কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাত।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। সিঁধেল চোরেরা মাটির বাড়ীতে ‘শিঙ খুড়তে’ প্রস্তুত।
আমার অতি ব্যবহারে জীর্ন মোবাইলে ডাক এসেছে। ডাক দিয়েছে টেলিফোন নাম্বার থেকে। সাইলেন্ট করা নেই। রিং টোনে রুমমেটদের ঘুম ভেঙ্গে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। পড়িমড়ি করে রিসিভ করলাম।
‘হ্যালো।’
একজন পুরুষ লোক ভরাট গলায় কথা বলার চেষ্টা করছে। গলা ভরাটের চেষ্টা করার বিশাল কারন থাকতে পারে। আশ্চর্য! গলা গম্ভীর না হয়ে কেমন অদ্ভুত একটা স্বরে শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে করাত দিয়ে টিন কাঁটা হচ্ছে। করকরকরকরকর.........। আমি মোবাইলের সাউন্ড কমিয়ে শুনছি। ওপাশ থেকে টিন কাঁটা শব্দটা বলল,
‘হে সৌভাগ্যবান মহা-মানব সন্তান, পৃথিবীর সমস্ত পথভ্রষ্ট মানুষ যেখানে কপাকপ খাঁবি খাচ্ছে, সেখানে তুই গভীর জলের মৎস। সকলের ভাগ্যে কুফা লেগেছে, তোর কপালে মঙ্গল গ্রহ। আল্লাহ পাকের কাছে শুকরিয়া কর, এতো কোটি মানুষের ভেতর থেকে তোকে বেছে নেবার অন্য। তুই বড় নগন্য এবং নাদান। বল আলহামদুলিল্লাহ।’
এতো রাতে সুসংবাদ বাহক আমার মতো নগন্য ও নাদান বান্দাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। বিরক্তি সৃষ্টি করল। টিন কাটা শব্দে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমাকে বিব্রত আর বিরক্ত করল। আমি হিসহিস করে বললাম,
‘স্যার, আজ খুব ঘুম পাচ্ছে। কাল কথা বলব। ফোন রাখেন।’
আবার টিন কাটার শব্দ হিসহিস করে বলল,
‘তোকে আলহামদুলিল্লাহ বলতে বললাম, তুই আমার সাথে বেয়াদবি করলি?’
‘বেয়াদবি করি নাই জনাব। সুসংবাদ দেন, তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলব।’
‘নারে নাদান। তুই বেয়াদবি করেছিস। তোর উপর আল্লাহ পাকের গজব পড়বে। মহাবিপদ পড়বে। আমি স্পষ্ট তোর মাথায় শনির ভর দেখছি।’
‘তাহলে মঙ্গল গ্রহের কথা বললেন কেন?’
‘নাদান রে, তুই নাদান। তোর উপর গজব পড়বে। ভর-দুপুরে আল্লাহ পাকের ঠা ঠা পড়বে।’
ফোন কেটে গেল। গজবের কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ঘুম উধাও। একটা লোক যদি মধ্য রাতে ফোন করে আলহামদুলিল্লাহ বলতে বলে নিশ্চয় সেই লোক খারাপ মানুষ নয়। চর্ম চক্ষুতে যদি কারো কপালের মঙ্গল সারিয়ে শনির দুর্দশা লাগায়, তারা নিশ্চয় স্পেশাল চিড়িয়া। আল্লাহ পাকের বড়ই খেদমতি ও মেহনতী বান্দা। তড়িঘড়ি করে ফোন দিলাম। মাফ চাইতে হবে।
‘হ্যালো, জনাব আলহামদুলিল্লাহ।’
‘তুই বেয়াদবি করেছিস।’
‘দুঃখিত জনাব। আমার ভুল হয়েছে। জীবনে এতো বড় ভুল হতে পারে, কল্পনাতীত ছিল। আমাকে মাফ করুন।’
‘তুই বেয়াদবি করেছিস।’
‘মাফ করুন জনাব। আমি আপনার পা ধরলাম। এই পাপী বান্দা আর কখনো ভুল করবে না। আমি নিতান্তই নাদান মানব। আল্লাহ পাকের গজব ঠেকানোর উপায় আমার জানা নাই। আমাকে মাফ করুন।’
‘তুই বেয়াদবি করেছিস।’
আবার টিন কাটার শব্দ বন্ধ হলো। আমি আবার ফোন দেবার মনস্থ করলাম। ফোন দিয়েই বললাম,
‘জনাব আমাকে ক্ষমা করুন। আমি নাদান ও নগন্য। আমি ভুল করতেই পারি। আপনার দৃষ্টি ক্ষমাসুন্দর।’
‘তুই আমাকে চিনিস?’
