১
গভীর রাত। ঘর অন্ধকার।
হালিম ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। লাফিয়ে ওঠার কোন কারন নেই। কারন ছাড়া পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে। সমগ্র মহাবিশ্বের সাথে তুলনা করলে লাফিয়ে ওটা মারাত্মক কিছু নয়।
হালিম অন্ধকারে চারদিকে তাকানোর চেষ্টা করল।
অনুভুতিটা অদ্ভুত। মারাত্মক কিছু। মনে হচ্ছে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোঁখ পিটপিট করে কিছু বলতে চাচ্ছে।
আগে কখনো এমন হয় নি। গত দশদিন এই বিষয়টা তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলছে। হালিম বিছানা থেকে অতি ধীরে নামল। অতি ধীরে নামার একটা সুক্ষ্ণ উদ্দেশ্য আছে। রহস্যটা মারাত্মক যন্ত্রনা দিচ্ছে। মানুষ রহস্য করতে ভালোবাসে। রহস্যে পড়তে ভালোবাসে না। আবার রহস্যে পড়লে রহস্য না ভাঙ্গা পর্যন্ত শান্তি পায় না। হালিম শান্তি পাচ্ছে না। তাকে রহস্য ভাঙ্গতে হবে। রহস্যকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে হবে।
হালিম অন্ধকারে অস্বাভাবিক ক্ষীপ্রতায় টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
২
টেবিলের পাশের সুইচটা দ্রুত জ্বালাল।
হালিম চমকে উঠল। ঘরে কেউ নেই। কেউ থাকলে বিষয়টা সহজ করে নেওয়া যেত। না থেকে বিভ্রান্তিটাকে আরো জটিল করে তুলছে।
টেবিলের নোংরা গ্লাসটা থেকে ঢকঢক করে পানি খেল। গ্লাসের পাশে দুইটা কার্ড। একটা বাতেনের বিয়ের কার্ড। আরেকটা চাকুরীর ভাইভা।
হালিম প্রচন্ড রকমের বিরক্তি বোধ করছে। চাকুরী বিষয়টা সোনার হরিন থেকে হীরার হরিনে রুপান্তর হয়েছে। সোনা সহজলভ্য হলেও হীরা সহজলভ্য নয়। তবুও ভোরে তাকে ভাইভার জন্য বের হতে হবে।
আশ্চর্য রকম অসহায়ত্ব নিয়ে হালিম ভাইভা কার্ডটা টেবিলে ছুড়ে ফেলল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। আজ থেকে সমস্ত ভাইভা বন্ধ। হালিমের একটু ভালো লাগছে। গুরুত্বপুর্ন কাজকে অবহেলা করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। একবার করতে পারলে মনের মাঝে শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে। নিজেকে সাধু -সন্ন্যাসী মনে হয়। হালিমের মাঝে সন্ন্যাস-সন্ন্যাস ভাব চলে এসেছে।
আরেকটা কার্ড হাতে তুলে নিল হালিম। বাতেনের বিয়ের কার্ড। কার্ডটার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে হুলস্থুল কিছু একটা ঘটাবে বিয়েতে। ঘটানো তার পক্ষ্যে অসম্ভব কিছু নয়। বাতেনের বাবা মিজান সাহেব স্বেচ্ছা অবসরপ্রাপ্ত এম,পি। একবার নির্বাচিত হয়েই তিনি আসন ছেড়ে দিয়েছেন। আসন ছেড়ে দেওয়ার অতিতুচ্ছ একটা কারন আছে। সংসদে তিনি মানকি ক্যাপ পরে বসে আছেন। স্পীকার অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ভরা সংসদে তাকে মানকি ক্যাপ পরতে নিষেধ করলেন। মিজান সাহেব বিষয়টাকে জাতীয় ইস্যু বানিয়ে ফেললেন। ঘটনার রাতেই তিনি প্রেস কনফারেন্স করে আসন ছেড়ে দিলেন। মানকি ক্যাপ পরার অধিকার একজন সংসদ সদস্যের না থাকলে সাধারন মানুষের অবস্থা নাকি আর ভয়াবহ। পদত্যাগের রাতেই তিনি যুব সমাজের কাছে রোল মডেল হয়ে গেলেন।
