somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

একজন রোদঁশী
যা ভালো লাগে লিখি।কারো জন্য লিখি না, কাউকে হেয় করেও লিখি না। একসময় কবিতা লিখতে ভালো লাগতো, এখন থ্রিলার হরর এর উপরে লিখতে ভালো লাগে। আমার পুরাতন ব্লগ: www.somewhereinblog.net/blog/Rodoshee007/ যেখানে আমার লেখা কিছু গল্প আছে। খুব ভালোবাসি ঘুরে বেড়াতে।

বর্ষায় আমিয়াখুম

১২ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্ষায় বান্দরবান নামক সুন্দরী রমণী কি রুপ এবং সাজে সজ্জিত হয় তা অবলোকন করতেই ২৯ই জুন রাতে ঢাকা ছাড়ি আমরা ৬জন বন্ধু- বান্ধবী। তখনো জানি না যে পথে চলেছি তা কতটা কষ্টের এবং সেইসাথে যে রুপ দর্শন আমাদের হবে তা সারাজীবনে বোধ হয় আর ভুলতে পারবো না। হ্যাঁ , যারা এই বর্ষায় বান্দরবান ভ্রমণের কথা চিন্তা করছেন তারা আগে থেকেই জেনে নিন, সীমাহীন কষ্ট করতে হবে আমিয়াখুম দেখতে হলে, কিন্তু সেইসাথে এটাও বলে দেই নিরাশ হবেন না কোন দিক দিয়েই কারণ কথায় আছে, সবুরে মেওয়া ফলে, তাই ভয়ে গুটিয়ে না থেকে চলে যান মেওয়া খুঁজতে আমাদের মতই।
হানিফ বাসে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে ভোর সাড়ে ৩টায় পৌছে যাই বান্দরবান। যেহেতু বেশ আগে পৌছে গেছি অগত্যা বসে সময় কাটানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ভোর ৫টা নাগাদ এদিক ওদিক পায়চারী করে ৬টায় চান্দের গাড়ি ঠিক করে রওনা হই থানচির উদ্দেশ্যে। যেহেতু আমরা পদ্মঝিরি হয়ে থুইসাপাড়া যাবো তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় থানচি পৌছানো দরকার ছিলো বিধায় চান্দের গাড়িতে যাওয়া, খরচ কমাতে আপনারা লোকাল বাসে যেতে পারেন, তাতে সময় বেশি লাগবে। তবে বান্দরবান থেকে থানচির রাস্তাটা যে বর্ষায় এত সুন্দর রকমের সবুজ আর মেঘে ঢাকা থাকে তা আমাদের জানা ছিলো না এবং এই রুপ দেখতে হলে চান্দের গাড়ি খ্যাত জিপ ই বেস্ট। মাঝে মাঝে এই রাস্তাকে দারজিলিং এর কোন হাইওয়ে ভেবে বিভ্রান্তি যে হয়নি তা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কখনো মেঘ ধরে, কখনো মেঘের মধ্যে হারিয়ে বা কখনো আশেপাশের উচু নিচু পাহাড়ের গা ঘেষে সাদা কালো আর নীল মেঘের মিলন দেখতে দেখতে কখন যে থানচি পৌছে গেছি নিজেরাও বুঝিনি। ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা তখন।
