মতিন মন্ত্রমুগ্ধের মত পানি ভর্তি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখলে মনে হবে গ্লাসটা তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। মতিন ঘামছে। যদিও তার মাথার উপর সিলিঙে একটা ফ্যান ঝুলে আছে। ফ্যানটা সর্বোচ্চ গতিতেই ঘুরছে।মতিন পিপাসার্ত।নাইট গার্ডের বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কুকুর ডাকছে। মতিন গ্লাসটা হাতে নেয়।তার হাত কাঁপছে। সে সবটুকো পানি পান করে ফেলে খুব দ্রুত। তার কিছুক্ষন পরেই বিষক্রিয়ায় মতিনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় মতিনের বয়স ছিল পঁচিশ। এবং পরনে ছিল একটা সাদা লুঙ্গি।
১
যে জীবনটাকে মতিন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সকাল থেকে রাতে, একদিন থেকে আরেকদিনে-সে জীবনের একটা অস্তিত্ব আছে। সে জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই। এমন কোন উদ্দেশ্য নেই যার জন্য বেঁচে থাকা যায়। তবুও মতিন বেঁচে আছে। কারন সে মৃত্যু ভয় পায়। একটা হোটেলে বসে সে সিঙ্গারা খাচ্ছে। টিভিতে খবর দেখাচ্ছে। খবরে রোহিঙ্গাদের দেখা যাচ্ছে।মায়ানমার থেকে যেসব রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে তারাও মৃত্যু ভয় পায়। তাদের চোখে মুখে বেঁচে থাকার এক তীব্র আকুতি লেগে থাকে। এমনকি তাদের লাশগুলোতেও। আচ্ছা আং সান সুচি কি মৃত্যু ভয় পায়? মতিন তাদের নিয়ে ভাবে। ভাবতে ভাবতে বিষণ্ণ হয়। বিষণ্ণ হলেই সে মিথির কথা ভাবে। মিথির কথা ভাবলে সে শিহরিত হয়। মিথি অনেকটা ড্রাগের মত। যার সাথে কথা বললে, যার কথা ভাবলে মতিনের কেমন যেন একটা নেশার মত হয়।
নতুন কোন কবিতা লিখেছ? মিথি সিগারেটে লম্বা করে টান দিচ্ছে। তারপর ধোঁয়ার রিং বানাচ্ছে। হ্যাঁ লিখেছি। জবাব দেয় মতিন। তারপর পড়ে শোনায়,
আমি জেগে থাকি, ঘুমিয়েও থাকি
আবার জেগে উঠি তোমাদের ভীরে
যদিও এখন একা, এক রুমে
সোফার উপর বসে আছি চোখ মেলে
বৃষ্টি দেখি বৃষ্টি সকালে ঘুম ঘুম চোখে।
একদিন মুছে যাবে সব, একদিন মানুষ হারাবে.........
এডগার অ্যালান পো পড়েছ? মতিনকে থামিয়ে দেয় মিথি। মতিনের মন খারাপ হয়। তার কবিতাকে গুরুত্ব দেয়নি মিথি। কখনো দেয়না। নাম শুনেছি। তবে পড়িনি। মতিন জবাব দেয়।
এডগার অ্যালান পো এক রহস্যময় চরিত্র। তার কবিতা কিংবা গল্প পড়লে পাঠককে কিছুক্ষনের জন্য অন্য কোন ভুবনে প্রবেশ করতে হয়! আমিও করি। মিথি আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। তারপর সে বলে যেতে থাকে, “ A Valentin” নামক একটা বিখ্যাত কবিতা আছে পোর। এটাকে কবিতা না বলে আসলে ধাঁধা বলাই ভালো। এই কবিতায় একজনের নাম আছে। তার প্রেমিকার নাম। সে নামটাকে কবিতা দিয়ে খুব চমৎকার ভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এবং কিভাবে সে নামটা খুঁজে পেতে হবে সেটাই কবিতায় বলা আছে! এবার কবিতাটি শোন,
'For her this rhyme is penned, whose luminous eyes,
Brightly expressive as the twins of Leda,
Shall find her own sweet name, that nestling lies
Upon the page, enwrapped from every reader.
Search narrowly the lines! - they hold a treasure
Divine - a talisman - an amulet
That must be worn at heart. Search well in the measure -
The words - the syllables! Do not forget
The trivialest point, or you may lose your labor
And yet there is in this no Gordian knot
Which one might not undo without a sabre,
If one could merely comprehend the plot.
Enwritten upon the leaf where now are peering
Eyes scintillating soul, there lie perdus
Three eloquent words oft uttered in the hearing
Of poets, by poets - as the name is a poet's, too,
Its letters, although naturally lying
Like the knight Pinto - Mendez Ferdinando -
Still form a synonym for Truth - Cease trying!
You will not read the riddle, though you do the best you can do.'
এখন যদি পোর গোপন প্রেমিকার নাম জানতে চাও তবে প্রথম লাইন থেকে প্রথম অক্ষর, দ্বিতীয় লাইন থেকে দ্বিতীয় অক্ষর- এভাবে বিশ লাইন থেকে বিশটা অক্ষর কালেক্ট কর!তারপর সবগুলো অক্ষর একটার পর একটা বসালে একটা নাম পাবে। নামটা হচ্ছে Frances Sargent Osgood! তিনি একজন আমেরিকান কবি!
