আমার বাসা ঢাকা মেডিকেলের কাছে হওয়াতে সবসময়ই বিভিন্ন মানুষ ফোন দেয় তাদের রুগী আসছে একটু যাওয়ার জন্য। আমিও কখনো কাউকে না বলি নাই। ঢাকা মেডিকেলের সব কিছু সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা আছে, যার ফলে চিকিৎসার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারতাম, কারো রক্ত লাগলে ম্যানেজ করে দিতাম। অনেক সময় রুগীর আত্মীয় স্বজন কেউ না থাকলে নিজেই এটেনডেন্ট হিসাবে থাকতাম। ১৯ জুলাই, ২০২৪ বিকেল ৪টা একজনের প্রয়োজনে ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে যাই কিন্তু আজকে ইমারজেন্সির সামনের পরিস্থিতি অন্য দিনের মতো নয়। এ এক ভয়াবহ অবস্থা যা লিখে বুঝানো যাবে না। ইমারজেন্সির সামনে হাজারো মানুষ, কেউ ট্রলিতে লাশ নিয়ে দাড়িয়ে আছে, কেউ স্বজন হারানোর ফলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে। স্বেচ্ছাসেবীরা রক্ত দাতা ম্যানেজ করছে। কেউ স্যালাইন পানি যোগান দিচ্ছে, কোন কোন স্বেচ্ছাসেবীরা টাকা তুলছে।
রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা এম্বুলেন্স থেকে গুলি খাওয়া মানুষ নামাচ্ছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী রেড ক্রিসেন্টের সাথে আন্তরিক ভাবে কাজ করছে। এম্বুলেন্স ডুকলেই স্বেচ্ছাসেবী এবং আনসার মিলে মানুষের ভিড় ঠেলে দিয়ে এম্বুলেন্স ভিতরে ঢুকাচ্ছে, ১০-১৫ জন হিজলা গুলি খাওয়া এসব মানুষদের গাড়ি থেকে নামিয়ে ট্রলিতে উঠাচ্ছে, তারাও স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছে। কেউ আন্তরিকতার কমতি রাখছে না৷ হিজলা গুলোকে দেখলাম ২৪ ঘন্টাই কাজ করছে। খুবই অবাক হলাম ওদের ডেডিকেশন দেখে। এম্বুলেন্স রাখার জায়গাটা স্বেচ্ছায় রক্তদানের ক্যাম্প বসিয়েছে। মানুষ গনহারে রক্ত দান করছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা ব্যান্ডেজ আর সেলাই করতে করতে হয়রান, মেডিকেল কলেজের অনেক স্টুডেন্ট চলে আসছে, আজ কেউ দায়িত্ব অবহেলা করছে না। ডাক্তার, নার্স, আনসার, ওয়ার্ডবয়, মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট, ইন্টার্নি চিকিৎসক সবাই জীবনের সর্বোচ্চ দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। এই প্রথম বাংলাদেশে দেখলাম ডাক্তাররা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে গুলি খাওয়া এসব মানুষের সেবা করছে। সিনিয়র প্রফেসর সহ সকল ডাক্তার টানা ৩ রোস্টার ডিউটি করছে৷ তাদের খাওয়া, ঘুম নাই, মানুষের জিবন বাঁচানোই তাদের এখন চ্যালেঞ্জ। অনেক ডাক্তার মানুষের ভয়াবহ অবস্থা দেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে আর চিকিৎসা দিচ্ছে। ফ্লোর রক্তে চুপ চুপ করছে। মাথার মগজ বের হওয়া কিছু বেওয়ারিশ লাশ ফ্লোরে পড়ে আছে। মর্গে লাশের স্তুপ হয়ে গেছে। কারো ফুসফুসে গুলি লাগছে, কারো গুলি লেগে হার্ট ছিদ্র হয়ে গেছে। কারো চোখে গুলি ডুকে গেছে। কারো মাথায় গুলি লাগছে, কারো পায়ে, কারো পেটে। চোখের সামনে দেখতেছি গুলি খাওয়া মানুষ হা করে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে আর নীল হয়ে মরে যাচ্ছে। কেউ চটপট করতে করতে মরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা আরেক গাজা সিটি, চারদিকে হাহাকার অবস্থা। ঢাকা মেডিকেলে বিজিবি, পুলিশ মোতায়েন ছিলো, মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে তাদের আক্রমণ করে ফলে তারা গাড়িতে উঠে কোন মতো পলায়ন করে। প্রতি মিনিটেই এম্বুলেন্স, ভ্যান, রিক্সা, ট্রাক যে যেভাবে পারছে সেভাবেই গুলি খাওয়া আহত-নিহত মানুষ নিয়ে আসছে। যারা এসব আহত-নিহত মানুষদের নিয়ে আসছে তাদের সাথে কথা হয়। তাদের বর্ননা অনুযায়ী পুলিশ আজ কোন টিয়ার শেল, রাবার