলিও-র অতিরিক্ত একটি ডোজ দেয়া যায় )
দ্রষ্টব্যঃ এখানে কোনটি কোন রোগের টীকাঃ বিসিজি-যক্ষ্মা;
পেন্টাভ্যালেন্ট- পাঁচটি রোগের জন্য - ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, টিটেনাস, হেপাটাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা;
ওপিভি- পোলিও, মুখে খাবার জন্য;
আইপিভি- পোলিও, ইঞ্জেকশন;
পিসিভি- নিউমোনিয়া;
এম আর- হাম ও রুবেলা।
সরকারীভাবে ইপিয়আই ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে আরো নানা ধরণের ভ্যাক্সিন দেয়া যায়। দেড় মাস বয়সে কলেরা ভ্যাক্সিন, ১২ মাস বয়সে চিকেন পক্স (জলবসন্ত), ১৮ মাস বয়সে হেপাটাইটিস এ, দুই বছর বয়সে টাইফয়েড দেয়া যায়। এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা, মেনিনজাইটিস এবং জলাতঙ্ক (র্যাবিস) ভ্যাক্সিন দেয়া যাবে।
ধনুষ্টংকার (Tetanus) ডোজঃ ১৫-৪৯ বছর বয়সের নারীদের দিতে হয়-
৫ টি ডোজঃ টিটি-১: ১৫ বছর
টিটি-২: টিটি-১ এর কমপক্ষে ২৮ দিন পর
টিটি-৩: টিটি-২ এর কমপক্ষে ৬ মাস পর
টিটি-৪: টিটি-৩ এর কমপক্ষে ১ বছর পর
টিটি-৫: টিটি-৪ এর কমপক্ষে ১ বছর পর
ইপিআই প্রকল্পের সাফল্য বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক অর্জন। এর ফলে ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচির দ্রুত সাফল্য পৃথিবীব্যপী মরণঘাতী ও ভয়ংকর অনেক রোগ নির্মূল অথবা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
১ http://www.who.int/en/
২ http://www.vaccines.gov/
৩ http://en.wikipedia.org/wiki/Vaccine
৪ http://www.dghs.gov.bd
৫ ইপিআই সহায়িকা
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:৫৬