রাত ৯ টার মত বাজে। ৫-৬ জন ২০-২৫ বছরের ছেলে বাসের পেছনে বসে বসে মোবাইলে জিসম-২, হেইট স্টোরি অথবা কারো স্ক্যান্ডাল ভিডিও অথবা পর্ণ ভিডিও দেখছে।
পলকহীন এক দৃষ্টিতে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে। আর দাঁতে দাঁত চেপে জিহবার পানি ভিতরে নিয়ে ইস সুরে শব্দ করে যাচ্ছে।
একটি মেয়ে হাত তুলে বাস থামালো, আজ কর্মস্থলে কাজ শেষ করতে দেরী হয়ে গেছে। ক্লান্ত শরীরে গিয়ে বাসে উঠলো। ছেলেগুলি ভিডিও দেখতে দেখতে কামুক হয়ে গেছে। তারা বাসের ড্রাইভারকে কোনমতে ম্যানেজ করে ফেলে। বাস নিয়ে যায় অন্ধকার এক নির্জন জায়গায়। সেই অসহায় মেয়েটির উপর চললো, অমানবিক নির্যাতন। তারপর রাস্তায় মেয়েটিকে ফেলে দিয়ে চলে গেল।
পরের দিন সংবাদপত্র, ব্লগ, ফেসবুক সকল মিডিয়া এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হল।
সুশীল সমাজ বলছে-“দেশ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আজ দেশ রসাতলে গেছে।” সুশীলদের কথা শুনলেই বুঝতে পারি দেশ সর্বদা গতিশীল।
আবার কেউ কেউ বলবেন-“আমাদের যুব সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।”
আাবার কেউ বলবেন-“মেয়েরা এত রাতে চলাফেরা করে কেন? কি কাজ থাকে এত রাতে? মেয়েরা শুধু ঘরেই থাকবে।তাদের একমাত্র কাজ ঘর সামলানো, স্বামী-সন্তানের যত্ন নেওয়া। রান্না বান্না করা।”
কিন্তু স্বামী-সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য, এক মুঠো ভাতের জন্য তাকে বাইরে কাজের জন্য বের হতেই হয়।
ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, সংবাদ পত্র বিভিন্ন মিডিয়ার চাপের যন্ত্রণায় পুলিশ কেস নেয়। কেস হলো:
আসামীরা ধরা পড়লো।
এখন সত্যিই ধর্ষণ হয়েছে কিনা, সেটার আবার ডাক্তারী পরীক্ষা চলবে। লোক মুখে শুনেছি সেটাও নাকি এক ধরনের অত্যাচার।
কেস আদালতে উঠলো- সেখানেও পক্ষে বিপক্ষে কথা চলবে।
এটা নিয়ে অনেক মানুষ পত্রিকায় রসে ভরা হাড়ি টাইপের গল্পের মত পড়বে।
এদিকে আসামী পক্ষ , ধর্ষিতার পরিবারকে কেস তুলে নেওয়ার জন্য প্রাণনাশের হুমকি দিবে।
এতক্ষন যা বললাম, তা সবাই বলে, আমিও বললাম। নতুনত্ব কিছু নেই।
এখন কথা যেটা সেটা হলো, এইসবে কারণের পেছনে কি কি কারণ থাকতে পারে?