অতিদরিদ্র মিজান সাহেব ভাড়াবাড়ী থেকে এখন নিজের বিশাল ধানমন্ডির বাড়ীতে থাকছেন। বাড়ীতেও হুলস্থুল কারবার। রাজনীতি তাকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ না বানিয়ে বাহু ফুলে বটগাছ বানিয়েছে।
বাতেনের কার্ডটা হাতে তুলে নিল হালিম। আবার সেই অদ্ভুত অনুভুতি। কেউ পেছন থেকে ফিসফিস করে বলল,
“বাতেন বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ের আসরে প্রচন্ড উত্তাপে মরে যাবে।”
হালিম অতিরিক্ত টাইপের বিভ্রান্ত হয়ে দ্রুত পেছনে তাকাল। ঘরে কেউ নেই।
৪
অসীম অভাব আর বিশাল বিত্তের চাপ মানুষকে সন্ন্যাসের পথে নিয়ে যায়। সিদ্ধার্তের সন্ন্যাস জীবন বেছে নেওয়ার পেছনেও বিত্তচাপ কাজ করেছে।
হালিম দুবেলা খেতে পায়। অভাব তাকে সন্ন্যাসী বানাতে পারে নি। সন্ন্যাস সন্ন্যাস ভাব দূর করে হালিম এখন ভাইভা বোর্ডে বসে আছে। চাকুররীটা তার প্রচন্ড প্রয়োজন। মেসের ভাড়া তিন মাস বাকী। মিলের চার্জ বাতেন দিচ্ছে। ছেলেটা হালিমকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। বাতেনের ভালোবাসা হালিমকে বিব্রত করে।
মানুষের অনেক দুর্বলতার একটি হলো, সুখের উৎস জানা না থাকলে মানুষ সুখী হতে পারে না। কষ্টের উৎস জানা না থাকলে কেউ কাঁদতেও পারে না। বাতেনের ভালোবাসার উৎস কোথায় হালিমের জানা নেই। বাতেনের মাসিক টাকা পেয়েও সে হাসতে পারছে না।
‘আপনার নাম হালিম?’
হালিম ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বায়োডাটা থেকে চাইলেও তার নামের সাথে বাবা-মায়েরটাও জানতে পারে। অযথা নাম জিজ্ঞাসা করে কালক্ষেপণ করার অর্থ নেই। সন্দেহ হলে বায়োডাটাতে ছবি এটাচ করা আছে। মিলিয়ে নিতে পারে। উত্তর দিবে না ভেবেও হালিম মুখ কৃত্রিম হাঁসি নিয়ে বলল,
‘জ্বী জনাব। আমার নাম আব্দুল হালিম।’
মানুষটা চোখ কুঁচকে ফেলল। চোখ কুঁচকানোর কিছু নেই। ইংরেজীতে ‘স্যার’ না বলে বাংলায় ‘জনাব’ বলেছে। বাংলা ভাষা প্রীতির একটু কিঞ্চিত নমুনা দেখিয়েছে। এতে বিরক্তির কি আছে?
‘কি করেন?’
‘কিচ্ছু করি না।’
‘কিছু করেন না?
‘হুম।’
‘খাওয়ার টাকা কিভাবে জোগান?’
‘বাতেন দেয়। বাতেন সাবেক এম,পি মিজান সাহেবের একমাত্র ছেলে। আজ তার বিয়ে। বিয়ের আসরে সে মরে যাবেব। আপনি মিজান সাহেবকে চেনেন? উনি প্রচন্ড গরমেও মানকী টুপী পরে থাকে। সংসদে মানকী টুপি না পরতে একবার নিষেধ করা হয়েছিল। মিজান সাহেব এই বিরক্তিতে আসনটা ছেড়ে দিয়েছেন। চিনতে পারছেন, জনাব?
