somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিমু, এবং হিমু........

১৭ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজকে অনলাইনে মুরাদুল ইসলামের হিমুর মনস্তত্ত্ব নামক এক প্রবন্ধ পড়লাম। পড়ে ভালোই লেগেছে। তারপর মনে হলো হিমু নিয়ে হালকা পাতলা কিছু লিখে ফেলা যায়! বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র হিমু। মাঝেমাঝে মনে হয় স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে সৃষ্টি হিমু অনেক বেশী জনপ্রিয়। তবে এটা বলতেই হবে যে হুমায়ূন আহমেদ খুব দক্ষতার সাথেই হিমুর মত একটা ক্যারিশমাটিক চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এ চরিত্রটার যে সাইকোলজিক্যাল স্পেস তার মাঝে প্রবল আকর্ষণেই পাঠকরা ঘুরপাক খায়। নিজের ভেতর হিমুকে ধারন করার বা নিজেই হিমু চরিত্রে রুপান্তরিত হয়ে যাওয়ার বাসনা বা চেষ্টাও কারো কারো মাঝে দেখা গেছে। এখন এই হিমু চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট কোন মতামত দেওয়া সম্ভব না। এই চরিত্রের সাথে মিশে আছে লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেতন এবং অবচেতন মন। তার উদ্দেশ্য। যা আমাদের পক্ষে যথাযথ ভাবে বলে দেওয়া সম্ভব না। তবে হিমুর বইগুলোর আলোকে তাকে নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।

হিমুর মাঝে আধ্যাত্মিক সাধনার কোন ব্যাপার আছে কিনা তা বুঝতে হলে তার বাবার তার প্রতি যে উপদেশগুলো আছে সেসব পড়ে দেখা যেতে পারে। বিভিন্ন বইয়ে হিমুর বাবার ছেলের প্রতি যে নির্দেশগুলো আমরা দেখি তার মাঝে একটা নির্দিষ্ট স্পিরিচ্যুয়াল দর্শনের প্রভাব আছে। কিছু রেফারেন্স দেওয়া যাক। ময়ূরাক্ষী উপন্যাসে হিমুর বাবার বানী থেকে পাওয়া যায়,

"পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ এবং মহাজ্ঞানীরা এই জগতকে মায়া বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র চিন্তা ও ক্ষুদ্র বিবেচনায় দেখিয়াছি আসলেই মায়া। স্বামী ও স্ত্রীর প্রেম যেমন মায়া বই কিছুই নয়, ভ্রাতা ও ভগ্নির স্নেহ-সম্পর্কও তাই। যে কারনে স্বার্থে আঘাত লাগিবামাত্র স্বামী-স্ত্রীর প্রেম বা ভ্রাতা-ভগ্নির ভালোবাসা কর্পূরের মত উড়িয়া যায়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হইতে হবে।কোন কিছুর প্রতিই তুমি যেমন আগ্রহ বোধ করিবে না আবার অনাগ্রহও বোধ করিবে না। মায়ার মানুষ দাস। সেই দাসত্ব-শৃঙ্খল তোমাকে ভাঙ্গিতে হইবে। মানুষের অসাধ্য কিছুই নাই। চেষ্টা করিলে তুমি তা পারিবে। তোমার ভিতরে সেই ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বিকাশের চেষ্টা আমি তোমায় শৈশবেই করিয়াছি। একই সঙ্গে তোমাকে আদর এবং অনাদর করা হইয়াছে। মাতার প্রবল ভালোবাসা হইতেও তুমি বঞ্চিত হইয়াছ। এই সমস্তই একটা বড় পরীক্ষার অংশ। এই পরীক্ষায় সফলকাম হইতে পারিলে প্রমান হইবে যে, ইচ্ছা করিলে মহাপুরুষদের এই পৃথিবীতে তৈরি করা যায়।"

সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান বিষয়ে বলা হয়েছে,
"সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান করিবে। ইহাতে আত্মার উন্নতি হইবে। সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং আত্মাকে জানা একই ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিও-
বহুরূপে সম্মুখে তোমার
ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?"


ভয় বিষয়ক উপদেশ থেকে পাই,

“ একজন মানুষ তার এক জীবনে অসংখ্যবার তীব্র ভয়ের মুখোমুখি হয়।তুমিও হইবে। ইহাই স্বাভাবিক। ভয়কে পাশ কাটাইয়া যাইবার প্রবণতাও স্বাভাবিক প্রবনতা।তুমি অবশ্যই তা করিবেনা। ভয় পাশ কাটাইবার বিষয় নহে। ভয় অনুসন্ধানের বিষয়। ঠিকমত এই অনুসন্ধান করিতে পারিলে জগতের অনেক অজানা রহস্য সম্পর্কে অবগত হইবে। তোমার জন্য ইহার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তোমাকে বলিয়া রাখি, এই জগতের রহস্য পেয়াজের খোসার মতো। একটি খোসা ছাড়াইয়া দেখিবে আরেকটি খোসা।এমনভাবে চলিতে থাকিবে-সবশেষে দেখিবে কিছুই নাই।আমরা শূন্য হইতে আসিয়াছি, আবার শূন্যে ফিরিয়া যাইব। দুই শুন্যের মধ্যবর্তী স্থানে আমরা বাস করি। ভয় বাস করে দুই শুন্যে। এর বেশি এই মুহূর্তে তোমাকে বলিতে ইচ্ছা করি না।"

