মাঝে মাঝে আমি মারাত্মক ভয় পেয়ে যাচ্ছি। ভয় পাওয়ার কারন খুবই ক্ষুদ্র। এতো ছোট বিষয় নিয়ে ভয় পাচ্ছি শুনলে বন্ধু মানুষরা পাগল ভাবতে পারে। প্রথমে ভেবেছিলাম কারন প্রকাশ করব না। পাঠকদের আমি ভালোবাসি। যে সমস্ত পাঠক আমার মতো লেখকের অত্যন্ত নিম্নমানের লেখা পড়ে অভ্যস্ত, তাদের জন্যই ভয়ের কারন প্রকাশ করছি। এই লেখকের বুদ্ধিমত্তা শিম্পাজীরও পর্যায়েও পড়ে না। কচ্ছপ বা অন্য কোন চতুষ্পদ প্রানীর সমপর্যায়ে ভাবা যেতে পারে। যাদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে এখনো সকল বিজ্ঞানী সন্দিহান। আদৌ এদের মস্তিষ্ক আছে কি?
প্রিয় পাঠক, আপনাদের অজ্ঞাতেই আমি আমার লেখাকে লাইনচ্যুত করেছি। ট্রেন লাইনচ্যুত হলে প্রানহানি হয়, লেখা লাইনচ্যুত হলে ঘটনার গভীরতা বোঝা যায়। আমি ঘটনার গভীরতা বোঝানোর জন্যই সজ্ঞানে এই নিষিদ্ধ কাজটি করলাম। আমাকে ক্ষমা করে দেবার অসম্ভব কাজটি আপনারাই করেন, তাই এই দুঃসাহস করে দেখালাম।
লেখককে কিছু লিখতে গেলে ভুমিকা নিতে হয়। আমিও নিলাম। হয়ত একটু বেশীই নিলাম। আসল ঘটনায় আসা যাক।
ভয় পাওয়ার কারন হলো আমার লেখা। একটা করে লেখা শেষ করি আর ভীত হয়ে পড়ি। মাথায় কোন নতুন আইডিয়া থাকে না। আইডিয়া না থাকলে আপনাদের কি দিয়ে বিরক্ত করব এই দুঃচিন্তায় ঘুম হয় না। মাথা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। গড়ের মাঠের মতো ফাঁকা। মাথার ওজন শুন্য হয়ে যায়। মিনিট যায় ঘন্টা যায়, ভয়ের মাত্রা বাড়তেই থাকে। হাত পা অবশ হয়ে যায়। হাটুতে শক্তি পাই না। মনে হয় হাটু ভেঙ্গে পড়ে যাব। ধীরে ধীরে এই অবশতা সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।
মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে যাই-‘গুলেন বারী সিনড্রম’ এ আক্রান্ত হলাম কি না। এই রোগে কোন লক্ষন ছাড়াই হাত পা অবশ হতে শুরু করবে। প্রথমে এক হাত বা পা। কিছুক্ষন পর আরেকটা। এভাবে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাবে। কিছুদিন পর অবধারিত মৃত্যু।
আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত নই। ভীত এই ভেবে যে কিছু মানুষ আমাকে মনে রাখবে কি না। মায়ের পেট থেকে বের হলাম, শুধু মাত্র পড়ালেখা করে কৈশোর-যৌবনের মতো অমুল্য সময়গুলো শেষ করলাম, তা কিভাবে হয়? আমি যে পেশায় এসেছি, এখানে একটা ছোটখাটো ডিগ্রী করে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে আসতে হবে মধ্যবয়সে-চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশে। এই মাঝের সময়গুলো কাটবে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রমে। প্রত্যেকটা দিন হবে একরকম বৈচিত্রহীন একঘেয়ে। যাদের সবচাইতে সামাজিক হওয়ার কথা তারাই হবে অসামাজিক। পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করবে। একটা উদাহরন দিই।
হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যলয়ে অধ্যয়নরত এক বন্ধু আমার কাছে বেড়াতে এসেছে। কাকতালীয় ভাবে তখন হোস্টেলের তিনটা ব্যাচেরই প্রফেশনাল পরীক্ষা চলছে। সবাই অমানুষিক পরিশ্রম করছে। শুধুমাত্র খাবার ও নামাজের সময় সবাই ঝাক বেঁধে ডাইনিং ও মসজিদে যাচ্ছে। আমার বন্ধুটা দুইদিন টিভি রুমে কাটাল। ব্যালকনীতে চেয়ারে বসে বসে হাওয়া খেল। দুইদিন পর আমার কাছে এসে বলল,
‘ধুর শালা, থাকব না এখানে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
‘কেন রে? অ্যাজমা-ট্যাজমা আছে নাকি?’