হালিম বুঝতে পারছে প্রশ্নকর্তার বিরক্তি জ্যামিতিক হারে বেড়েই যাচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে সবার মাঝেই বিরক্তিটা ছড়াতে।
প্রশ্নকর্তার পাশের বিশাল টাকওয়ালা নড়েচড়ে বসলেন। বিশাল টাকের সাথে একটা দশাসই ভুড়িও আছে। অতিরিক্ত সুখী মানুষরা দুইটা জিনিস একসাথে পায়। চেয়ারটা নাড়াতে গিয়ে ভদ্রলোকের ভুড়িটা টেবিলে ধাক্কা খেল। টেবিলটা প্রচন্ড রকমের নড়ে উঠল। লোকটা হেঁসেহেসে বলল,
‘মিজান সাহেবের ছেলের সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক? আপনি সন্ত্রাসী?’
ভুড়িওয়ালা স্যারকে চুড়ান্ত অপমানের একটা ইচ্ছা জেগে উঠল। হালিম গালভরা হাঁসি নিয়ে বলল,
‘দুঃখিত জনাব। আপনার প্রশ্নের জবাব আমি একটু পরে দিব। আগে প্রথম স্যারের কনসেপশনটা ক্লিয়ার করি।’
দুজন স্যারের ভ্রু একসাথে কুঁচকে গেল। কপালের চামড়ায় ভাজ পড়ল। তৃতীয় স্যার অতি বিনয়ের সাথে বললেন,
‘আসতে পারো তুমি।’
হালিমও অতি বিনয়ের সাথে বলল,
‘আচ্ছা জনাব।’
বের হয়ার সময় হালিম পেছনে ঘুরে তাকাল। সবাই বিরক্ত ও বিব্রত। হালিম নিজের নাকটাকে চেপে ধরে ঘড়ঘড় করে সর্দি ঝেড়ে দিল দেয়ালে। ভাইভা বোর্ডের তিনজন লোক অসহায়ের মত তার দিকে তাকিয়ে রইল।
৪
হালিমের মস্তিষ্ক কোন কাজ করছে না।
বন্ধ ঘরের সব কিছু সে উল্টেপাল্টে দেখছে। খাটটা এক টানে সরিয়ে ফেলল। কোথাও কেউ নেই। কৌটাগুলো পুরো ঘরে গড়িয়ে যাচ্ছে। হোমিওপ্যাথিক শিশিও খোলা হয়ে গেছে। কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। কোন জীবনের অস্তিত্বও নেই তার ঘরে। সে চমকে গেল। সারা ঘরে পিঁপড়াও নেই একটা। খাটের নিচে ঢুকে মরার মতো শুয়ে থাকল। কোন মশাও কামড়াচ্ছে না। হালিম উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেল।
ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গলির আমজাদিয়া রেস্টুরেন্টে। বিশ টাকার একটা মিস্টি এনে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল। প্রচন্ড ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।
গভীর রাতে সে চমকে উঠল। আবার একই অনুভুতিটা হচ্ছে। লাইট জ্বালিয়ে মেঝের দিকে তাকাল। আশ্চর্য! তার ঘরে সবসময় অসঙ্খ্যা জীব বাস করে। পিপড়া আর মশার অভয়ারন্য। সারা ঘরে মিস্টি ছড়ানো অথচ একটা পিঁপড়াও নেই। হালিম প্রচন্ড অসহায় হয়ে চিৎকার ছাড়ল। উদ্ভ্রান্তের মতো খাটে ধপ করে পড়ে গেল।
মাথায় একটা জিনিস বারবার খেলে যাচ্ছে। বিয়ের কার্ডটা পেয়ে মনে হয়েছিল বাতেন মারা যাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিষয়টা সত্য হয়েছে। বাতেন বিয়ের অনুষ্ঠানেই মারা গেছে। বরের সহযাত্রী কয়েকজনকে ঘরে বসিয়ে খাওয়ানো হচ্ছিল। হঠাৎ শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে যায়। সবাই ঘর থেকে বের হতে পারলেও বাতেন বের হতে পারে নি। পরনের সিল্কী কাপড়ে দ্রুত আগুন লেগে যায়। স্পট ডেড।
৫
হালিম কয়েক দিনের মাঝে শুকিয়ে গেল।
অসম্ভব ঘটনাগুলো ঘটেই চলছে। মেসের হাসান সাহেব একদিন গভীর রাতে ছুটতে ছুটতে রুমে আসলেন। ভদ্রলোক গার্মেন্টেসের সুপারভাইজার। মাসিক সাত হাজার টাকা বেতন পান। বউ বাচ্চা গ্রামে থাকে। হাসান সাহেব উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘হালিম ভাই, দাওয়াত।’
গভীর রাতে দাওয়াত পেয়েও হালিম মহাবিরক্ত। ইচ্ছা করল হাসান সাহেবের মুখের ভেতর মাটি পুরে বন্ধ করে দিতে। প্রকৃতি মানুষের সব ইচ্ছা পুরন করে না। হালিম আকর্ন হাঁসি দিয়ে বলল,
‘ভাই কি আরেকটা বিয়ে করতেছেন?’
