১
সব মানুষের মধ্যেই গোয়েন্দা হওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা কাজ করে। আসলে সব মানুষের মধ্যেই একজন গোয়েন্দা বাস করে। সত্য জানার আগ্রহ থেকেই মানুষ চাঁদের বুকে পা রেখেছিল। আবার এক অদম্য কৌতহল থেকেই অনেকে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে এভারেস্টের চুড়ায় দাঁড়িয়ে অসম্ভবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। ভাবছেন এসবের সাথে গোয়েন্দাগিরির কি সম্পর্ক? সম্পর্ক একটা অবশ্যই আছে। সম্পর্কটা হচ্ছে সত্য জানার আকাঙ্ক্ষা এবং নিজের মেধা এবং শ্রম দিয়ে সে চেষ্টাটা করে যাওয়া। হোকনা সেটা বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কার কিংবা সিরিয়াল কিলার খুঁজে বের করা! সব ধরনের গবেষণাই আসলে এক ধরনের গোয়েন্দাগিরি!
গোয়েন্দা শব্দটা শুনলেই খুব দ্রুত কিছু নাম আমাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ফেলুদা, শার্লোক হোমস সহ এমন আরো কিছু জনপ্রিয় চরিত্রের নাম। তারা সব সময় আমাদের কাছে আদর্শ গোয়েন্দা! তাদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা আমাদের প্রভাবিত করে। যেমন সত্য অনুসন্ধানে তাদের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি! তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের কাছে পৌঁছানো। তারা কোন রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় ভাবাদর্শে বিশ্বাসী নয়। তাই কোন নির্দিষ্ট মতবাদের আলোকে তারা সত্যের অনুসন্ধান করেনা। যে কোন ঘটনার পেছনের আসল কারনগুলো খুঁজে বের করাই তাদের নেশা। তাই তাদের সত্যান্বেষী বলা হয়ে থাকে।
সিআইএ, মোসাদ, কেজিবি এসব গোয়েন্দা সংস্থার সাথে হলিউডের কল্যাণে আমরা খুব ভালো ভাবেই পরিচিত। এসব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সত্য নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। এগুলোর কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ দেখা। অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনদের জন্য হুমকি এমন ব্যাপারগুলো খুঁজে বের করাই এসব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজ। যেমন কোল্ড ওয়ারের সময় সিআইএ এবং কেজিবির লড়াইটা ছিল দুটো মতবাদকে এবং ক্ষমতার বলয়কে কেন্দ্র করে। এসব সংস্থাগুলোর গোয়েন্দারা কিছু সুনির্দিষ্ট কারনে তাদের অনুসন্ধান চালায়। সব দেশেই এমন গোয়েন্দা সংস্থা আছে। আমাদের দেশেও আছে। তাদের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার উপর রাষ্ট্রের অনেক কিছুই নির্ভর করে।
তবে আধুনিক বিশ্বে গোয়েন্দাগিরি করে গনমানুষের কাছে যারা বিভিন্ন তথ্য পোঁছে দেন তারা হচ্ছেন সাংবাদিক। আমরা মুলত তাদের মাধ্যমেই দেশ বিদেশের বিভিন্ন খবর পেয়ে থাকি। অনেকভাবেই আমরা সাংবাদিকদের উপর নির্ভরশীল। তাই স্বভাবতই এই নির্ভরশীলতাকে কিংবা প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে অনেক গোষ্ঠী খুব সহজেই নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে ফেলতে পারে। প্রিন্টিং এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে খুব দ্রুত প্রোপাগান্ডা ছড়ানো যায়। যেহেতু সাংবাদিকরা লিজেন্ডারী গোয়েন্দাদের মত নির্মোহ ভাবে সত্যের অনুসন্ধান করেনা এবং তাদের কাজের সাথে যেহেতু অর্থনৈতিক যোগসূত্র রয়েছে তাই তাদেরকেও রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো খুব সহজে কাজে লাগাতে পারে।
২
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা সবাই এক এক জন অ্যামেচার সাংবাদিকে পরিনত হয়ে গেছি। আমরা ঘরে বসেই এখন গোয়েন্দাগিরি করে যে কোন তথ্য গনমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। তবে বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ব্যাপারগুলো আর ফান করার মত পর্যায়ে নেই। কিছু প্রচণ্ড রকমের ধূর্ত মানুষ খুব সুকৌশলে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা অনলাইনে কাল্পনিক তথ্য দিয়ে খুব দ্রুত মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারছে। গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার দিকে আলোকপাত করলেই ব্যাপারগুলো বুঝে ফেলা যাবে!