ভয়ের মাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফোনদাতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হতে পারে। এদের কথার ধাঁচই এমন। রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভয় না পেলেও চলে, মুরীদদের সমীহ করে চলা ফরজ। এরাই জনগনকে খাতির যত্নে পেলে-পুষে বড় করে। গলায় সুন্দরবনের খাঁটি মধু ঢেলে বললাম,
‘জনাব, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি মানহানি এবং প্রাণহানির আশঙ্কা করছি। আপনিই পারেন আমাকে উদ্ধার করতে। আপনি হয়তোবা আল্লাহ পাকের পেয়ারে বান্দা। দেখুন না কিছু করা যায় কি না!’
ওপাশের কন্ঠ থেমে গেল। গলাকে আরও গম্ভীর করার চেষ্টা করছেন। গলা গম্ভীর হচ্ছে না, টিনকাটার শব্দ আরও জোরালো হল। আগে কেটেছে ভেজা টিন, এখন কাটছে শুকনো টিন। শব্দ বেড়েছে দ্বিগুণ। শুকনো টিন বলল,
‘তুই আমাকে চিনিসরে গর্ধব-মানব?’
‘আজ্ঞে না জনাব। আপনার পরিচয়টা দিয়ে আমাকে ধন্য করুন।’
‘আমার পরিচয় কি দিতে হয়রে?’
‘জনাব আমি অতিশয় নাদান, নগন্য ও নালায়েক।’
‘তুই জানিস, রোজ কেয়ামতের দিন কোন কোন জাতির বিচার আল্লাহপাক করবেন?’
‘জ্বী জনাব। জ্বীন ও ইনসান। আপনি কি জ্বীন বলছেন?’
‘তোর ঘটে অনেক বুদ্ধি। তুই কি আমাকে নিয়ে তামুশা করছিস?’
‘না জনাব। জ্বীনজাতিকে জাতি কি মিস্টার বীন? তাকে নিয়ে কেন তামুশা করব? তামুশার সাহস এই ক্ষুদ্র ঘটে নেই। আপনি কি কোকাফ নগরী থেকে কথা বলছেন?’
‘বাহ! ঘটে যে বুদ্ধি আছে তাই নয়, কিছুটা ভৌগলিক জ্ঞানও আছে।’
‘আমাকে জ্ঞানী বলে ছোট করবেন না জনাব। আমি অতিশয় নগন্য, নাদান, নালায়েক, ও দিগম্বর। আপনি কি জ্বীনের বাদশাহ? মহারাজ?’
কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবার থেমে গেলেন জ্বীনের বাদশাহ। বুঝতে চেষ্টা করছেন, আমি ঠাট্টা করছি কি না। এ সকল লোক সাধারনত লজ্জা বোধকে বিসর্জন দিয়েই পথে নামে। পাঠকদের নিশ্চয় বুঝতে বাকী নেই জল কোনদিকে গড়াচ্ছে।
জ্বীনের বাদশাহ বলল,
‘হুম। জ্বীনের বাদশাহ বলছি। হাসছিস কেন?’
‘হাসছি না মহারাজ। খুশীর চোটে জনাব, খুশীর চোটে। মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। আপনি কি কুত্তা চেনেন? না চেনারই কথা। জ্বীনেরা নাকি কুত্তাদের কাছে যেতে পারে না। কুত্তারা ঘেউ ঘেউ করে কামড়াতে আসে।’
জ্বীনের বাদশাহ আবার থেমে গেলেন। বুঝতে চেষ্টা করছেন, গর্ধব মানব তাকে অপমান করছে কি না। বুঝলে সমস্যা নেই। আমার নিজেরও কোন উপায় নেই। মধ্যরাতে কেউ ফোন করে বিরক্ত করলে তাকেও বিরক্ত করার অধিকার নিশ্চয় আমার আছে। আমি আবার বললাম,
‘মহামান্য জ্বীনের বাদশাহ, কি জন্য আমাকে স্মরন করে ধন্য করেছেন?’
