------------------------ ড. রমিত আজাদ
যে মহান ব্যক্তিটির সাথে আমাদের বাঙালী জাতির ভাগ্য গাঁথা হয়ে গেছে তিনি হলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আগ্রাসী কূটকৌশলী ইংরেজ ও দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের হাতে নবাবের পতন কেবল একটি ব্যক্তির পতন ছিলো না, উনার পতনের সাথে সাথে আমাদের জাতিরও পতন ঘটে। একটি জাতির যখন উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে তখন জাতিটিকে স্বাধীন জাতি বলা যাবে, কিন্তু জাতিটির যদি ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকে তখন সেই জাতিটিকে পরাধীন জাতি বলতে হবে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর থেকে জাতির ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকে ও আমরাও ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে যেতে থাকি। এটাই পরাধীনতা। এভাবেই নবাবের ভাগ্যের সাথে আমাদের ভাগ্য গাঁথা হয়ে গেছে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা আলিবর্দী খান নিজ গুনে সমাজের উঁচু মহলে স্থান করে নিয়েছিলেন এবং কঠোর অধ্যবসায়ের পর একসময় তিনি এদেশের সর্বচ্চো পদ অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন ও প্রজাহিতৈষী ছিলেন। দেশকে তিনি রেখেছিলেন সুশাসনে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম এই রূপসী বাংলায় (তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদে)। উনার জন্ম তারিখ ও বৎসর নিয়ে ইংরেজরা অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, উনার জন্ম ১৯ শে সেপ্টেম্বর ১৭২৭ সালে।
নবাব আলিবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান ছিলনা। নাতিদের মধ্যে মীর্জা মোহম্মদ সিরাজউদ্দৌলাই যোগ্যতম ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাই আলিবর্দী খান তাঁকেই পরবর্তি নবাব হিসাবে ঠিক করেছিলেন। সিরাজউদ্দৌলাও সবসময় নানার সাথে ছায়ার মতো লেগেছিলেন। তিনি আলিবর্দী খানের সাথে একাধিক যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলা তার নানা ইংরেজদের পিলে কাঁপানো কঠোর শুশাসক আলিবর্দী খানকে মৃত্যু শয্যায় কথা দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে তিনি সুশাসনে রাখবেন ও যেকোন মূল্যে তাকে রক্ষা করবেন। নানার মতো তিনিও দেশকে ভালোবাসতেন ও প্রজাহিতৈষী ছিলেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তার নানা আলিবর্দী খান দুজনই শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। শিক্ষার প্রতি নবাব আলিবর্দী খান প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি শিক্ষিতদের সমাদর করতেন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার আমলে বাংলার ফার্সী সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-এর বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেন তাবাতাবাই লিখেছেন, নবাব আলিবর্দী খান প্রতিদিন দুই ঘন্টা আলেমদের সাথে জ্ঞানালোচনা করে কাটাতেন। মুহম্মদ আলী ফাজিল, হাকিম হাদী আলী খান, নকী কুলী খান, মির্যা হোসেন সেসেবি এবং আরো অনেক পন্ডিত ব্যাক্তি এই আলোচনায় যোগ দিতেন।