‘ছিহ! ভাই, আপনি খালি শরমের কথা কন। ছেলের জন্য আইলাম।’
‘ছেলের বিয়ে?’
‘খালি মজা লন হালিম ভাই। ছেলের খৎনা। এলাকায় কান্ড ঘটাইয়া দিমু। গাও গেরামে খৎনা ম্যাড়ম্যাড়ে। অনুষ্ঠান করমু। আপনের দাওয়াত।’
‘একটা কথা ছিল হালিম ভাই?’
‘বলেন হাসান সাহেব?’
হাসান সাহেব কিঞ্চিত লজ্জিত ভঙ্গীতে বললেন,
‘কথাটা শরমের। তাও কই। খৎনা কোন নবীর যুগ থাইকা চালু হইছিল আমারে একটু কইবেন। ছেলের খৎনা তো। তত্যটা জানা ভালো। আজ আসি।’
হাসান সাহেব একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল। লোকটা গার্মেন্টেস সুপারভাইজার। অল্প বেতনে এমন রাজকীয় কার্ড কিভাবে বানাল?
হালিম কার্ডটা হাতে নিল। আবার অদ্ভুত অনুভুতি। কেউ পেছনে বলল,
‘মরে যাবে। রক্তে ভেসে যাবে।’
ঘটনাটা দ্রুত ঘটে গেল। হাজাম এসে হাসান সাহেবের ছেলের মুসলমানী করাবেন। বাচ্চা ছেলে কান্নাকাটি করছিল। দুইজন ষণ্ডা লোক কিম্ভুতভাবে বাচ্চাটাকে ধরে রেখেছে। মুসলমানীর সময় ছেলেটা চিৎকার করে সরে গেল। হাজাম ছেলের পুরুষাঙ্গটায় কেটে ফেললেন। প্রচন্ড রক্ত প্রবাহ আটকানো গেল না। গ্রামের বাড়ী থেকে হাসপাতালে সময়মতো পৌছাতে পারল না। রক্তক্ষরনে বাচ্চা ছেলে মারা গেল।
৬
কোন এক বিচিত্র কারনে হালিম চাকুরীর এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পেয়ে গেল। সকাল বেলা পিয়ন এসে দরজার ফাক দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠে হালিম চিঠিটা হাতে নিল। প্রচন্ড ভয়ে কাপতে কাঁপতে বিছানায় বসে পড়ল। চাকুরীর এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা তার কাছে ডেথ লেটার মনে হচ্ছে। হালিম বুঝতে পারল সে মারা যাচ্ছে। দু ঘন্টার মাথায় ভারী কিছুতে চাপা পড়ে মারা যাবে।
পরবর্তী দশ মিনিটের মাঝে সে ঘরের ফ্যানটা খুলে ফেলল। আর কিছু নেই। উপর থেকে কিছু পড়ার সম্ভাবনা নেই। ছাদটা আছে। ভুমি কম্পনে ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
হালিম প্রচন্ড চিৎকার করে বলল,
‘সুয়োরের বাচ্চা, সাহস থাকে সামনে আয়।’
হালিম লজ্জা পেয়ে গেল। ডায়ালগটা সিনেমা টাইপ হয়ে গেছে। চিৎকার করাটা ঠিক হয় নি। সম্পুর্ন ভিত্তিহীন একটা বিষয়কে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
হালিম বসে পড়ল। কার্ডটা খুলে ফেলল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কার্ডের দিকে। দুপুরের মাঝেই জয়েন করতে হবে। বাংলাদেশের ডাকবিভাগ কচ্ছপ গতির। কচ্ছপের পীঠে চড়ে চিঠিটা আসতে তিনদিন লেগেছে।