থানচি তে গাইড খুঁজে, সকালের নাস্তা সেরে, থানা পুলিশের কাজ শেষ করে, নৌকা ঠিক করতে করতে বেজে যায় ১২টা। যেহেতু সামনে ৬-৮ ঘণ্টার একটা বড় হেটে যাওয়ার রাস্তা আছে তাই চেষ্টা করবেন যাতে আরো তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া যায়। ১২টায় নৌকায় করে রওনা হই আমরা পদ্মঝিরির উদ্দ্যেশে। ততক্ষ্ণে আকাশে কালো মেঘ এবং বৃষ্টি শুরু। যেহেতু বর্ষাকাল তাই আমাদের সকল ধরনের ওয়েদার এ্যাপ কে কাঁচকলা দেখিয়ে এই বৃষ্টির শুরু হওয়া প্রথমে একটু ভয়ই পাইয়ে দেয় আমাদের কারণ বাংলাদেশের খরস্রোতা নদী একটাই এবং তা হল এই সাঙ্গু নদী। আমাদের প্রথম বান্দরবান ভ্রমণ ছিলো ২০১৪ সালের নভেম্বারে, তখনি যে রুপ দেখেছি এই নদীর আর এখন তো ঘন বর্ষা আর সাথে বৃষ্টি। যাই হোক, মনে ভয় নিয়েই যাত্রা শুরু করে দেই।
আল্লাহর রহমতে উত্তাল ঢেউ পার করেই বেশ ভালোভাবে পদ্মঝিরি পৌছে যাই আমরা। এবার ব্যাগ কাঁধে চলা শুরু, গন্তব্য থুইসাপাড়া। আমাদের গ্রুপে আমরা ২জন মেয়ে আর বাকি ৪জন ছেলে আর আমাদের পথ প্রদর্শক গাইড অং। ট্রেকিং এর সব ধরনের প্রস্তুতি শেষে শুরু হয় আমাদের হন্ঠন যাত্রা। গুরি গুরি বৃষ্টিতে কখনো ঝিরি পথ, কখনো লাল এঁটেল মাটির আঠালো কাদা, জোকের অবাধ বিচরণ স্থল,ছোট বড়, উচু নিচু আর খাড়া পাহাড় পার করে হরিচন্দ্রপাড়ায় যখন পৌছাই তখন শরীরে আর এক ফোটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। এর মাঝে যে কতবার পিছলে পড়েছি, কতবার পাহাড়ের উপরে উঠতে আর নিচে নামতে ঘন নিঃশ্বাস ফেলেছি আর আল্লাহর নাম নিয়েছি তার ইয়াত্তা নেই। তবে কত নাম না জানা ঝর্ণা, ছোট মাঝারি জলপ্রপাত আর আশে পাশের নিদারুণ পাহাড়ি সৌন্দর্য্য আরো একটু বেশি সময় নিয়ে দেখার মত সময় আমাদের হাতে ছিলো না বিধায় যে দুঃখ ছিলো না আমাদের কারো মনে তা বলা যাবে না। পাহাড়ি সরুপথে ঝিঝির ডাক, হঠাৎ সুনসান নীরবতার মাঝে কোন প্রপাত বা ঝর্ণার গর্জন শোনার অনূভুতি আমি লিখে আপনাদের মাঝে পৌছে দিতে পারবো না বললেই চলে, এই বিশেষ মুহূর্ত আপনাকে নিজে ঔ পরিবেশে গিয়েই অবলোকন করতে হবে। তখন দুপুর ৩টা বাজে হয়ত। হরিচন্দ্রপাড়ায় বিশ্রামের ফাঁকে গাইড অং কে জিগেস করলাম আর কতদূর। অং এর সোজা সাপ্টা উত্তর, আমার পিলে চমকে দিলো! আমরা মাত্র অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছি, সামনে আছে আরো অর্ধেক পথ, ২টি খাড়া পাহাড় এবং যদি আমরা দ্রুত না হাটি তাহলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। যে পথ দিনে দুপুরে পাড়ি দিতে আমাদের এই অবস্থা তা রাতের আঁধারে কিভাবে পার করবো তার চিন্তা না করাই শ্রেয় ভেবে সবাই স্যালাইন আর কলা বিস্কুট দিয়ে হাল্কা নাস্তা সেরে উঠে পরি তাড়াতাড়ি। যারা এমন পাহাড় ট্রেকিং এ আসবেন তারা অবশ্যই সাথে বেশি পরিমাণ খাবার স্যালাইন নিয়ে আসবেন এবং পানির বোতল অবশ্যই সাথে রাখবেন কারণ রাস্তায় অনেক জলপ্রপাত বা ঝর্ণা পাবেন যার পানি খাওয়ার উপযোগী তাই বোতলে পানি না নিলেও বোতল রাখা অতি জরুরী। আবারো সেই পাহাড়ে বেয়ে উঠা বা খাড়াভাবে নামার মাঝেই রাস্তা চলে যাচ্ছে। আমাদের সাথে আরো একটি গ্রুপ যাচ্ছে