‘অ্যাজমা নাই, অ্যালার্জী আছে। আমি ভার্সিটির পোলা। এই জায়গা আমার জন্য না। আমি দুই দিন তোর হোস্টেলে আছি। দিনরাত টিভি রুমে। এই দুইদিনে একটা ছেলেকেও আমি টিভিরুমে আসতে দেখলাম না।ব্যলকনীতে কাউকেও দেখলাম না। দোস্ত আমি এই যায়গায় থাকলে মরে যাব। আমি চলে যাই।’
আমি মেডিকেল পড়াশোনাকে অবজ্ঞা করছি না।এই যায়গায় পড়ার চান্স না পেলে আমার জীবনে সবচাইতে করুন কাহিনী ঘটে যেত। কাহিনী বলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। তবে ভার্সিটির জীবন নিয়ে আমার অসম্ভব কৌতুহল আছে।
আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। আগে শুধু ঘুম আর ঘোরাঘুরি করে দিন চলে যেত। এখন সবকিছু রুটিনের মাঝে চলে এসেছে। প্রতিদিন সকাল-বিকাল লেখি। বৃহস্পতিবার লিখতে লিখতে ভোর হয়ে যায়। ক্লাশে রেগুলারিটি আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। যেদিন থেকে জীবনটাকে দুইটা ভাগে ভাগ করে ফেললাম, সেদিন আমার পরিতৃপ্তি আসল। ছোটখাটো একটা ডিগ্রী আর লেখালেখি সমানে চলবে। এখন আমার লেখার মাঝে আকর্ষন নেই। নিম্নমানের বাজারী লেখা হতে পারে। তবে ধীরে ধীরে পরিশীলিত হবে বলে আশা করি।
আমার জীবনের সবকিছু বদলে গেল দুই হুমায়ুনের ছোঁয়ায়। একজন কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ অপরজন বন্ধুমানুষ প্রফেসর হুমায়ুন কবির।
হুমায়ুন আহমেদ শেখাল কিভাবে লিখতে হয়, লেখকের চিন্তা কিভাবে আবর্তিত হয়। হুমায়ুন কবির শেখাল কেন লিখতে হয়।
একদিন হুমায়ুন বলল, ‘এমন কিছু কর, যার জন্য লোকে তোকে মনে রাখবে, ভালোবাসবে। টিপিক্যালি নয়, এটিপিক্যাল পথে। যে বিষয়টা তোর সবচাইতে ভালো লাগে সেটাই নিয়ে মেতে থাক।’
আমি বদলে গেলাম। লেখালেখি আমাকে টেনে নিয়ে গেল তার ভুবনে। নিজের জন্য, মানুষের জন্য আমাকে লিখতে হবে।
আমি লিখতে শুরু করলাম। কারো কারো ভালোবাসা পেতে লাগলাম। প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস ‘হিমু-ফিলিয়া’ তে অস্বাভাবিক সাড়া পেলাম। যারা ধারাবাহিক পড়তে ভালোবাসে না তারা পেনড্রাইভ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-‘পুরোটায় দিবি। কেউ জানবে না। আমি একাই পড়ব।’ কেউ বলে, ‘ভাই কাহিনীটা কি সত্যি? অমিতের কি হবে? মরে যাবে না বেচে থাকবে?’ তারিকুল হাসান নামে এক সিনিয়র ভাই বললেন, ‘তুমি টানা পাঁচ বছর লিখে যাও। এরপর দেখ কি কাহিনীটা হয়।’
আমি লিখছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি টানা লিখে যাব। পাঁচ বছর পর কি হয় সেটা দেখব।
হোস্টেলের পাশেই ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক। দিনে তিন-চারবার কাজে পারাপার করতে হয়। শুধু একবার একটা গাড়ীর নিচে চাপা পড়লেই শেষ। কি হবে ভাবতে পারছি না। এতো ছোট জীবনে কিছুতো করতেই হয়। বন্ধুমানুষ প্রফেসর হুমায়ুন কবির বলল,
‘তোর কি বিখ্যাত হওয়ার ইচ্ছা আছে?’
‘না, নেই। তবে বিখ্যাত বিখ্যাত কিছু লেখার ইচ্ছা আছে।’
‘সিগারেট খাস?’