হালিম তার ট্র্যাঙ্কটা খুলল। সবচাইতে সুন্দর শার্ট-প্যান্টটা পরে ফেলল। আশ্চর্য! শীত লাগছে কানে। মধ্য বৈশাখে আকাশ ফাঁটছে। ফাটা আকাশের গরমে মানুষও ফেটে যাচ্ছে। কানে গরম লাগা বিষয়টা লজ্জাজনক। লজ্জা না পাওয়ার পক্ষেও যথেষ্ট যুক্তি আছে। প্রধান যুক্তি হলো,
“মেয়েদের ঠান্ডা রানে
পুরুষের ঠান্ডা কানে”
হালিম পুরুষ মানুষ।
কান ঢাকার জন্য ট্র্যাঙ্ক থেকে লাল মাফলারটা বের করল।
৭
হালিম রাস্তায় হাটছে।
হাটার চলনে দুলকি চাল। নিজের মাঝে ঘোড়া ঘোড়া ভাব আনার চেষ্টা চলছে। ভাব আনা অন্যায় কিছু নয়। দু ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু বিষয়ক পুর্বাভাসটা তাকে বিব্রত করছিল। এখন ফুরফুরে মেজাজ।
হালিম হাতঘড়িতে তাকাল। মৃত্যুর পুর্বাভাস বলছে আর মাত্র এক মিনিটা বাকী আছে।
রাস্তা পুরো ফাঁকা। তার ইচ্ছা করছে চাকুরীর প্রথম দিন হেটে যাবে। হেটে যেতে আধা ঘন্টা লাগার কথা। হাটার আরো একটা বিদঘুটে কারন আছে। অদৃশ্য অনুভুতিটা বলছে ভারী কিছু চাপা পড়ে মারা যাবে। কোন ধরনের রিস্ক নেওয়া যাবে না। এক মিনিট পার করতে পারলে সন্দেহটা কেটে যাবে।
হালিম রাস্তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। পেছন থেকে একটা বাস আসছে। বাসের ছাদে অনেকগুলো মুরগীর খাচা। লং রুটের গাড়ীগুলোতে মুরগীর খাচা দেখা যায়। লোকাল বাসে মুরগীর খাচা অন্য কিছু নির্দেশ করছে কি?
হালিম আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। নয়টা উনষাট। বাসটা তার কাছে আসতে এক মিনিট সময় নিবে। এর অর্থ তাকে বাসের নিচে চাপা পড়তে হবে। হালিমের ঠোটে তাচ্ছিল্লের হাঁসি। শেষ পর্যন্ত মুরগীর খাঁচার নিচে চাপা পড়ে মরতে হচ্ছে।
হালিম ঘেমে যাচ্ছে। দ্রুত গলার লাল মাফলারটা খুলছে। রাস্তা থেকে সরে যেতে হবে। বাঁচার চেষ্ঠা করতে হবে। বেচে থাকার আকুতিটা আদিম। আদিম অনুভুতিটা আকে দ্রুত রাস্তা থেকে সরিয়ে নিল। একটা কন্সট্র্যাকশন বিল্ডিঙয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল। মুরগীর খাঁচাবাহী বাসটার চাকা পাংচার হয়ে গেল। হালিম হাত ঘড়ি দেখে নিল। ত্রিশ সেকেন্ড বাকী আছে। ত্রিশ সেকেন্ডে কোনভাবেই সম্ভব নয় চাকা লাগিয়ে তাকে চাপা দেওয়া। হালিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। গলার লাল মাফলারটা দিয়ে সে মুখের ঘাম মুছছে।
৮
হেড মিস্ত্রী কামরুল জোরে ধমক দিলেন।
‘বান্দির বাচ্চা। জোরে টান। খাস নাই?’