মিথির চোখে মুখে মুগ্ধতা। সে মুগ্ধতার কারন মতিন না। মুগ্ধতার কারন এডগার অ্যালান পো।
২
বারে বসে আছে আলিম। যদিও আজ মদ পান করতে আসেনি সে। একজনের সাথে দেখা করতে এসেছে। তার মুখোমুখি বসে আছে মিথি। মিথির দিকে তাকাতে তার ভয় হচ্ছে। সে মিথিকে ভয় পায়। কারন জীবনে কখনো সে কাউকে ভালোবাসেনি। কারো জন্য তার কখনো মায়া হয়নি। মিথি, আযম খানের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই আলিম তাকে চিনে। আযম যখন মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী ছিল, আলিম তখন গরিবের বাচ্চা ছিল। আলিমকে মাঝেমাঝেই চড় থাপ্পর দিতেন আযম। আলিমের ঠোঁট দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরত আর চোখ দিয়ে অশ্রু। আলিম কাঁদত। অনেক কাঁদত। কিন্তু চিৎকার করত না। এখন আযম অনেক বড় মাপের ব্যবসায়ী। আর আলিম এ শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী।তবে এখন আযমের চাইতে আলিমের ক্ষমতা বেশী। ক্ষমতাসীন দলের ছাতা ধরা আছে তার মাথার উপর।
মিথি রহস্যময়ি মেয়ে। অনেকেই মনে করে এ মেয়ের কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আবার কেউ কেউ ভাবে এ মেয়ের মাথায় গণ্ডগোল আছে। যাইহোক, আলিম মিথির প্রেমে পড়েছে। গভীর প্রেম। সে মিথিকে ইমপ্রেস করতে চায়। কিন্তু কিভাবে করবে কিছু ভেবে পায়না। আজ সে সুযোগ পাওয়া গেছে।
মিথি খুব ঠাণ্ডা গলায় আলিমকে সব বুঝিয়ে বলে। সব শোনার পর আলিম কেমন যেন শিহরিত হয়। মেয়েটা ভয়ংকর। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ভয়ংকর মেয়েটাকে আলিম ভালোবাসে।
৩
মতিন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। কিন্তু খুব দ্রুত ঘোর কেটে যাচ্ছে। সে ভয় পেয়েছে। প্রবল ভয় তার শিরায় শিরায় নেচে বেড়াচ্ছে। তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে একটা চেয়ারে বসিয়ে।তার শরীরে কোন পোশাক নেই। তার মাথার সব চুল কামিয়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি ভুরুও। সে যে ঘরে বসে আছে সেখানে কয়েকজন মানুষ আছে। এবং তার মুখোমুখি বসে আছে মিথি।তোমাকে নিয়ে আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। আমি আসলে একজনকে ইমপ্রেস করতে চাচ্ছি। আমি যাকে ইমপ্রেস করতে চাচ্ছি তার নাম কালো যাদুকর। তার বেশ কিছু বই তুমিও পড়েছ। আমি মানুষটাকে পাগলের মত ভালোবাসি। মিথির মুখে হাসি লেগে আছে। মতিনের চোখে জল। সে কাঁদছে। আলিম তাকিয়ে আছে মিথির দিকে। তার চোখে বিস্ময়, ঈর্ষা এবং ভয়।
মতিনকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে দিশেহারার মত হাঁটছে। তার শরীরে কোন পোশাক নেই। তার বুকে কবিতার চারটা লাইন লিখা আছে লাল রঙ দিয়ে।
৪
আমার গল্পে একজন চরিত্র ছিল। বেশ কিছুদিন হল তাকে খুঁজে পাচ্ছিনা। সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়েছে।অথবা সে আত্মহত্যা করেছে। সে আমার কাছে একজন সঙ্গির আবদার করেছিল। যদিও আমি তাকে একাই রেখেছিলাম। তার নিঃসঙ্গতা আমার গল্পকে অর্থবহ করে তুলছিল। সে আক্ষরিক অর্থেই আমার গল্পের প্রয়োজনে একজন বলির পাঁঠা ছিল। তবে তাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। তারপর মনে হলো তোমাকে তার প্রেমিকা বানিয়ে দেই। দেখি কি হয়। আজ তার একটা ফলাফল পাওয়া গেল। কালো যাদুকরের চেহারাটা মায়াবী। খুব নরম গলায় কথা বলেন তিনি।
শয়তান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঈশ্বরের দিকে। কালো যাদুকর চোখ মেলে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল আমার একটা কালো গোলাপ দরকার। কোথায় পাব?
মিথি কালো যাদুকরের খুব কাছে চলে আসে। কালো যাদুকর মিথির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। ততক্ষনে সূর্যও ডুবে গেছে।
ছু মন্তর ছু.............
হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে আলিম। সিগারেট ধরাবে কিনা ভাবছে। তার কিছুটা অস্থির লাগছে। আগে কখনও মানুষ হত্যা করার আগে তার এমন লাগেনি। বরং মানুষ হত্যা মানেই অনেক টাকা। অনেক টাকা মানেই কিছুদিনের জন্য মদ এবং নারীর উষ্ণতায় ডুব দেওয়া। যতবার আলিম মানুষ হত্যা করেছে ততবার সে নারী এবং মদের ভাবনায় শিহরিত হয়েছে। কিন্তু এবার আলিমের কেমন যেন ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কাজটা সেরে ফেলে চলে যেতে পারলেই সে বেঁচে যায়। তার পায়ের কাছে একটা কুকুর বসে আছে। আলিমের ইচ্ছে করছে কুকুরটাকে লাথি দিতে। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে তার। কিছুক্ষন পর একটা মানুষকে হত্যা করবে সে। এই প্রথমবার সে টাকার জন্য কাউকে হত্যা করছেনা। এই প্রথমবার সে ভালোবাসার জন্য হত্যা করবে। প্রথম সব কাজেই অবশ্য কিছুটা নার্ভাসনেস কাজ করে!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৬