মুহম্মদ আলী ফাজিল ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। হাকিম হাদী আলী খান চিকিৎসা শাস্ত্রে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাকে সে যুগের গ্যালেন আখ্যায়িত করা হয়েছিল। হাকিম তাজুদ্দিন মুর্শিদাবাদের আরেকজন বড় চিকিৎসা বিশারদ ছিলেন। কাযী গোলাম মুজাফফর, মুহম্মদ হাযিন, শাহ মুহম্মদ হাসান, আবুল কাশিম ও সৈয়দ মুহম্মদ আলী সেই সময়ের খ্যাতনামা পন্ডিত ছিলেন। ইতিহাস লেখক ইউসুফ আলী নবাবের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'সিয়ার-উল-মুতাক্ষেরীণ' রচয়িতা গোলাম হোসেন তাবাতাবাইও নবাব আলীবর্দী ও সিরাজউদ্দৌলার অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। নবাব আলীবর্দী এতই সুশাসক ছিলেন যে তার সময়ে বাংলা ঐশ্বর্য্যশালী হয়ে উঠেছিল। সেই ঐশ্বর্য্যশালী বাংলাকে রক্ষা করারই প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন তার আদরের নাতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা মনসুর-উল-মুল্ক। কিন্তু গুটিকতক বেঈমানের হঠকারিতায় সেই ঐশ্বর্য্য পড়ে শঠ-প্রতারক-লোলুপ ইংরেজদের হাতে। শুরু হয় লুন্ঠনের এক নবযুগের সূচনা - প্রটেস্টান্ট সাম্রাজ্যবাদ। বাংলার সকল ঐশ্বর্য্য স্থানান্তরিত হয়ে যায় ইংল্যন্ডে।
সিংহাসনে আরোহনের পর ১৪ মাস ১৪ দিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছিলেন এই বাংলার পথে-প্রান্তরে। মুর্শিদাবাদ থেকে কাশিমবাজার, কাশিমবাজার থেকে আলীনগর (কোলকাতা), আলীনগর থেকে পলাশী, সহস্রাধিক কিলোমিটার তিনি ছুটে বেড়িয়েছিলেন। সেই হিসাবে উনার গতিবেগ ছিলো আলেকজান্ডারের চাইতেও বেশী।
ক্ষমতার দখলের লড়াই ও দ্বন্দ্ব চিরন্তন তবে ১৭৫৭ সালে যা ঘটেছিলো তা একেবারেই ব্যাতিক্রমী। এখানে তরুণ নবাবের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলো কেবল দেশীয় ক্ষমতালিপ্সুরাই নয় বরং সুচারুরূপে সেখানে ঢুকে পড়েছিলো ইংরেজ বেনিয়ারা। ঘটনাটা সেখানেই। দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা হয়তো ভেবেছিলো ইংরেজদের দিয়ে একটি নাটক করিয়ে তারা নবাবকে হটিয়ে নিজেরা রাজ্য দখল করে নেবে। আর ইংরেজ মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলো, 'সূচ হয়ে ঢুকবো ফাল হয়ে বেরিয়ে যাবো।' এবং তারা সেটাই বাস্তবায়িত করেছিলো। মূর্খ মীরজাফররা বুঝতে পারেনি যে, আমার ঘরের চাবি যদি অন্যের হাতে চলে যায়। সে আমাদের আলমারী খুলে সর্বস্ব লুটে নেবে। আমার ঘরে অপরের প্রবেশাধিকার যদি অবাধই হয়ে থাকে তাহলে আর আমরা দরজা তালা-চাবী ইত্যাদির ব্যবস্থা করতাম না।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন নবাবের পতন ঘটলো? উত্তরটা এক কথায়ই দেয়া যায়, মীরজাফর ও তার সহযোগীদের বেঈমানীর কারণে। মীরজাফর যদি মসনদের লোভে ইংরেজদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হতো তবে আমরা দেশ হারাতাম না। আমাদের বাহুবল, অর্থবল কোনটারই কোন অভাব ছিলো না। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজার পদাতিক ও আঠারো হাজার অশ্বারোহীর। বিপরীতে ইংরেজদের ছিলো মাত্র তিন হাজার সৈন্য। এই তিন হাজারের মধ্যে আবার মাত্র আটশত ছিলো ইউরোপীয় সৈন্য, বাকীরা ছিলো স্থানীয় ভাড়াটে সৈন্য। আমাদের আটষট্টি হাজার সৈন্য কেবল তীর ছুঁড়ে মারলেই ঐ তিন হাজারের দফা রফা হয়ে যেত। কিন্তু তীর তো দূরের কথা কমান্ডের অভাবে তারা ঢিলও ছুঁড়ে মারেনি। হাজার হাজার সৈন্য পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। এই নীরবতা নিশ্চুপতার সুযোগ নিয়ে ঐ তিন হাজারই তিন/চার কোটি মানুষের দেশ দখল করে নিলো।