যারা আমাদের গ্রুপের ২ জন মেয়ে কে দেখে রীতিমত অবাক এবং সেইসাথে সময় বিশেষে অনেক বাহবা দিয়েছে কারণ ছেলে হয়ে তারা যে কষ্ট আর শক্তি নিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছে আমরাও তার চেয়ে কম যাই না ! যা হোক নিদারুণ কষ্টের অবসান ঘটিয়ে যখন থুইসাপাড়ার একটা টিনের চাল চোখে পড়লো তখন সূর্য তার শেষ আলো টুকু বিলিয়ে লম্বা সময় বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত। তারমানে আমরা ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে গন্তব্যে সহি সালামতে আসতে পেরেছি। সময় তখন ৬:৪৫ মিনিট। আমাদের লেগেছে প্রায় ৭ ঘণ্টা। হাত, পা, সারা শরীর পরিশ্রমে ভরপুর, বৃষ্টি-ঘাম মিলে ভিজে চুপচুপ এবং কাদায় মাখামাখি, তারমধ্যে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলাম এক পাহাড়ের উপর গোটা দশেক বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠা সিমসাম গ্রাম থুইসাপাড়ার দিকে। কত শান্তি আর অপাড় সৌন্দর্য্য বেয়ে পড়ছে গ্রামের আশের পাশের পাহাড়ে তা দেখে চোখ জুরাচ্ছে না আমাদের কারোরই। মেঘ যেন সূর্যের মত সকাল সন্ধ্যা দেখা দেয় গ্রামের পাশে, মাথার ঠিক উপরেই বা হাতের নাগালে। যা হোক দ্রুত রাত্রি যাপনের ঠিকানা খুঁজে সেদিনের মত শরীর কে বিশ্রামে ডুবিয়ে দিলাম। থুইসাপাড়ার কোন বাড়ীতে জায়গা না থাকায়, একজন পাহাড়ি তার নিজের বাড়িতে আমাদের থাকার জায়গা দেন, যার জন্য আমরা বিশেষ কৃতজ্ঞ তার কাছে। যেহেতু ঈদের ছুটিতে গিয়েছি আমরা তাই মোটামুটি অনেকগুলি গ্রুপ এসেছে আমাদের মত কিন্তু কোন গ্রুপেই মেয়ে ছিলো না আমাদের গ্রুপ ছাড়া এবং সবাই আমাদের দেখে সপ্তম আশ্চার্য দেখার মতই অবাক। যেখানে ছেলেরা ঔ পথ পাড়ি দিতে রীতিমত হিমশিম খেয়েছে এবং কোন কোন দল ১২-১৩ ঘণ্টা লাগিয়ে বা কেউ কেউ হরিচন্দ্রপাড়ায় একরাতের বিরতি দিয়ে তারপর এখানে এসেছে সেখানে আমরা মেয়ে হয়ে কিভাবে এত তাড়াতাড়ি আসলাম। এর পিছনে আমি বলবো আমাদের দুজনের অপরিসীম ইচ্ছা শক্তি, কঠোর মনোবল পারতেই হবে, আমাদের দলের বাকি বন্ধুদের আমাদের প্রতি শেষ না হওয়া সাহায্য আর বিশ্বাস এবং সবশেষে মহান আল্লাহর মেহেরবানি। এই জিনিসগুলি ছাড়া কোন ভাবেই সম্ভব হত না সেই বিশাল এবং কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে সুস্থভাবে পৌছানো।
সেরাতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম শেষে অনেক সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও ভোর রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি আবারো ভয় লাগাতে শুরু করলো কারণ আজ আমাদের ভয়ংকর খাড়া পাহাড় নাম খ্যাত দেবতার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আমিয়াখুম যাওয়ার কথা। কিন্তু বাইরের বেশামাল বৃষ্টি কতটুকু হতে দিবে তা বুঝতে পারছিলাম না । একে পাহাড়ি পথ, খাঁড়া পাহাড়, তারমধ্যে যাওয়ার পথে যদি কাদা থাকে তাহলে কিভাবে কি করবো চিন্তায় ৭টা বেজে গেলো। তারপর নাস্তা সেরে, টুকটাক প্রস্তুতি নিয়ে একটু দেরি করেই যাত্রা শুরু হল দেবতার পাহাড়ের দিকে, ততক্ষণে বৃষ্টি কমে গেছে এবং আকাশে মিষ্টি রোদ দেখা যাচ্ছে। গাইড অং এর নে্তৃত্তে আবারো শুরু হল যাত্রা, লক্ষ্য আমিয়াখুম। বেশ সমতল ২টা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যখন দেবতার পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম আমরা তখন বুঝতে পারিনি এটাই দেবতার পাহাড়। যখন পাহাড়ের শেষ সীমানায় পৌছে কোনভাবেই নামার কোন রাস্তা দেখতে পেলাম না, এবং নিচে দেখলাম ২০০ ফুট গভীর জল প্রপাত, তখন বুঝলাম আমরা দেবতার পাহাড়ে। কিন্তু নিচে নামবো কিভাবে! বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড় এত শ্যাতশ্যাতে হয়ে আছে যে, কোন রাস্তায় কিভাবে নিচে নামবো বা আদৌ নামতে পারবো কি না চিন্তা করতে করতে আমাদের ৫-১০ মিনিট সময় লেগে গেল। তারপর কোনমতে আছড়ে-পাছড়ে হাটু গেড়ে সরীসৃ্পের মত চেষ্টা করে অবশেষে নামতে সক্ষম হলাম ৯০ ডিগ্রি খাঁড়া দেবতার পাহাড়। যারা শীতকালে এখানে গিয়েছেন তারা জানেন এটা পার করা কতটা কষ্টকর সেখানে আমরা বৃষ্টির মধ্যে এটা পার করেছি। আমাদের সাথে যাওয়া দুই গ্রুপ আমাদের দুইজন মেয়েকে রীতিমত হাতে তালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে এই পরিস্থিতির মধ্যে এত কষ্ট সহ্য করে যেতে পেরেছি বিধায়। কিন্তু আমি বলবো আমাদের কষ্টের ফল আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে যে, আমরা যে আমিয়াখুম দেখেছি তা শীতকালের আমিয়াখুমের সাথে তুলনা চলে না ! এ এক ভয়ংকর রকম সুন্দর। ভাবা যায় না এত সুন্দর জায়গা বা প্রপাত আমাদের বাংলাদেশে আছে ! সত্যি এমন সুন্দর কিছু আমি দেখছি আমার নিজের চোখে !! চারপাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়, তারমাঝে আপন মনে বয়ে চলেছে আমিয়াখুম নামধারী রাগী জল প্রপাত, যার নিরন্তন ঝরঝর শব্দ আমাদের যেন সম্মোহন করে নিয়ে চলেছে অন্য কোন এক দেশে। প্রপাতের ঝিরিঝিরি ঠান্ডা পানিতে জুরিয়ে যাচ্ছে দেহ মন-প্রাণ আর ২ ঘণ্টার অকান্ত পরিশ্রম। মনের ক্ষুদা নামক জিনিসটা আসলে কি, সেদিন ই বুঝতে পারলাম ! যা মিটে গিয়েছিলো সবদিক দিয়ে। আমিয়াখুমের তুলনা যেন আমিয়াখুমই। মনে আমিয়াখুমের অপাড় সৌন্দর্য্যের বোঝা নিয়ে ফিরে চললাম থুইসাপাড়ার উদ্দেশ্যে।