বুলেট মারছে না, শুধু সমানতালে গুলি করছে। উপর থেকে র্যাব হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করছে, নিচ থেকে পুলিশ গুলি করছে। পল্টন, নীলক্ষেত, বনশ্রী, ধানমন্ডি, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, বাড্ডা, পুরান ঢাকা এসব এলাকায় রাস্তায় অনেক লাশ পড়ে আছে। হাসপাতালে আনা এসব লাশের বেশির ভাগ স্বজনরাই জানেনা যে তার সন্তান/স্বামী/বাবা/ভাই মারা গেছে। রাতের ১ টা পর্যন্ত আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছি। সম্পূর্ণ টায়ার্ড হয়ে গেছি, আর শরীর কুলাচ্ছে না। রাতের ১ টা বাজে বাসায় চলে আসি। তখনো সমানতালে গুলি খাওয়া মানুষ আসছে। জানিনা আর কতক্ষণ এভাবে চলবে। মিটফোর্ড, মুগদা, সোহরাওয়ার্দী, কুয়েত মেত্রী সকল হাসপাতালে নাকি একই চিত্র। মিটফোর্ডে নাকি আরো ভয়াবহ অবস্থা। বাসায় আসার সময় শুনলাম সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাস্তাঘাট থমথমে অবস্থা। এম্বুলেন্স ছাড়া কোন গাড়ি চলাচল করছে না।
এমন পরিস্থিতিতেও হাসপাতালে কোন সাংবাদিক ছিলো না। ব্লগার, ইউটিউবাররা আসেনি কারন ইন্টারনেট নাই দ্বিতীয়ত শুক্রবার তাছাড়া রাস্তায় কোন গাড়ি নাই।
শুধু প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক দেখছিলাম। ৭১ টিভির একটা গাড়ি আসছে, ভাবলাম তাও একটা চ্যানেল আসছে। পরে দেখি ৭১ টিভির সাংবাদিক গুলি খেয়ে আসছে চিকিৎসা নিতে। সংবাদ সংগ্রহের জন্য আসে নাই।
একজন শাসক এতো হিংস্র ভাবে মানুষ মারবে এটা কেউ ধারনা করে নাই। অদ্ভুদ ব্যাপার হলো ঢাকা মেডিকেলের এই কেয়ামত পরিস্থিতি আশে পাশের গলির মানুষরা জানে না। মনে হবে সব স্বাভাবিক চলছে। কারন সরকার মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড লাইন বন্ধ করে রাখছে ফলে ফেসবুক, ইউটিউবও বন্ধ। টিভি চ্যানেল, রেডিও সহ সকল সংবাদমাধ্যম রেস্ট্রিকটেড করে এসব নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এ কেমন রাজনীতি! মানুষের ট্যাক্সের টাকায় বেতন দেওয়া এসব পুলিশ কিভাবে মানুষদের পাখির মতো গুলি করছে? আপনার কাছে চাকরির চেয়ে মানুষের জীবন নেওয়া বড় হয়ে গেলো? এভাবে গুলির অর্ডার থাকলে চাকরি ছেড়ে দেন। আমি হলে এসব চাকরিতে থুথু মেরে চলে আসতাম। আপনার সন্তানকে এভাবে গুলি করে মারলে আপনার কেমন লাগবে?
ছাত্রদের ছোট একটা দাবী কোটা সংস্কার। ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকার ফলে আপনার দম্ভ অহমিকা পাহাড় সম হয়ে গেছে। দাবী না মেনে গোয়ার্তমি করে ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা গালি দিয়ে কোটা সংস্কার করবেন না বল্লেন। অথচ দুইদিন পর সব দাবী মানা হয়েছে বলে আইনমন্ত্রী এবং শিক্ষা মন্ত্রীর মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন। এখন শুধু কোটা সংস্কার না পারলে আরো বেশি কিছু থাকলে সেটাও দিতে রাজি।
এখন ছাত্রদের সাথে স্বাক্ষাত করতে যেকোনো মূহুর্তে রাজি।
প্রশ্ন হলো একটা রাষ্ট্র নিয়ে, রাষ্ট্রের জনগণ নিয়ে আপনার এসব গোয়ার্তমি করার অধিকার আছে? প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা গ্রহণকালে শপথ পড়তে হয়— "অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন"
অথচ উনি নিজেই বলছেন ২০১৮ সালে রাগ করে সংসদে দাড়িয়ে কোটা বাতিল বলেছেন, মানে আপনি আইন ভঙ্গ করেছেন। সেই চিত্র আবার দেখালো গোয়ার্তমি করে ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা বলে।
এর আগেও দেখছি আপনার বক্তব্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব কান্ডজ্ঞান হীন। আপনি ড. ইউনুস, খালেদা জিয়া কে পদ্মা সেতু থেকে টুপ করে ফেলে দিতে বলেন। এটা কোন ভদ্র শাসকের ভাষা হতে পারে?
