বেশ কিছুক্ষন ধরে ছেলেটি বসে আছে কোনার দিকের সোফাটায়। কিছু
একটা বলবে বলবে করেও কেন জানি বলতে পারছে না।
অপলা একদৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে। এই
অফিসে অপলা রিসিপসোনিস্টের কাজ করে। এ ধরনের কাজে প্রতি নিয়ত
বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, তাদের বিভিন্ন কথা হজম
করতে হয়। ব্যাপারটি প্রথম দিকে সামান্য গোলমেলে ঠেকলেও এখন
অপলা ভীষন উপভোগই করে বলা যায়।
ছেলেটিকে এর আগেও অফিসে আসা যাওয়া করতে দেখেছে। হ্যাঁ,
মনে পরেছে, জেসন গ্রুপে আছে সে। অপলাদের অফিসের লজিস্টিক
সাপোর্ট আসে জেসন গ্রুপ থেকে। আইটি' ' র কি একটা কাজ নিয়ে যেন
ছেলেটিকে প্রায়শই আসতে হয়।
মুহিরের খুব অস্থির লাগছে। রিসিপসনের মেয়েটা আজ অমন এক
পলকে তাকিয়ে আছে কেন? একি, মেয়েটা তো এদিকেই আসছে দেখি।
- চা খাবেন?
- খেয়েছি এক কাপ, থ্যাংকস। স্যার কখন আসবেন?
- আজ মনে হয় আসতে একটু দেরি হবে। স্যারের মা এসেছেন তো তাই।
আপনার কি আর্জেন্ট কোন কাজ আছে?
-জি, একটা বিল অনেক দিন ধরে আটকে আছে, ঈদের মৌসুমতো তাই
টাকাটি খুব দরকার, কর্মচারীদের বেতন বোনাস দিতে হবে।
- স্যার আসলেই আমি আপনাকে আগেভাগে দেখা করার
ব্যবস্থা করে দিবো, আপনি টেনশন করবেন না।
- থ্যাংকস, আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
- বলুন।
- আপনি সেই সবুজ শাড়িটি আর পরেন না কেন?
- মানে? আপনারতো সাহস কম না মুহিত সাহেব, পারসোনাল ব্যাপার
নিয়ে কথা বলছেন। মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় শিখেননি?
- আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? এতে রাগার কিছু আছে বলে মনে হয় না।
চলুন এক কাপ চা খেয়ে আসি।
- আপনার কাছ থেকে এই ধরনের কথা শুনে আমি আপনার সাথে অফিস
ফাঁকি দিয়ে চা খেতে যাবো ভাবলেন কি করে?
- অফিসে আরো লোকজন আছে, একটু চা খেতে বাইরে গেলে খুব
একটা ক্ষতি হবে না। আর আপনি বিনা কারনে আমার উপর রাগ
করে আছেন, চা খেতে খেতে আপনাকে পুরো ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলা আমার
কর্তব্য।
অপলা এক মূহুর্ত কি যেন ভাবলো, তারপর হন হন করে উঠে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, " এক ঘন্টার বেশি সময়
আমি দিতে পারবো না, চলুন "।
দুপুরবেলা এই দিকের রেস্টুরেন্টগুলো বেশ ফাঁকা থাকে। মুহিত অপলার
সামনে বসলেও কথা বলছে চোখ নামিয়ে।
- আপনি কি জানেন, সবুজ
শাড়ি পরলে আপনাকে কতো বেশি ভালো লাগে?
- না, আমি জানি না, জানার আগ্রহও নেই। ভরদুপুরে আপনি এসব
সস্তা প্রেমের ডায়লগ শুনাতে এখানে নিয়ে এসেছেন?
- আপনি শান্ত হোন অপলা।
প্রথম যেদিন আমি আপনাদের অফিসে আসি,সেদিন আপনি সবুজ
একটি শাড়ি পরেছিলেন। আমি সে দিনের কথা আজো ভুলিনি। তার পর
বেশ কিছুদিন আমি এসেছি আপনাদের অফিসে, কিন্তু সবুজ
শাড়িতে আপনাকে আর দেখি নি। মাঝে মাঝে মনে হতো, আপনাকে বলি,
কিন্তু আপনি কি ভাববেন ভেবে বলি নি। আজ বলেই দিলাম।
- হুম।
- আমি আমার চাচাদের কাছে মানুষ হয়েছি। ছোট বেলায়
আমি বাবাকে হারাই। বাবার মৃত্যুর সময় আমার মায়ের বয়স ছিল
একেবারেই কম। বেশ অভাব অনটনে সংসার চলতো। আমার সব কিছু
মনেও নেই ভালো করে, শুধু মনে আছে সেই দিনের কথা, যেদিন মা খুব
সুন্দর করে সেজে আমার সামনে এসেছিলো, আমাকে অনেক আদর
করে অনেক উপদেশ দিচ্ছিল, কেন দিচ্ছিল সেদিন বুঝি নি।
মা বলেছিলো, "আমার উপর কোন রাগ রাখিস না বাবা,
পারলে আমাকে মাফ করে দিস। বহুবছর পর যখন আমার কথা তোর
মনে হবে, তখন তোর চোখের সামনে আমার ছবিটা যেন সুন্দর
করে ভেসে ওঠে তাই আজ সাজলাম " । সেদিনের পর আমি আর আমার
মাকে দেখতে পাই নি। চার পাঁচ বছরের ছেলেটির চোখে মা শুধু ছবি হয়েই
বেঁচে রইলো।
জানেন অপলা, আমি কেন আপনাকে বারবার সবুজ শাড়ির কথা বলি?
আমার মায়ের পরনে সেদিন ছিলো সবুজ শাড়ি।
জীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাতে আজ আমি একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি।
আজো যখন আমি সবুজ শাড়ি পরা কাওকে দেখি, আমার মায়ের
কথা মনে হয়। আমার চোখে এখন যে শুধু মায়ের সেই সবুজ
শাড়িটি রয়ে গিয়েছে।
প্রতি ঈদে আমি মায়ের জন্য একটি করে শাড়ি কিনি সবুজ রঙের, কিন্তু
মাকে দিতে পারি না।
অপলা ভীষন শক্ত করে ধরে আছে মুহিতের হাত। কিন্তু
পারছে না নিজেকে ধরে রাখতে। দু'চোখ বেয়ে অবিরত পানি ঝরছে। মুহিত
অবাক হয়ে দেখছে, ইস্পাত কঠিন হৃদয়ের এক মানবী মাঝদুপুরে কি অসীম
মমতায় তার হাত ধরে আছে। নিজেকে ভারমুক্ত মনে হচ্ছে আজ, মুক্ত
বিহঙ্গ, সুদূদের কোন এক গাংচিল যেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