প্রত্যেকটা কারণে পেছনে ২টা কারণ থাকতে পারে। একটা অতীত কারণ আর আরেকটি ভবিষ্যত কারণ।
অতীত কারণ হলো: ঐ ছেলেদের জিসম-২, হেইট স্টোরী, বা পর্ণ মুভির মত ভিডিও দেখা, এবং শরীরের ভিতরে কামুক ভাব সৃষ্টি হওয়া।
মানুষের মন সবাই বলে ১টি। কিন্তু আমি বলি ২টি। একটি মানসকি মন, আরেকটি যৌনাঙ্গের মন। যৌনাঙ্গের মনের শক্তি মানসিক মনের চেয়ে প্রবল হয়ে থাকে। যখন যৌনাঙ্গের মন মানসিক মনের চেয়েও শক্তি সঞ্চার করে, তখন মানুষ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
যাহোক জিসম-২ এর কথা বলি, এই সিনেমা নিয়ে গোটা দুনিয়া মাতামাতি হয়েছে। আমাদের দেশেও হয়েছে। আমাদের দেশেই এই সিনেমা মুক্তির আগেই অনেক আলোচনা হয়েছে। আলোচনার একটিই কারণ, পর্ণতারকা সানি লিওন।
সাধারণ জনগন যারে চিনে থ্রী-এক্সের নায়িকা হিসেবে। পত্র-পত্রিকা সানির অতীত, বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে কলামের পর কলাম লিখে। ছেলেপেলে জানতে আগ্রহী হয়, কে এই সানি লিওন?
জীবনে এত থ্রী দেখছি, সানিরেই চিনি না, দে ডাউনলোড দে। সবাই তখন ধুমাইয়া সানির স্পেশাল HD, Blue ray প্রিন্টের ভিডিও নামায়। সানিরে নয়নভরে দেখে।
এরই মধ্যে জিসম-২ মুক্তি পেল, সবার আগ্রহ সানি কি করছে এই মুভিতে।
ওমা কি করছে পরিচালক, পিএইচডি PHd ধারী সানিরে দিয়া এসএসসিSSC পরীক্ষা দেওয়াইছে।
মানে সিনেমায় সানির পুরো শরীর দেখা যায় নি, অর্ধেক দেখা গেছে। অর্ধনগ্ন অভিনয় করেছে।
নগ্নতার চেয়ে অর্ধনগ্নতায় মানুষকে বেশি কামুক করে ফেলে। কারণ বাকি অর্ধেককে জানার জন্য মানুষের চরম আগ্রহ থাকে।
আগ্রহ পূরণ হচ্ছে ভবিষ্যৎ কারণ।
দুর্বল মনের মানুষের এই আগ্রহ বা ইচ্ছাটা পূরণ হয় আশে পাশে থাকা কোন অসহায় মেয়ের উপর দিয়ে।
একই কথা হেইট স্টোরী, বা অন্যকোন প্রাপ্তবয়স্ক মুভির ক্ষেত্র্রে।
এখন অনেকেই হয়তো বলবেন, এইসব বিদেশী মুভি, বিদেশী অভিনেত্রী, তাদের ব্যাপার, এই দেশে তো কেউ এমন করছে না। এইসব ফালতু কথা বা প্যাঁচাল।
ভাই তেজস্ক্রিয়তা বুঝেন? এই সবের মধ্যে তেজস্ক্রিয়তা থাকে। যা নীরবে ধীরে ধীরে আপনাকে ধ্বংস করে।
যাহোক এইসব নিয়ে কোন সমস্যা ছিলো না। বিদেশের ব্যাপার, আন্তর্জাতিক ঘটনা।কিন্তু সমস্যা কোথায়?
সমস্যা আমাদের দেশের বিনোদন মিডিয়া নিয়ে। খুব একটা সমস্যা হত না, যদি তারা এইসব নিয়ে মাতামাতি না করতো। কিন্তু মিডিয়া তাদের নিয়েই মাতামাতি করে।
দেশের সাথে এইসবের সম্পর্ক কি? আমি খুব একটা সম্পর্ক দেখি না, কিন্তু আমাদের সংবাদপত্র –মিডিয়া দেখে।তারা প্রকাশ করে সানীর এই খবর, সানীর ঐ খবর, সোনমের বিকিনিতে তার বাপ খুশি, নারগিস আরো খোলামেলা হচ্ছে, সোনাক্ষী ছোট কাপড়ে নিজেকে উপস্থাপন করছেন, জেনেলিয়া ডিসুজা পরকিয়ায় মগ্ন, দিপীকার রসায়ন, কঙ্গনার পদার্থ, ক্যাটরিনার যুক্তিবিদ্যা, কারিনার দর্শন ইত্যাদি ইত্যাদি খবর আর সাথে তাদের ছোট পোশাকের ছবি।এই সব শুনে আমাদের কি লাভ? ভাই তাদের খবর যখন দিবাই, তাদের কি ছোট পোশাক ছাড়া বড় পোশাকের কোন ছবি থাকে না?