হিমুর বাবার বানীগুলো একটু ভালো করে পড়লেই বুঝা যাবে এসব বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের কিছু দার্শনিক ডিসকোর্সকে ফলো করে। জেন মতবাদ,(zen) এবং তাওইজমের (Taoism) প্রভাবও আছে এসব বানীতে। এখন উপন্যাসে হিমুর বাবাকে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি তিনি একজন সাইকোপ্যাথ। এবং হিমুর মুখ থেকেই আমরা এমনটা শুনতে পাই।আবার আমরা দেখি হিমু তার বাবার নির্দেশ গুলো মেনে চলার চেষ্টা করছে। হিমু ভক্ত বাদলের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি হিমু হচ্ছে বুদ্ধ এবং রাসপুটিনেরআদলে গড়ে ওঠা এক মানুষ। বুদ্ধের মত নির্লিপ্ততার ব্যাপার আছে তার মাঝে, আবার রাসপুটিনের মত ভবিষ্যৎ বানীও সে করতে পারে। কিন্তু এসব আধ্যাত্মিক ডিসকোর্সের বাইরেও আমরা অন্যরকম হিমুকেও দেখতে পাই বিভিন্ন উপন্যাসে!

হিমুর প্রায় সব উপন্যাসেই দেখা যায় সে অসহায় নির্যাতিত মানুষকে কোন না কোন ভাবে সহায়তা করছে। আবার শোষক বা নির্যাতনকারী বা অপরাধী কেউ তার প্রতিপক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। যার সাথে হিমুর একধরনের সাইকোলজিক্যাল গেম শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। এখানে এসে আমরা হিমুর চরিত্রে একটা চিরায়ত মানবিক ব্যাপার দেখতে পাই। আবার ত্রাণকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার একটা সুক্ষ পলিটিক্যাল মারপ্যাঁচও আছে। খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখব হিমু আসলে নির্লিপ্ত না। সে প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভালো খারাপ জাজ করে কাজ করছে। কিছু চরিত্রকে সে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাদের প্রটেক্ট করার প্রয়োজনীয়তা সে ফিল করছে। এবং সেভাবেই আমরা হিমুকে কাজ করতে দেখি। যে আধ্যাত্মিক ডগমা দিয়ে তার বাবা তাকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিল সে ডগমাকেই সে ভেঙ্গে ফেলছে। এবং ভেঙ্গে ফেলার পরও সে মহাপুরুষই থাকছে। তার বাবাকে একই সাথে সে গুরু মানছে আবার তার সৃষ্টি করা ডগমাকেও অগ্রাহ্য করছে। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। হিমুর কাজ এন্টি লজিক নিয়ে।কিন্তু আমরা বারবার দেখেছি সে বিভিন্ন কিছুকে জাজ করছে। তার বাবাকে, তার চারপাশের চরিত্রকে, নিজেকে। এবং এসব জাজমেন্টে প্রবল ভাবেই লজিক চলে আসছে। লজিক থেকে কনসাসনেসের জন্ম হচ্ছে। সেসব কনসাসনেস থেকেই উপন্যাসের পর উপন্যাসে হিমু নামক এক চরিত্র বিবর্তিত হতে থাকে।

হিমু নিজেও তার বাবার মত মানসিক ভাবে অসুস্থ কিনা এটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু এ প্রশ্নটাকে লেখক খুব সযতনে এভয়েড করে গেছেন। তবে একটি উপন্যাসে আমরা দেখি হিমুকে তার এন্টি চরিত্র মিসির আলীর সাথে দেখা করিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সম্ভবত লেখক নিজেই সংশয়ে ছিলেন কি করবেন। তাই এ প্রশ্নের উত্তর তিনি অমীমাংসিতই রেখে গেছেন।

হিমুর কিছু কিছু উপন্যাস পড়লে হিমুকে নিছক প্রেমের উপন্যাসও মনে হতে পারে। রুপাসহ অনেক মেয়েই প্রবলভাবে হিমুর প্রেমে পরে। কিন্তু হিমু শেষ পর্যন্ত তাদের ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে। এই অগ্রাহ্য করার মধ্যে একটা তথাকথিত বিশুদ্ধতার ব্যাপার আছে। যেখানে মনে করা হয় যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্ক মানেই অপবিত্র কিছু। যা মানুষকে বাঁধনে জড়িয়ে ফেলে। স্পিরিচুয়াল মুক্তি বা মোক্ষলাভের ক্ষেত্রে যৌনতাকে এভয়েড করার প্রাচীন আধ্যাত্মিক মতবাদ এক্ষেত্রে হিমুর মাঝে খুব প্রবলভাবেই কাজ করে। তবে হিমু কি শেষ পর্যন্ত তার কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারে? নাকি তার এই মুক্ত হওয়ার মনস্তাত্ত্বিক লড়াই নিয়েই লেখক একের পর এক উপন্যাস লিখে গেছেন তাকে নিয়ে। লেখক নিজেই হিমুকে মুক্তি দিতে চান নাই হয়তো। তিনি বেঁচে থাকলে এ প্রশ্নের একটা উত্তর হয়তো পাওয়া যেত।

হিমুকে নিয়ে আরো অনেকভাবেই, অনেক দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করা যায়। তবে আপাতত আর লিখতে ইচ্ছে করছেনা। তাই এখানেই অফ গেলাম।



সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:৪৬
৪৬টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×