খয়ের আলীর ইচ্ছা করছে দড়িটা ছেড়ে দেয়। দড়ি দিয়ে সে ইট তুলছে। ছয়তলা কন্সট্র্যাকশনে দড়ি দিয়ে কেউ ইট তোলে না। কপিকল দিয়ে তোলে। খয়ের বাধ্য হয়ে তুলছে। হেডমিস্ত্রী কামরুল তাকে বাধ্য করছে। কষ্টকর কাজ। মানবতার ওসিলাতেও তার সাথে ভালো ব্যবহার করা দরকার। হেড মস্ত্রী কামরুল তা করছে না।
কামরুল লোকটা বজ্জাত মানুষ। মুখে ভালো কথা নাই। মাথায় টুপি, চোখে সুরমা লাগিয়ে বসে থাকে। নিজেকে হাজ্বী বলে দাবী করে। খয়ের চিন্তিত হয়ে পড়ল। লোকটার মুখ খারাপ। হজ কবুল হয় নাই। হজ্ব করতে মেলা টাকা লেগেছে। কামরুল সাহেবের মেলা টাকা লস হয়ে গেছে। তাকে আবার হজ করতে হবে।
‘কিরে শুয়োরের বাচ্চা, দড়ি জোরে টান। দুইটা ইট তুলতে এত সময় লাগে। দশটা বাজতে তো আরও এক মিনিট বাকী মিয়া?
গালি শুনে খয়ের আবার বিরক্ত হলো। ইচ্ছা করল দড়ির মাথাটা ছেড়ে দেয়। সে দুইটা ইট তুলছে না। দড়ির নিচে বারোটা ইট বাধা। লোকটার শুধু মুখ খারাপ না মাথায়ও গন্ডগোলও আছে। হিসাব জানে না। হজ্ব করতে গিয়ে নিশ্চিত ঠকে এসেছে। গন্ডগোল মাথায় সব জায়গায় বেশী বেশী টাকা দিয়ে আসছে। হিসাব না জানলে তো এমন হবেই।
ইটের হিসাবে ভুল করলে সময়ের হিসাবে ভুল করছে না। দশটায় খয়ের কেক-কলা পাবে। এখনো এক মিনিট বাকী। লোকটা সময়ের চক্র পুর্ন না করে তাকে নাস্তা দিবে না।
কামরুল মিস্ত্রী আবার হুংকার ছাড়ল।
‘জোরে দড়ি টান। একটা ইট তুলতে সারাদিন লাগাবি মিয়া? বউরেও সাথে নিয়া আসিস। দুইজনে একলগে টানবি।’
খয়েরের মাথায় আগুন ধরে গেল। কামরুল মিস্ত্রী ইটের সঙ্খ্যাকে বারো থেকে ‘একে’ নামিয়েছে। বিষয় সেটা না। তার বউকে গালি দেওয়ার কিছু নাই। বউ তো মজুরী নিচ্ছে না। খয়ের টেনে রাখা দড়িটা ছেড়ে দিল।
হেডমিস্ত্রী কামরুল ছাদের কিনারাতেই বসে আছে। বদমাস খয়ের দড়ি ছেড়ে দিয়েছে। দড়িবাধা ইটগুলো ঝড়ের বেগে নিচে পড়ছে। ইট পড়ে যাওয়াটা কোন বিষয় নয়। অন্য একটা বিষয় আছে। রাস্তার পাশেই ছাদের নিচতলায় একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একটা লাল কাপড় দিয়ে মুখ মুছছে। দড়িবাধা ইট বাতাস কেটে কেটে ভু-পৃষ্ঠে নেমে যাচ্ছে। সোজা নিচে দাঁড়ানো লোকটার মাথা বরাবর।
ছয়তলা উপরের নির্মান শ্রমিকরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতি তাদের সাবধান করে দেবার সময়ও দেয় নি।
ফুটনোটঃ
গভীর রাতে প্রায় আমি চমকে উঠি।
কলম থেমে যায়। কান খাড়া করে শুনি অতি প্রাচীন এক বাদ্য যন্ত্রের সুর।
একজন বংশীবাদকের বাঁশীর সুরে বুকের মাঝে হাহাকার করে ওঠে।
বংশী বাদক আজ হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
হাহাকার আরো বেড়ে গেল।
প্রিয়মানুষেষূ,
ডাঃ মেহেদী হাসান তন্ময় (৩৬ তম, রমেক)
আপনাকে ভুলব না
ফেসবুকে রাজীব হোসাইন সরকার(https://www.facebook.com/razibhossainsarkar)