হেফাজতের সেই সমাবেশের সময় খুব দ্রুত একটা সংবাদ ছড়িয়ে যায় যে হাজার হাজার মানুষকে সেখানে মেরে ফেলা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এসে সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। হেফাজতের প্রতি যাদের সিমপ্যাথি ছিল তারা খুব সহজেই সেসব বিশ্বাস করে ফেলল। আমি তখন মিরপুর ছিলাম। চা স্টলে শুনলাম মানুষ সেসব গল্প করছে। সবার তথ্যসুত্র ফেসবুক এবং কিছু অনলাইন পোর্টাল। তারা আসলে এমনটা বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত ছিল। একটা গোষ্ঠী সেটা খুব সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে।
গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল সময়ে একবার একটা কাজে শাহবাগ থেকে ধানমণ্ডি গেলাম। সেখানে গিয়ে একজনের কাছে শুনলাম হাকিম চত্বরে নাকি একের পর এক গনধর্ষণ হচ্ছে। আমি বললাম ভাই আমি কিছুক্ষন আগে হাকিম চত্বরে আড্ডা দিয়ে আসলাম। তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন তিনি কিছুক্ষন আগে ফেসবুকে দেখেছেন! সেটাই সত্য। আমি যেহেতু রাজাকারের ফাঁসি চাই আমি আওয়ামীলীগের দালাল এবং ভারতের দালাল! তাই হাকিম চত্বরে আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম! তবে দেশের বাইরে এবং ঢাকার বাইরে বসেও অনেকে দিব্য চোখে দেখতে পেয়েছেন যে শাহবাগে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা হচ্ছে!
গুলশানে যে রাতে জঙ্গি হামলা হলো- সে রাতে একের পর এক খবর ফেসবুকে আসতে থাকে। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো নানা কল্পনার রঙ্গে কাহিনী সাজাতে থাকে। যেমন এক যায়গায় দেখলাম গুলশানে যারা অ্যাটাক করেছে তারা আসলে জঙ্গিনা, তারা সবাই ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর লোক! তারপর শুরু হলো ফারাজকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা। তবে সে সময় কিছু আসল গোয়েন্দার মত কাজও হয়েছে। যেমন ভিডিও বিশ্লেষণ করে হাসনাতের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বিশ্লেষণ করা। তবে একটা পক্ষ বরাবরের মতই পরিকল্পিত ভাবে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। আপনাদের আশে পাশে খবর নিয়ে দেখুন। দেখবেন অনেকেই গুলশানের জঙ্গি হামলাকে ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর কাজ বলে মনে করে!
এমন অনেক উদাহরনই দেয়া যায়। প্রতিদিন অনলাইনে পরিকল্পিত ভাবে মিথ্যা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে গোষ্ঠীর প্রতি যাদের সিমপ্যাথি আছে তারা খুব সহজেই এসব বিশ্বাস করে ফেলছে।
ফেবুতে এ কাজটা সাধারনত করে থাকে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কিছু সেলিব্রেটি। তারা একদল মানুষের আবেগ এবং অসচেতনাতাকে পুঁজি করে সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে কিংবা কাল্পনিক ফ্যাক্ট দিয়ে খুব সুকৌশলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
৩
অনেকেই না জেনেই আবার এসবের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন। যেমন সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আনিসুল হক সাহেবকে অনেকেই পছন্দ করেন না। মতবাদিক বিতর্ক থাকতেই পারে। তিনি ফারাজকে নিয়ে একটা লেখা লিখেন। তার পরের দিন একটা নিউজ পোর্টাল ফারাজকে জঙ্গি প্রমান করে নিউজ করে। অনলাইনে ব্যাপারটা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। যারা তীব্র ভাবে প্রথম আলো বিরোধী তারা কোন কিছু না ভেবেই সংবাদটি প্রচার করতে থাকেন। এখানে যেটা কাজ করেছে সেটা হচ্ছে ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষোভ। আমাদের এসব ক্ষোভকে কিংবা কোন গোষ্ঠীর প্রতি দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ অনলাইনে আমাদের নিয়ে খেলছে।
এটা সত্য যে অনলাইনে আমাদের সবার গোয়েন্দা হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা চাইলে সাংবাদিকদের মত গোয়েন্দাগিরি করে গনমানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে পারি। অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পারি। চমৎকার কোন বিশ্লেষণ করে নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারি। তবে যেমনটা আমরা ফেলুদা কিংবা হোমসের গল্পে পড়েছি যে গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার জন্য একটা গোষ্ঠী সবসময় তৎপর থাকে, তেমনটা আমাদের এই অনলাইন জগতেও আছে। তারা আমাদের অনুসন্ধানের পথকে দিকভ্রষ্ট করতে চায়। তবে আমাদের সচেতনাতা, সত্য জানার কৌতুহল, নির্মোহ ভাবে অনুসন্ধানের দৃষ্টিভঙ্গিই পারে জ্ঞানপাপীদের কফিনে শেষ পেরেকটা মেরে দিতে।
তাই গোয়েন্দা হতে চাইলে আসেন আসল গোয়েন্দা হই। লোক দেখানো গোয়েন্দা হয়ে নিজেকেই নিজে প্রতারিত করার মধ্যে মজা নাই! আসল মজা উপভোগ করার জন্য নির্মোহ ভাবে সত্যের অনুসন্ধান করা শুরু করা যেতে পারে। হোক সেটা মহাকাশে কি আছে সেটার অনুসন্ধান কিংবা খাটের নীচে কি আছে সেটার অনুসন্ধান! ক্ষেত্রবিশেষে দুটোই গুরুত্বপূর্ণ!
শুধু মনে রাখতে হবে একজন ভালো গোয়েন্দা প্রমানে বিশ্বাসী, যুক্তিতে পারদর্শী এবং শোনা কথায় কান দেয়না!
কয়েকজনের সাথে আলোচনা করতে গিয়েই এ পোস্ট লিখে ফেললাম। তাই সেই কয়েকজনকে ধন্যবাদ। কারন তারা আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৫