‘তুই আমার সাথে বেয়াদবি করছিস?’
‘না জনাব। কোকাফ নগরীর বাদশাহর সাথে যাই করা যাক, বেয়াদবী করা যায় না। কি বলেন আপনি?’
‘চুপরাও বদমাস।’
‘চুপ করার আগে একটা কথা জনাব। আমি কি আপনাকে হুজুর করে বলব? হুজুর কথার সাথে জ্বীন-ভূতের একটা ব্যাপার আছে। ঠিক বলেছি হুজুর?’
‘চুপরাও বদমাশ।’
আমি চুপ করলাম না। বদমাশরা চুপ করে না। এরা মানুষকে টানা বিরক্তি করে যাবে। বিরক্ত হতে হতে একটা সময় বিরক্তি চরম সীমায় উঠে যাবে। এরপর কেউ বিরক্ত হতে পারবে না। অসহায় অসহায় অবস্থা চলে আসবে। ছেড়ে দে মা, কাইন্দা বাঁচি অবস্থা। আমি জ্বীনের বাদশাহকে এই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারব না। সেই ক্ষমতা আমার নেই। এরা দশ ঘাটে পানি খেয়েই আমার ঘটে ভিড়েছে। কিভাবে ঘাটে নৌকা বাঁধতে হয়, ভালোই জানে। আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। নিজেকেই অসহায় অসহায় মনে হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আপনি কি কোকাফ থেকেই বলছেন নাকি বাংলাদেশ থেকেই বলছেন?’
জ্বীনের বাদশাহ সাথে সাথেই উত্তর করল,
‘কোকাফ থেকে বাংলাদেশে এসেছি, শুধু তোর সাথে দেখা করার জন্য। তুই হাসছিস কেন, বদমাশ? তোর কপালে শনি আছে।’
আমি হেসে ফেললাম।
‘আপনি তো আমার কপালে মঙ্গল গ্রহ দেখেই এসেছেন। এসে দেখলেন শনি। আপনি কি ফেরত যাবেন?’
‘চুপরাও বদমাশ। হাসবি না। বিপদ আসছে। যত হাঁসি তত কান্না, বলে গেছেন রামশর্মা।’
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম,
‘রামশর্মা নামে কি জ্বীন আপনাদের মাঝেও আছে? যে ‘সিলকা’ বানায়?’
জ্বীন গম্ভীর হয়ে টিন কাঁটা শব্দে জানতে চাইল,
‘সিলকা কি?’
‘সিলকা মানে হলো ধাঁধাঁ। রামশর্মা কি জ্বীন।’
‘হুম।’
‘আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলে, জ্বীনকে শুধু মুসলামানরাই বিশ্বাস করে। সব জ্বীন মুসলমান। রামশর্মা নাম শুনে তো হিন্দু হিন্দু মনে হচ্ছে। রামশর্মা কি হিন্দু জ্বীন?’
জ্বীনের বাদশাহ এবার চুপ করে রইল। কপালে শনিওয়ালা লোকটা তাকে উদ্ভট উদ্ভট কথার জালে পেঁচিয়ে ফেলেছে। কোকাফ নগরীর জ্বীনের বাদশাহকে কথার জালে ফাসায় এমন নাদান পৃথিবীতে নাই। এই নাদানের কপালে নিশ্চয় শনি লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি বললাম,
‘হুজুর আপনি কোথায় অবস্থান করছেন? জানতে পারলে গিয়ে একটু খেদমতটা করে আসতাম। পায়ের ধুলো কপালে ঘষে নিজেকে ধন্য করতাম। শেওড়া গাছ-টাছে আছেন নাকি?’