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন যুদ্ধ নামক এক ষড়যন্ত্রে তিনি পরাজিত হন। এরপর তিনি পাটনা যাচ্ছিলেন সৈন্য-সামন্ত জোগাড় করে আবারও যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু আমাদের কপালের দোষ, নৌকাযোগে পাটনা যাওয়ার পথে বাংলাদেশের রাজশাহী মহানগরীর ওপারে ভগবানগোলায় স্ত্রী লুৎফুন্নিসা ও কণ্যা উম্মে জোহরা সহ হাতে তিনি ধৃত হন। অতঃপর তিনি নিহত হলেন ২রা জুলাই ১৭৫৭ সালে। তাকে জনসমক্ষে বিচার করে জনমত যাচাই করে ফাঁসি দেয়া হয়নি। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে মীর জাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে কাপুরুষের মত তাকে হত্যা করে সিরাজের আশ্রিত সিরাজের সাথে একই থালায় ভাত খাওয়া বেঈমান মোহম্মদী বেগ। আমাদের কপালের লিখন, আমাদের নবাবকে বাঁচাতে পারলাম না। আর এর খেসারত আমাদের দিতে হয়েছে পরবর্তি দু'শো বছর।
এরপর ইংরেজরা নবাবের চরিত্রে নানাভাবে কলঙ্কলেপন করতে থাকে। সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে কলকাতায় একটা মনুমেন্ট তৈরী হয়েছিল। তার নাম ছিল হলওয়েল মনুমেন্ট। পরবর্তিতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে, ৩রা জুলাই, ১৯৪০ এ হলওয়ের মনুমেন্ট অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিলেন । বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানেরা এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে ইংরেজদের বাধ্য করে ঐ হলওয়ের মনুমেন্ট তুলে নিতে। পরবর্তিতে পরবর্তিতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মওলানা আকরাম খাঁ ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবিরা যথাযোগ্য মর্যাদায় ২৩ শে জুন পলাশী দিবস পালন করার উদ্যোগ গ্রহন করেন।
শুধুই কি মীরজাফর? না মীরজাফর একা ছিলো না। আমাদের সভাসদের আরো অনেকেই বেঈমান ছিলো। ঘসেটি বেগম, জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, কৃষ্ণবল্লভ, ইয়ার লুতফ খাঁ, মীরণ, মোহম্মদী বেগ এরাও বেঈমানীর তালিকাভুক্ত। কেন তারা বেঈমানী করেছিলো? ব্যক্তিগত লোভে পড়ে। তারা দেশের কথা একবিন্দুও ভাবেনি।
ফল কি হয়েছিলো। পলাশীর ট্রাজেডির পরে দেশের সাথে সাথে তারাও সব কিছু হারিয়েছিলো। ইংরেজরাও মীরজাফরকে বিশ্বাস করেনি। ইংরেজরাও বুঝেছিলো বেঈমান বেঈমানই, যে নিজ দেশের সাথে বেঈমানী করতে পারে, ইংরেজদের সাথে তার বেঈমানী করতে কতক্ষণ? যেই নবাবীর জন্য মীরজাফর এতো কিছু করলো সেই নবাবী দুই বছরও টেকেনি। পরবর্তিতে ভয়াবহ কুষ্ঠরোগে মীর জাফরের মৃত্যু হয়। তার পুত্র মীরণ (যার নির্দেশে সিরাজকে হত্যা করা হয়েছিলো) মেজর ওয়ালসের নির্দেশে তাঁবুতে আগুন লাগিয়ে মীরণকে হত্যা করা হয় এবং প্রচার করা হয় বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়েছে। মস্তিষ্ক বিকৃত অবস্থায় কুপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে মোহাম্মদী বেগ। বিশ্বের অন্যতম ধণাঢ্য জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয় (মহাতপচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ)কে মীর কাশিম বস্তায় পুরে পাথর ঝুলিয়ে মুঙ্গের দূর্গের শীর্ষ থেকে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়। স্মৃতিভ্রংশ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে উমিচাঁদেরও মৃত্যু হয়। যুদ্ধের পর রায় দুর্লভ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইয়ারলতিফ অকস্মাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অনেকের ধারণা তাকে হত্যা করা হয়। ঘসেটি বেগম মারা গিয়েছিলো বুড়িগঙ্গার পানিতে ডুবে। রাজবল্লভের মৃত্যুও হয়েছিল মর্মান্তিকভাবে। রবার্ট ক্লাইভ নিজ হাতে গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করে। বিলাতে যাওয়ার পথে জাহাজ ডুবিতে স্ক্রাফটনের মৃত্যু হয়। যুদ্ধের পর বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় বিলাতে অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন ওয়াট্স্। তালিকাকাভুক্ত সব বেঈমানই কোন না কোন অপঘাতে নিহত হয়।