এরাত ও থুইসাপাড়ায় কাটালাম আমরা নির্বিঘ্নে। সকালে আমাদের গন্তব্য জিন্না পাড়ার ভিতর দিয়ে নাফাখুম এবং সেখান থেকে রেমাক্রি পৌছে, রেমাক্রির নৌকায় করে দুপুর দেড়টার মধ্যে থানচি পৌছানো। সকাল ৬টায় যাত্রা শুরু করে দেই আমরা। কপাল ভালোই বলব কারণ রাতে অল্প বিস্তর বৃষ্টি হলেও ভোরে কোন বৃষ্টি ছিলো না বলে আমরা ভালোভাবে যাত্রা শুরু করতে পেরেছিলাম। এবারের পথ থুইসাপাড়ার পথের মত এত দুর্গম ভয়ংকর না বরঞ্চ সুন্দর সবুজে ঢাকা, পাথরে ভরপুর এবং ঝিরি পথে সাজানো। আমরা নদী পার হলাম, মাঠ পার হলাম, উঁচু নিচু অসংখ্য পাথর পার করলাম যা আমাদের হাটার গতি একটু কমিয়ে দিয়েছিলো কারণ পাথর বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল ছিলো তারমধ্যে যদি সাবধানে ঠিক জায়গায় পা না রাখা হয় তাহলে মুখ থুবড়ে মাথাটাই আগে পাথরে পরবে। তাই সাবধানতার সাথে এগিয়ে যেতে থাকলাম। সত্যি বলতে কি, আশে পাশের সৌর্ন্দয্য এতটাই মনোরম ছিলো যে হাটতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু একটু বেশি সময় নিয়ে সেই সৌর্ন্দয্য আরো ভালোভাবে দেখার মত সময় ছিলো না আমাদের হাতে। পাথর ডিঙ্গিয়ে, স্রোতের অনূকুলে বুক সমেত পানিতে ডুবে ঝিরি পথ পার করে প্রায় সকাল ৯টার দিকে আমরা নাফাখুম পৌছাই। প্রথমবার বান্দরবান ভ্রমণে নাফাখুম দেখা হয়েছিলো তাই নতুন করে দেখার কিছু নেই, একি রকম সুন্দর পানির ধারায় আবদ্ধ নাফাখুম, বাংলাদেশের নায়গ্রা। এবার দেখলাম সেখানে ২-৩ টা বাড়িঘর হয়েছে যা ২০১৪ তে ছিলো না। ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতিতে হাল্কা নাস্তা সেরে, স্যালাইন খেয়ে শুরু করলাম রেমাক্রির পথে যাত্রা। এরমাঝে আবারো সেই বৃষ্টি । ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি যেন আমাদের আরেক সফর সঙ্গী, পিছু ছাড়ে না সহজে কিন্তু আমরাও দমে যাওয়ার মানুষ না, এই বৃষ্টির কাছে। যেহেতু এই পথে তেমন পাহাড় নেই, এবং অর্ধেক পথ পাড়ি দেয়া শেষ তাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে আমরা বাকিটা পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম। নাফাখুম ছাড়িয়ে প্রায় ঘণ্টা খানিক আশার পরেই হঠাৎ দেখি বন্দুকধারী ৪-৫ জন। একটু চোখ ঘুরাতেই চোখে পরে প্রায় ১৫০-৩০০ জন বন্দুকধারী এ্যন্টি-আরকান সৈ্ন্য নদী পার হচ্ছে। ওদের দেখে আমাদের গাইড অং একটু চুপ হয়ে গেলো এবং আমাদের বলল কোন কথা না বলে সামনে এগিয়ে যেতে। আমরা ওর কথা মত এগিয়ে যেতে থাকলাম। প্রায় ২০ মিনিট নদীর পাড় ধরে হেটে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পড়ে নদীর এমন এক বাকে আসলাম আমরা যেখান থেকে নদী পার হয়ে ওপাড়ে যেতে হবে এইছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। গাইড অং নদীতে নেমে দেখলো ওর ই প্রায় গলা পানি সেখানে তারমানে আমাদের ওদিক থেকে যাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। যে