আমাদের গুলোও লেখা হয়। কি লিখবে? সাকিব খান, অপু বিশ্বাস, জলিল-বর্ষার বাইরে আর কাকে নিয়ে লিখবে? এদের খবর পাবলিক খুব একটা খায় না, সানীর খবর দাও পাবলিক খাবে, তাই তারই ইতিহাস বর্ণিত হয়।
মিডিয়ায় বিদেশী অভিনেতা-অভিনেত্রীর কদর দেখে, আমাদের তারকারাও ওদের মত হতে কতক্ষন সময় নিবে?
শুধু শুধু মিডিয়ার দোষও তো থাকে না। আমাদেরও দোষ আছে। আমরা আবার বেছে বেছে খবর খাওয়া লোক। সব ধরনের খবর খাই না। ব্রেকিং নিউজ হলে দেখি, না হলে বিনোদন খবরে চলে যাই। দেশের কোন ছেলে বড় কোন কিছু অর্জন করলে সেটার উপর মুড়ি-চানাচুর মেখে খাই।শেষে সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিই। আর মারিয়া শারাপোভার বিকিনিওয়ালা ছবি বিছানার তলে লুকিয়ে রাখি। আরেফিন রুমির জেলে যাওয়ার কথা শুনে খুশি হয়, কিন্তু সঞ্জয় দত্তের জেলে যাবার কথা শুনলে মন খারাপ করি।
মাঝে মাঝে ভাবি, দেশের পত্রিকায় যখন বিদেশীদের চাহিদা বেশি, তখন দেশের সংবাদপত্র পড়ে কি লাভ? বিদেশী সংবাদপত্রই পড়ি, বাংলাদেশের কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর হলে তারাই প্রচার করবে।
ধরেন, আপনি খুব নামী-দামী সংবাদপত্র পড়ছেন, সংবাদ পড়তে পড়তে বিনোদন পাতায় চলে এসেছেন, একবার চোখ বুলালেন, দেখলেন অর্ধনগ্ন কোন ছবি দিয়ে লেখা আছে, উমুক সিনেমায় এই অভিনেত্রীর অন্তরঙ্গ দৃশ্যে ২৭ বার চুম্বনের দৃশ্য রয়েছে। অভিনেত্রীর উপর থেকে সহজে চোখ সরে না, জিহবার ভিতর হয়তো হালকা পানি চলে এসেছে। মনের ভিতর তো কিছু একটা খেলা করবে।
আমি তখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ি। গ্রামে এক বৃদ্ধ লোকের মুদির দোকান ছিলো। তাকে আমরা দাদু বলেই ডাকি। তিনি নিয়মিত পত্রিকা নিতেন। কিন্তু কোনদিন আমাদের পত্রিকা পড়তে দিতেন না, রাজনৈতিক খবর থাকে বলে, পড়া ঠিক না। উনার সমবয়সী তারাই পড়তেন। একদিন দোকানে তেল কিনতে গেলাম।
সেদিন বৃহ:বার ছিলো। পত্রিকার সাথে বিনোদন পাতা ছিলো। উনারা বিনোদন পাতা এক সাথে দেখছেন, আর বলছেন-“দেখতে সুন্দর আছে,” ফিসফিস করে আরও শারীরিক বর্ণনা দিলেন।
যাহোক সেদিন বুঝলাম, সে কেন আমাদের পত্রিকা পড়তে দেয় না।
এখন এইসবের মধ্যে সমাজের এইসব অপরাধের সম্পর্ক কি?