নবাব পরিবারের পুরো ইতিহাস আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে পাওয়া যায়না। তাই অনেকেরই জানা নেই যে, পরম করুণাময়ের কৃপায় নবাবের বংশধরেরা টিকে আছে। নবাবের একমাত্র কন্যা উম্মে জোহরার বিবাহ হয় সিরাজের আপন ভ্রাতুষ্পুত্র মুরাদউদ্দৌলার সাথে। তবে ইংরেজ আমলে তারা নীরবে নিভৃতে দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। একসময় ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ্র কর্ঙোচর হয় নবাব পরিবারের দুঃখের কথা। তিনি ঢাকার আহ্সান মঞ্জিল থেকে ১৬/০৬/১৯১৩ সালে লিখিত এক পত্রে তদানিন্তন বাংলার গভর্নরের নিকট সিরাজউদ্পদৌলা পরিবারের ৬ষ্ঠ বংশধর সৈয়দ জাকি রেজাকে একটি সম্মানজনক চাকুরী দেয়ার সুপারিশ করেন। উনার সুপারিশে সৈয়দ জাকি রেজা একটি সম্মানজনক চাকুরী পান। সপ্তম বংশধর সৈয়দ গোলাম মুর্তজা ১৯৪৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তিনি সরকারী চাকুরী করতেন। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথিতযশা সাংবাদিক ফজলে লোহানী তার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান (বিটিভি-তে প্রচারিত) 'যদি কিছু মনে না করেন'-এ জনাব ,সৈয়দ গোলাম মুর্তজা-কে পরিচিত করিয়ে দেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার অষ্টম বংশধর সৈয়দ গোলাম মোস্তফা পিডিবি-র এক্সিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার ছিলেন। নবম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব ওরফে নবাবজাদা আব্বাসউদ্দৌলা একজন লেখক। আমাদের দেশে অনেক শহীদ পরিবার, বুদ্ধিজীবি পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গের পরিবারবর্গ সরকারী সাহায্য, সহযোগীতা ও আনুকুল্য পেয়েছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরিবারকেও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা হোক, সমাজের কাছে এই দাবী আমরা করতে পারি।
পলাশীর যুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের যা যা লাভ হয়েছেঃ
ইতিহাসের পাতায় পলাশী যুদ্ধোত্তর লুণ্ঠনের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। একটি বিবরণ হতে জানা যায় ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে পাচার হয় ৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া হীরা, জহরত, স্বর্ণ, স্বর্ণের বার যা ছিল তার হিসাব পাওয়া দুষ্কর। শুধুমাত্র নবাবের হীরাঝিল প্রাসাদেই সঞ্চিত ছিল ১ কোটি ৭৬ লাখ রৌপ্যমুদ্রা, ৩২ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, দুই সিন্দুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিন্ড, ৪ বাক্স হীরা জহরত, ২ বাক্স চুনীপান্না প্রভৃতি মূল্যবান পাথর। এর সবগুলোই লুণ্ঠিত হয়।
এই বাংলার লুন্ঠিত সম্পদেই ইংল্যান্ডে সাধিত হয় শিল্প বিপ্লব। যার ফল তারা আজও ভোগ করছে। ব্রিটিশ সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ উইলিয়াম ডিগবী (Sir William Digby) বলেছিলেন
England's industrial supremacy owes its origin to the vast hoards of Bengal and the Karnatik being made available for her use....Before Plassey was fought and won, and before the stream of treasure began to flow to England, the industries of our country were at a very low ebb. ('Prosperous India: A Revelation,' p. 30.)
পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার যা যা ক্ষতি হয়েছেঃ
ঐ সময় মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল যথেষ্ট স্বচ্ছল। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের ভাত, মাছ, গোশত, দুধ, ঘি, চিনি ইত্যাদি খেয়ে, সাধারণ মানের পোষাক পরে এক মাস চলার জন্য প্রয়োজন হতে মাত্র ১ টাকা ৪ আনা।
পলাশীর যুদ্ধের মাত্র ১৩ বছর পর ১৭৭০ সালে বাংলায় যে ভয়াবহ মন্বন্তর হয় তাতে বাংলা ও বিহারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারায়।
বাঙালী ব্যবসায়ীদের হাত থেকে সকল ব্যবসা-বাণিজ্য ইংরেজরা কেড়ে নেয়। মসলিন শিল্পিদের হত্যা করে ও তাদের আঙুল কেটে নেয়। তাতীদের তাত চালানো বন্ধ করে দেয়। এভাবে আমাদের সহস্র বছরের বস্ত্র শিল্পের ধ্বস নামিয়ে ফেলে।
আমাদের সাহসী ও দক্ষ সৈনিকদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজরা একসময় গোটা ভারত দখল করে। তারপর সেই বাঙালী সৈন্যদেরই সেনাবাহিনী থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রিক্রটমেন্ট বন্ধ করে দিয়ে, অপপ্রচার চালিয়ে দেয় যে বাঙালী মার্শাল রেস নয়।
দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো একে একে বন্ধ হতে থাকে। এক সময় তারা আমাদের ভাষায় শিক্ষা চর্চা বন্ধ করে বাংলায় অপ্রচলিত ইংরেজী ভাষায় শিক্ষা চালু করে, ফলে জাতি চিরকালের মত অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এবং শিক্ষার সাথে সাথে অর্থনীতি ও অন্য সব ক্ষেত্রেই পতন ঘটে।
পৃথিবীর ইতিহাসে 'ইসলামিক গোল্ডেন এজ' বলে একটি সময়কাল রয়েছে এর সূত্রপাত ৬১০ খ্রীষ্টাব্দে, এই যুগে মুসলিম বিজ্ঞানী ও মণিষীদের অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যারপরনাই উপকৃত হয়েছে মানবজাতি। এই যুগের পতনের সূত্রপাত ঘটে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে।
ইংরেজ লর্ড ম্যাকলে ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে বক্তৃতা দিয়েছিলো তা লক্ষ্যণীয়।
"I have traveled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief. Such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such calibre, that I do not think we would ever conquer this country, unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage, and, therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native self-culture and they will become what we want them, a truly dominated nation." - Lord Macaulay)
লর্ড ম্যাকলে ভারত উপমহাদেশের আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির ক্ষমতা শনাক্ত করতে পেরেছিলো। বৃটিশ সরকার ম্যাকলের প্রস্তাবকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছিলো। এবং সেই অনুসারে পলিসিও তৈরী করে। ১৮৩৫ থেকে ১৯৪৭ এই সুদীর্ঘ ১১২ বছর ছিলো মূলতঃ ঐ পলিসিরই বাস্তবায়নের যুগ। যার ফলে আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া ইংরেজী ভাষার ব্যাপক প্রভাবে আমরা আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, আদর্শ-আধ্যাত্মিকতা, এক কথায় স্বকীয়তা হারিয়েছি। পাশাপাশি হারিয়েছি নৈতিক মূল্যবোধ ও ধীশক্তি! পরাধীনতার শৃংখলটাকেই আমাদের ভাগ্য বলে মনে নিয়েছি। নৈতিক মূল্যবোধ ও মনোবলের অভাবে আমরা মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করতে পারিনি বহুকাল। সেই সুযোগে চলেছে আমাদের দেশে প্রচলিত পুরাতন শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, আদর্শ-আধ্যাত্মিকতা, ইত্যাদির ধ্বংসযজ্ঞ। যাতে আমরা সচেতন হয়ে উঠলেও খুব সহজে তাকে আর ফিরে পেতে না পারি।
ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন, "ইতিহাসের শিক্ষাটা হলো এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না।"
জানিনা কথাটি শতভাগ সঠিক কিনা? তবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়াটা অতীব জরুরী।
তথ্যসূত্রঃ
১। Click This Link
২। বাংলাদেশের ইতিহাস: ড. মুহাম্মদ আবদুর রহিম, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, ড. এ. বি. এম. মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:১০