জায়াগাতে নদী পার হওয়ার রাস্তা ছিলো সেখানে এ্যন্টি- আরকান বাহিনী থাকায় আমরা চুপচাপ চলে এসেছি। আমাদের জন্য ২টা পথ বাকি ছিলো তখন অং এর ভাষ্যমতে তা হল, অপেক্ষা করা যাতে আরকান বাহিনী একটু সামনে চলে গেলে আমরা ফিরে গিয়ে অই কম পানির জায়গা দিয়ে নদী পার হবো আর দুই হল পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে সামনে এগিয়ে যাওয়া সেখান থেকে নিচে নামার রাস্তা আদৌ আছে কি না অং নিজেই জানে না কারণ ওরা মানে পাহাড়িরাই অই রাস্তা তেমন একটা ব্যবহার করে না। ৫ মিনিট অনেক ভেবে আমরা পাহাড় বেয়ে ওঠাই বেছে নিলাম দুইটা পথের মধ্যে কারণ আবারো এ্যন্টি-আরকান বাহিনীর সামনে যাওয়ার মত সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই ছিলো না। যদি কিছু একটা হয়ে যায়, সাথে আমরা দুইটা মেয়ে ! ২য় বার চিন্তা না করে পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম আমরা। এ যেন মরার উপর খরার ঘা। আবারো সেই উঁচু নিচু পাহাড় বেয়ে উঠা, যা পিচ্ছিল এবং অনেকদিনের অব্যবহারিত পরিত্যাক্ত এক পাহাড়, যা উৎরানো আদৌ সম্ভব কি না আমাদের জানা নেই। এক পাশে পিচ্ছিল শ্যাওলা পড়া উঁচু পাহাড় আরেক পাশে নিচে দেখা যাচ্ছে নাফাখুমের পানির সাথে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী, যদি কোন কারনে পা পিছলে যায়, সোজা নিচে সেই পানির পানিতে না পাথরে পরবো কে জানে। আল্লাহ এবারো সহায় ছিলেন আমাদের। প্রায় এক ঘণ্টা এই পাহাড় বেয়ে উপরে নিচে উঠে নেমে, কাদায় পিছলে,জঞ্জাল আর শ্যাওলা পার করে অবশেষে আমরা নিচে ঝিরিতে নামতে সক্ষম হই। মনে সেই আগের শান্তি আর ফুরফুরে মেজাজ ফিরে আসে। এতক্ষন যে মানসিক এবং শারীরিক চাপের মধ্যে সময় পার হয়েছে আমাদের তা ভুলতে সামনের এক ছোট ঝর্নায় মুখ, হাত, পা ধুয়ে আকণ্ঠ পানি পান করি সবাই। ঝর্নার পানি ছিলো ঠান্ডা এবং মিস্টি। এমন ঝর্ণা বান্দরবানে কত গুলি আছে কেউ গুনে শেষ করতে পারবে না বোধ হয়। ৫ মিনিটের যাত্রা বিরতি শেষে আবারো হেটে চলি রেমাক্রির উদ্দেশ্যে। ঝিরি পথ ই বেশি ছিলো এবং এই জায়গায় পাথরে শ্যাওলার পরিমাণ অনেক বেশি ছিলো বিধায় হাটার গতি কমে যায়। তবুও অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে আমাদের ধরে রাখা সঠিক সময়ে আমরা পৌছে যাই রেমাক্রি। সেখান থেকে কোন কথা না বলে উঠে যাই নৌকায়। নৌকায় এই নদী পথ পাড়ি দেয়াটাও ছিলো আরেক ইতিহাস। ঢেউয়ের মাঝে দুলতে দুলতে চলতে থাকে আমাদের নৌকা। মনে হচ্ছিলো কোন নদী না, সাগর পাড়ি দিচ্ছি আমরা নৌকায় করে। রাশি রাশি ঢেউ কয়েকবারই আপাদ মস্তক ভিজিয়ে দেয় সবাইকে।এবং প্রতিবারই মনে হয় এই বুঝি নৌকা ডুবে গেলো।