‘না খাই না।’
‘তাহলে তো কিছুই লেখতে পারবি না। বিখ্যাত ব্যক্তিরা এক লাইন লেখে আর একচুমুক মদ খায়। তুই অবশ্য মদ খাবি না। তুই খাবি সিগারেট। দেখবি মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া আসবে।’
আমি মদ কিনতে গেলাম। বয়স কম বলে দিল না। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনলাম-বেনসন এন্ড হেজেস। সিগারেটের প্যাকেটটা খাতার পাশে সাজিয়ে রাখলাম। সারাদিন দেখি আর লেখার চেষ্ঠা করি। দামী সিগারেটে দামী দামী আইডিয়া আসার কথা। আইডিয়া আসল না। সারাদিন চলে গেল একটাও আইডিয়া আসল না। কি করা যায় বোঝা গেল না। একটাতে আগুন লাগিয়ে টান দিলাম। নাড়ীভুড়ি উলটে আসার জোগাড়। হুমায়ুন বলল,
‘প্রথম প্রথম তো, তাই এই অবস্থা। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি ঠিক হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
একদিন দুপুরে পরিচিত এক সিনিয়র ভাই ফোন দিলেন।
‘কইরে রাজীব?’
‘ভাই আমি ঘুমাচ্ছিলাম। সারাদিন একটা টানা ঘুম দিলাম। কলেজ বন্ধ। ঘুমিয়ে খুব মজা পাচ্ছি। আপনি কোথায়?’
‘আমি একটা বাসের ভেতরে। এক্সিডেন্ট করেছে। একটা পা ভেঙ্গে গুড়াগুড়া হয়ে গেছে। চাপা পড়ে আছি। উদ্ধারকাজ চলছে। প্রথম ফোনটা তোকেই দিলাম। একটা কথা জানানোর জন্য।’
‘ভাই কিছু বলা লাগবে না। শুধু বলেন কোথায় আছেন? আমি আসতেছি। আপনাকে উদ্ধার করব।’
‘চুপ বেটা। কোন কথা হবে না।
‘আচ্ছা ভাই কথা হবে না। সাইলেন্স। একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্স।
‘শোন, ঘুমাস না। ওঠ, লেখালেখি কর। হাসপাতালের গেলে যেন তোর একটা একটা লেখা পাই। শুয়ে শুয়ে পড়ব। কেমনে পাঠাবি পাঠা।’
এই লোক বলে কি? মাথা খারাপ নাকি? বাসের নিচে চাপা পড়ে আছে। কোথায় বের হওয়ার জন্য চেচামেচি করবে- তা না করে আমার লেখা খোজে।
আমি আর নিজেকে থামাতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম। হড়হড় করে চোখে জল চলে আসল। কান্না লুকানোর চেষ্টা করলাম না। সবসময় কান্না লুকানোর বিষয় না। ভালোবাসা যেমন প্রকাশ করতে হয়, তেমনি কান্নাও প্রকাশ করতে হয়।
আরেকটা ছোট ঘটনা বলে শেষ করা যাক।
আমার পিন্নু হোস্টেলে থাকি। এই হোস্টেলের চৌত্রিশ নাম্বার রুমের দরজার ভেতরের দিকে একটা কবিতা লেখা আছে। অনেকদিন আগে কোন সিনিয়র ভাই লিখে রেখেছিলেন। পাঠকদের জন্য কবিতাটা তুলে দিলাম।
‘এই দরজার একটি কোনে
লিখে দিলাম আল্পনা-
আমার স্মৃতি কইবে কথা
যেদিন আমি রইব না’
আমি লেখাটার দিকে সারাদিন তাকিয়ে থাকি। যে লিখেছিল তার কথা ভাবার চেষ্ঠা করি। কি অদ্ভুত? সেই ভাইটাকে আমি চিনি না। আল্পনা দেখেও তার ছবি আমার চোখে ভাসছে না। ভাইটা ব্যর্থ হয়ে গেছে? একজন লোকও তাকে চিনতে পারছে না। কেউ মনে রাখে নি। আজ তার আঁকা আল্পনা কোন কথা বলছে না।
আমার কথা বলার জন্য আমাকেই আল্পনা আকতে হবে। মানুষের মাঝে দীর্ঘদিন জেগে থাকতে হবে। জেগে থাকার লোভ বড় ভয়ংকর। আমি এই লোভে আটকা পড়ে গেছি।
Written By: রাজীব হোসাইন সরকার।
ফেসবুকেঃ (https://www.facebook.com/nillchokh)