‘চুপরাও বদমাশ।’
‘জনাব, এই গভীর রাতে মোবাইলে কল করার কি ছিল? আমাকে বললেই চলে আসতাম। আপনিও নিশ্চয় চলে আসতে পারতেন। আপনি কি উড়তে পারেন? আমার অনেক দিনের শখ জ্বীনদের মত আকাশে ওড়াউড়ি করব।’
‘চুপরাও বদমাশ।’
‘চুপ করলাম জনাব। রাগ না করে চলে আসেন। আমি নতুন একটা চেয়ার কিনেছি। এই চেয়ারে বসলে কোষ্ঠকাঠিন্য দুর হয়। আপনি যেভাবে গলাকে টিন কাটার মতো আওয়াজ করছেন, মনে হয় দশ দিন থেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন। আমার রুমে পেপেও আছে হুজুর। আসেন এক কোয়া পাকা পেপে খেয়ে যান। পেপে খেলে পায়খানা নরম হয়। পেট ক্লিয়ার হলে গলাও ক্লিয়ার হবে। কপালে শনি লাগা ইনসান জাতিও সহজে পটবে। কি বলেন জনাব?’
ওপাশ থেকে কথা নেই।
আমি আবার বললাম,
‘ইনসান জাতি নিয়ে তামুশা করার দিন নাই জনাব। যান তামুক টানতে টানতে টয়লেটে গিয়া পেট ক্লিয়ার করে আসেন।’
ওপাশ থেকে কেটে দেওয়া হল।
আমি কিছুক্ষন নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একদল জ্বীনরুপী মানব-জাতির জন্য করুনায় বিগলিত হলাম। যে মানুষের মাথায় জ্বীন সাজার অদ্ভুত কৌশল আসে, সে নিশ্চয় কর্মক্ষেত্রে আসলে না খেয়ে মরবে না।
এরা দেখে শুনে আমার মতো বোকা মানুষগুলোকেই বাছাই করে। যারা কাউকে না জানিয়েই স্বামী-স্ত্রীর মঙ্গলের জন্য সোনা-দানা জ্বীনদের রাজত্বে রেখে আসে। জ্বীনের অভিশাপ শুনলেই ঘুমাতে পারে না। আমিও সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। বেলকনীতে দাড়িয়েই ভোর হয়ে গেল।
ছোট চাচার মুখটা বারবার চোখে ভাসছে। পরিবার অন্তঃপ্রান এই মহান মানুষটা কিছু না বুঝেই জ্বীনের বাদশাহের ডাকে গোপনে চলে গেলেন। মহাস্থান গড়ে নির্জন এক বিকেলে নিজের জমানো সকল টাকা দিয়ে আসলেন। টাকা দিয়েও জ্বীনের বাদশাহর অভিশাপ কাটাতে পারলেন না। বিপদ আরো বেড়ে গেল। মহাস্থান গড়ে অচেতন অবস্থায় পরদিন ভোরে তাকে উদ্ধার করা হল।
ছোট চাচাকে ‘সিডাটিভ’ খাইয়ে অচেতন করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন রংপুর মেডিকেল হাসপাতালে অচেতন হয়ে পড়ে থাকলেন। সবাইকে না জানিয়ে, অসম্ভব ভালোবাসার এই মহান মানুষটা একদিন ভোরবেলা চলে গেলেন ওপারে। আমি সারারাত ছোট চাচার বিছানার পাশে দলা পাকিয়ে শুয়ে রইলাম।
আজকের ভোর সেদিনের ভোরের কথা জানিয়ে দিয়ে গেল। আমি ভোরবেলা রংপুর মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের তিনতলার বেলকনীতে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়েই রইলাম জড় কাঠের মতো। চোখের দৃষ্টি দূরে হাসপাতালে নিবদ্ধ। এই হাসপাতালেই একদিন মনুষ্য প্রজাতির কপটতায় পরাজিত হয়েছেন আরেকজন মানুষ।
কি করুনই না মানুষের পরাজয়!!!
হাসপাতালের উপর কিছু কাক উড়ছে। এরা মনে হয় মৃত্যুসংবাদ পেয়েছে। হয়তবা কোন নিঃস্ব মানুষ পরাজিত হয়েছে আরেকজন মানুষের অমানুষীর জন্য। নিরীহ বোবা পাখিগুলো কি বুঝতে পারছে মানুষের মনুষত্য?
এ লজ্জা রাখি কোথায়?
[মনে হয়-ডাক ছেড়ে কেদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও!
ঘৃনাহত মাটিমাখা ছেলেরে তোমার
এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও!
তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’]