কিন্তু না, মাঝির নিদারুণ দক্ষতার জন্য ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যেতে থাকি আমরা। কিছুদূর যাওয়ার পর বোনাস হিসেবে পেয়ে গেলাম কুমারী ঝর্ণা দেখার সৌভাগ্য যা মূলত বর্ষাকালেই নাকি দেখা যায়, অন্য সময়ে দেখা যায় না। খুবি সুন্দর এবং অনেক স্বচ্ছল পানির ধারায় পরিবেষ্টিত কুমারী ঝর্ণা ক্ষনিকের ক্লান্তি মুছে দিলো। আবার ও এক পসলা ভিজে নিলাম সবাই ঝর্ণার পানিতে, খেয়েও নিলাম একটু খানি। ফিরে এলাম সবাই নৌকায়।
ফিরে যাচ্ছি যেমন ক্লান্ত আমরা তার চেয়ে বেশি ভারী মন খারাপের পাল্লা। সবারই যেন মন কাঁদে, ফিরে যেতে চায় না শহুরে ব্যস্ততায়। থানচি পৌছে, গাইডের কল্যানে এক রেস্ট হাউজে ভেজা জামা-কাপড় চেঞ্জ করে সোজা উঠে পড়ি বান্দরবানের বাসে। চান্দের গাড়ি তথা জিপে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো,কিন্তু যে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত আমরা তাতে করে আবারো ভয়ংকর বাঁকে জিপের দ্রুত থেকে দ্রুততর গতির খেলা দেখার মত আর সাহস হচ্ছিলো না, বরঞ্চ চুপচাপ বসে কাটিয়ে একটু দেরিতে হলেও বান্দরবানে পৌছানোটাই সবার ইচ্ছা, ঢাকার বাস তো সেই রাত ৯টায়। তাই হেলেদুলে সাদাকালো মেঘের মাঝে হাল্কা বৃষ্টির ফোঁটা হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বান্দরবান পৌছে গেলাম সন্ধ্যা ৭টায়। জন জীবনে ফিরতে পেরে একটুও ভালো লাগছিলো না ! পাহাড়, মেঘ বারবারই মনে পড়ে যাচ্ছিলো সত্যিই ! কথা ও কম বলছিলাম সেজন্য। রাতের খাবার সেরে উঠে পড়লাম বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে। সকাল ৬টায় ফকিরাপুলে নামলাম বাস থেকে। রিক্সায় বাসায় যাওয়ার পথে চোখে পড়লো ব্যাগে লেগে থাকা লাল মাটি, কাঁদা। নিমিষেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই পাহাড়, আমাদের হেটে চলা থুইসাপাড়ায়, বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল আমরা ৬ জন, কাদায় পিছলে পরা, পাহাড়ে বিছিয়ে থাকা অবিরাম বাংলার সহজ রুপ, দেবতার পাহাড় থেকে ৪ হাতে পায়ে নেমে যাওয়া আরো কত কি ! নাহ, আবারো যাবো কোন একদিন , সেই পাহাড়ে। আমিয়াখুমে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে, পাহাড়ি বাঁশের রান্না খেতে, মেঘের মাঝে ভেসে উঠা পাহাড়ে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকতে আবারো নিশ্চয়ই ফিরে যাবো আমি, আমরা।

ছবি গুলোর জন্য পুরোপুরি দায়ী বন্ধু Maruf Iqbal যে এত দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার মাঝে ও নিজের ভারী ক্যামেরাটা বহন করার সাথে সাথে আমাদেরকে ও ফ্রেমে এনেছে!

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:২৫
১৩টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×