গতবছর (২০২৩) সংসদে দাড়িয়ে বল্লেন চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি কোথায় দুর্নীতি? প্রমান দেন। এখন বলছেন আমার পিওন দুর্নীতি করে ৪০০ কোটি টাকার মালিক। অথচ খালেদা জিয়ার ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ মামলার কারনে বিদেশে চিকিৎসা নিতে দিচ্ছেন না।
এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিচ্ছেন। আপনার প্রত্যেকটা এম পি, মন্ত্রীর গত ১৫ বছরের আমলনামা নেন। দেখেন কি পরিমাণ দুর্নীতি করছে এরা। বছরে ৭৮ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে এরাই। আমলাদের কথা আর কি বলবো? শত শত বেনজির আছে যারা দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে।
ইজরায়েল ফিলিস্তিনের উপর হামলা করার আগে ঘোষণা দেয় এবং জায়গা খালি করতে বলে। অথচ আপনি পূর্ব হুশিয়ারী বা কোনরূপ ঘোষণা ছাড়াই নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মারলেন। আমি ফেরাউন, নমরুদ, আবু জাহেলের ইতিহাস পড়ছি। কাউকেই এতো বর্বর শাসক হিসাবে দেখিনি।
আপনি পূর্বে ইশতেহার দিয়েছিলেন প্রতি ঘরে ঘরে চাকরি দিবেন। এখন চাকরির বদলে বুলেট দিচ্ছেন, বাহ্। বাংলাদেশে ৩ কোটি মানুষ বেকার করে রাখছেন, কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তো নাই, বরং দেশকে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত করে রাখছেন। ব্যাংক একটার পর একটা দেউলিয়া হচ্ছে, অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত করার কথা বলে পাবলিককে শান্ত রাখছেন। খাদ্য ভেজাল তীব্র আকার ধারন করছে, পরিবেশ দূষণে সারাবিশ্বে প্রথম দিকে বাংলাদেশ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে নাকাল মানুষ। মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহ ভাবে বাড়ছে। দেশের আইন, বিচার, শাসন কাঠামো সহ সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে, সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা উঠে গেছে। মানুষ এখন পারিবারিক সমস্যায়ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চায়।
ছাত্রলীগ একটা ছাত্র সংগঠন, এরা ছাত্রদের প্রিয় হবার কথা, ছাত্রদের নিয়ে কাজ করার কথা অথচ সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রলীগকে কুকুরের চাইতে বেশি ঘৃনা করে। ছাত্ররা দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগকে পিটিয়ে বের করে দিছে। আহ কি লজ্জা! ছাত্রলীগের শিক্ষা কখনোই হবে না। বিশ্বজিৎ হত্যার পরও এদের শিক্ষা হয়নি, আবরার হত্যার পরও হয়নি। এরা জানোয়ারের মতো আন্দোলনরত ছাত্রীদের পর্যন্ত পিটাইলো, ভাবা যায় কতটুকু বিবেকহীন নরপশু হতে পারে এরা? কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম মানুষ হত্যা শুরু করছে ছাত্রলীগই। একটু চিন্তা করুন ছাত্রলীগের কেউ মারা গেলে মানুষ আলহামদুলিল্লাহ বলে ঘৃনা প্রকাশ করে। ব্যাপারটা অনেক ভয়ানক কারন বোখারী শরীফের—১৩৬৭ নাম্বার হাদিসে বলা হয়েছে— কারো মৃত্যুতে সবাই (নিন্দাসূচক মন্তব্য করলে) “আলহামদুলিল্লাহ” পড়লে মৃত ব্যক্তির উপর জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায়।
বি:দ্র: আমি বিএনপি অথবা জামাত শিবির করিনা৷ বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করেছিলাম, এই সংগঠনের সাথে সকল সম্পর্কের ইতি টেনেছি আরো আগেই
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৩:১০