সম্পর্ক আছে।
কিছুদিন আগে, রামপালের কয়লা ভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্র নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি, কথায় পড়েছি, শুনেছি।
আবার রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও অনেক কথা শুনেছি। পানির পর্যাপ্ত সরবরাহের কথা বলা হচ্ছে।
যাহোক দু’টো থেকেই আমরা বিদ্যুৎ পাবো, বিদ্যুৎ পেলেই তো লাভ। লোডশেডিং কম হবে। শিল্প-কলকারখানার জন্যও অনেক লাভ। মোটকথা দেশ উন্নয়নের দিকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।
তবে কেন এত ভয়? কেন এত কথা? কেন এত যুক্তি? এত দুশ্চিন্তা ?
ভয় একটাই পরিবেশগত সমস্যা। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটার আশংকা। যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকীস্বরুপ।
তাই এত চিন্তা, তাই এত ভয়।
প্রসঙ্গ বাদ।
কিছুদিন আগে একতা কাপুর, পাওলি দম, স্বস্তিকা, দেবশ্রী রায়, রাহুল বোস এরা বলেছে- নগ্নতা সাহসিকতার পরিচয়। তারা এই সাহসিকতা উপস্থাপন করে সিনেমা নির্মাণ করে।
আর এই সব প্রচার করে মিডিয়া। অনেকটা মোটা বর্ণ দিয়ে লিখে শিরোনামে প্রকাশ করে।
অনেক সমালোচক তাদের এই নগ্নতা নিয়ে সমালোচনা করে।
অনেকেই সাহসীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলে-“তারা নগ্ন হলে সমস্যা কোথায়?এরা শিল্পী। নগ্নতা এক ধরনের শিল্প। পুরুষ নগ্ন হতে পারলে, নারী কেন নগ্ন হতে পারবেনা? ”
কঠিন প্রশ্ন। উত্তর দিতে যাবেন- নারীকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন।
যাহোক প্রশ্ন হতে পারে, তারা তো আমাদের দেশের কেউ না, এদের নিয়ে কেন ফালতু কথা বলছি? ঐ যে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা আছে। বেশিদূর যেতে হবে না, ঘরেই দেখতে পাবেন তেজস্ক্রিয়তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ স্টার জালসা।
আপনি প্রয়োজনে নগ্ন হবেন, শারীরিক গঠনের প্রদর্শনী দেখাবেন, অন্তরঙ্গ দৃশ্যে শিৎকার দিবেন, সমস্যা নেই। আমাদের বিনোদন দরকার, মনরঞ্জন হলেই হলো।
সামাজিকতার কি দরকার? সামাজিকতা দিয়ে কি হয়?
কিন্তু আমরা সামাজিকতার সাথেই সম্পর্কিত। উপরোক্ত বিনোদন তো সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ।
আমরা মানুষ। আমরা সামাজিক জীব। আমার কোন কাজ যদি সমাজের মানুষের ক্ষতির কারণ হয়, সামাজিক বিপর্যেয় কারণ হয়, তাহলে সেটা অবৈধ।
আমাকে সেই কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। কারণ আমাকে খেয়াল রাখতে হয়, আমার স্বার্থ বা লাভের কারণে অন্য কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কিনা?
আজকাল অনেকেই নিজের স্বার্থ বা লাভ বা বিখ্যাত হওয়ার জন্য অনেক পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু স্বার্থে এতটাই অন্ধ যে, তারা খেয়াল করতে চান না, আমার এই স্বার্থের কারণে কে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
সামান্য লাভের আশায় দোকানদার যখন গুড়া মশলায়, ইটের গুড়া মিশায়, তখন সে এলাকার অনেকেই অসুস্থ হন।
তেমনি সামান্য স্বার্থ বা লাভের জন্য গোটা সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
দোষী কিন্তু আমরা আশেপাশের সবাই। আমাদের চাওয়াতেই দোষ আছে।
যাহোক অনেক কিছুই বলে ফেললাম, অনেকের ঘোর আপত্তি থাকবে। এইসব কথাতে কেউ আমাকে নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীও ভাবতে পারে।
কিন্তু কি করার, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, আজ না হয় কাল তো প্রকাশ পেতই।
“ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানালাম।”