somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দি পাওয়ার অব ম্যাথমেটিক্স

২৫ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দি পাওয়ার অব ম্যাথমেটিক্স
----------------------------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ

ঘটনা ১: একবার এক গণিতের অধ্যাপক আমাকে বললেন যে, তিনি বাংলাদেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন সেখানে গণিতের শিক্ষকদের অপেক্ষাকৃত কম বেতন দেয়া হয়। আমি প্রশ্ন করলাম, "কেন?" তিনি বললেন, "কর্তৃপক্ষ মনে করে, বিজনেস সাবজেক্টগুলোর ডিমান্ড ভালো, ঐ সাবজেক্টগুলোর অধ্যাপকদের বেশী বেতন দেয়া উচিৎ।" আমি বললাম, "কিন্তু গণিত ছাড়া তো বিজনেসের সাবজেক্টগুলোও অচল।" তিনি বললেন, "কর্তৃপক্ষ সেটা বুঝতে চায় না।"

ঘটনা ২: ষাটের দশক, বিশ্ব তখন দুটি শিবিরে বিভক্ত, কম্যুনিস্ট ও ক্যাপিটালিস্ট। এক শিবিরের নেতা সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) আরেক শিবিরের নেতা আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে শুরু হয়েছে নতুন যুদ্ধ, এর নাম ঠান্ডা যুদ্ধ (cold war)। শ্রেষ্ঠত্বের দাবী নিয়ে চলছে লড়াই ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা । যেমন চলছে অস্ত্রের দৌড় (arms race), তেমনি পাল্লা দিয়ে চলছে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় একটি বড় স্থান করে নিলো মহাকাশ জয়ের পাল্লা। কেবল পৃথিবীতে নয় আকাশেও আধিপত্য চাই। ১৯৫৭ সালে সমগ্র বিশ্ববাসীর নজর ছিলো, কে আগে মহাকাশে পাঠাতে পারবে কৃত্রিম উপগ্রহ, যা পৃথিবীর সব বাধা ভেঙে উড়ে যাবে সুদূর ভুবনে, সুনীল আকাশে পৌছে দেবে মানবজাতির বার্তা, সেই সাথে প্রমানিত হয়ে যাবে, কোন জাতি সেরা, রাশিয়া না আমেরিকা। রুশ শিবিরের সদস্য রাষ্ট্রগুলো মনে প্রাণে চাইছে রাশিয়া জয়ী হোক, আর মার্কিন শিবিরের সদস্যরা আত্মপ্রত্যয়ের সাথে অবিরাম বলে চলছে এই জয় আমেরিকার ঘরেই আসবে। অবশেষে ১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর সকল জল্পনা-কল্পনার অবশান ঘটিয়ে সফলভাবে মহাকাশে উড়ে গেলো রাশিয়ার উৎক্ষেপিত কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১। হেরে গেলো দাম্ভিক ধনকুবের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু বিশ্ববাসী নয় তারা নিজেরাও হতবাক হয়ে গেলো।

যাহোক প্রথম প্রতিযোগিতায় না হয় হেরে গেলাম, কিন্তু পরেরটিতে জিততে হবে এই সংকল্প নিয়ে আবারো তোড়জোড় শুরু করলো যুক্তরাষ্ট্র। এবারের প্রতিযোগিতা, কে প্রথম মহাকাশে পাঠাতে পারবে নভোচারী। আবারো ঘটলো একই ঘটনা, ১৯৬১ সালের ১২ই এপ্রিল মার্কিনীদের আরো একধাপ পিছে ফেলে ভস্তোক – ১ (প্রাচ্য-১) -এ চড়ে মহাকাশে উড়ে গেলেন রুশ নভোচারী ইউরি গ্যগারিন। আরো একবার হতবাক হলো বিশ্ববাসী, পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে হলো যুক্তরাষ্ট্রের। এরপর একের পর এক সাফল্য প্রদর্শন করলো রাশিয়া - প্রথম মহিলা নভোচারী, প্রথম স্পেস স্টেশন সেট আপ, প্রথম ওপেন স্পেস ওয়াকিং, প্রথম চাঁদে রকেট প্রেরণ, ইত্যাদি। সমগ্র বিশ্ববাসী ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমেরিকার দিকে। আমেরিকানরা নিজেরাও বিস্মিত হয়ে ভাবছে, কেন এমন হচ্ছে। খোঁজ নাও তাহলে। কি তাদের রহস্য? কোন যাদুবলে কম অর্থ-বিত্ত থাকার পরও রুশরা মহাকাশ প্রতিযোগিতায় তাদের হারিয়ে দিচ্ছে। অবশেষে উদঘাটিত হলো রহস্য - রাশিয়ায় (সোভিয়েত ইউনিয়নে) স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি যত্ন সহকারে পড়ানো হয় গণিত (ম্যাথমেটিক্স)। গণিতে প্রবল মেধা নিয়ে বড় হয়ে ওঠে তাদের শিশু-কিশোর-তরুণরা। আর এটাই রাশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়নে)-এর সাফল্যের মূল কারণ। একেই বলে দি পাওয়ার অব ম্যাথমেটিক্স।

পৃথিবীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করে পাওয়া গিয়েছে যে, যে জাতি গণিতে যত পারদর্শী ছিলো, সেই জাতি ততই উন্নতি করেছে। বর্তমান পৃথিবীতেও এটা লক্ষ্যণীয় যে, কোন জাতি যখনই গণিতের প্রতি যত্নবান হয়ে উঠছে তখনই তার উন্নয়ন শুরু হচ্ছে। রাশিয়া, আমেরিকা, জার্মানী, জাপানের কথা তো আমরা সকলেই জানি। ইদানিং সেই পথ ধরে চমক সৃষ্টি করছে চীন।

এই মহাবিশ্বকে অধ্যায়নরত সর্বস্তরের বিজ্ঞানীরা তার পরতে পরতে গণিতের ''অদ্ভুত কার্যকারিতা' দেখে বিস্ময়বিহ্বল হয়ে ওঠেন - প্রকৃতির সবচাইতে জটিল প্রতিভাসগুলোর পিছনে লুকানো প্রচ্ছন্ন শৃঙ্খলাগুলোকে উদঘাটন করার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এই গণিতের। শুধু তারাই নয়: অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীই গণিতের বিস্ময়কর শক্তির মুখোমুখি হয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে গণিতের ব্যবহারের পদ্ধতিকে বলা হয় ফলিত গণিত (Applied Mathematics)। গণিত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধারণা রয়েছে যে, গণিত বাস্তব জগৎ থেকে অনেক দূরে জ্ঞানের একটি বিমূর্ত শাখা, তা অনেকটাই সঠিক নয়। আসুন নিম্নলিখিত ধারণাগুলো (ideas)-র উল্লেখযোগ্য উপকারীতা বিবেচনা করি:

N-কায়ার সমস্যা: স্যার আইজাক নিউটন থেকে শুরু করে, N -সংখ্যক কায়ার একটি সেট মাধ্যকর্ষণ শক্তির প্রভাবে কি রকম আচরণ করবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রচেষ্টা থেকে জন্ম নেয় গাণিতিক ও ভৌত প্রতিভাসের বিশাল সংখ্যক পরিজ্ঞান (insights )। একটি ফলাফল হলো ক্যাওয়াস থিওরী।

টরাসঃ ডোনাট আকৃতি বিশিষ্ট কায়ার বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় টরাস যা গ্রহ থেকে শুরু করে ব্যবসা চক্র পর্যন্ত আলো ছড়িয়ে দেয়। মানব মস্তিষ্ক কি করে আবেগ পাঠ করে, কিভাবে বর্ণ দৃষ্টি (color vision) কাজ করে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্টন স্কীম কেমন হবে ইত্যাদিও ব্যখ্যা করে টরাস।

আ্যরো-এর অসম্ভাব্যতা উপপাদ্য (Arrow's impossibility theorem): কোন নির্বাচনে যদি তিন বা ততোধিক প্রার্থী থাকে, নির্বাচনকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক ( crucial criteria ) পূরণ করা সম্ভব নয়। যার অর্থ হলো কোন নির্বাচন পদ্ধতিই ন্যায্য নয়। এই বিস্ময়কর ফলাফলের রয়েছে সামাজিক পছন্দের তত্ত্বের উপর ব্যাপক প্রয়োগ।

উচ্চতর মাত্রা (Higher dimensions): কোন ক্ষেত্রে যখনই একাধিক চলক চলে আসে, এই সমস্যা উচ্চতর মাত্রার পদ্ধতিতে সমাধান করার চেষ্টা করা যেতে পারে। সালভাদর ডালির কিছু চিত্রকর্মে উচ্চতর মাত্রার বিষয়টি দেখা গিয়েছে।

দর্শন ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর গণিতের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। জ্যামিতির অবরোহী পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রকৃতি জগতের অনেক কিছুই আবিষ্কার করা সম্ভব। এই মতবাদ প্লেটো থেকে শুরু করে কান্ট পর্যন্ত অনেক দার্শনিকদের প্রভাবিত করে। যখন স্বাধীনতার ঘোষনায় বলা হয়, "এসব সত্যকে আমরা স্বতঃপ্রমাণিত বলে মনে করি।" তখন ঘোষণাটি ইউক্লিডের স্বতঃসিদ্ধই অনুসরণ করে বলে মনে হয়। অষ্টাদশ শতকে প্রাকৃতিক অধিকারের মতবাদ রাজনীতিতে ইউক্লিডিয় স্বতঃসিদ্ধ অনুসন্ধানেরই একটি প্রচেষ্টা। স্যার আইজাক নিউটনের প্রিন্সিপিয়াও ইউক্লিডিয় স্বতঃসিদ্ধের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত। প্রকৃতি (জ্যোতিষ্ক, স্থান, কাল, সময়, প্রাণ, চৈতন্য, মানবজীবন, সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্র) অপার রহস্যময়। পিথাগোরাস, প্লেটো, কণাদ, আর্যভট্ট ইত্যাদি কালজয়ী দার্শনিকদের রহস্যোদঘাটন গাণিতিক পদ্ধতি দ্বারা সম্পুর্ণরূপে প্রভাবিত ছিলো।

গণিতের বিমূর্ততাকে ভয় করার কিছুই নাই। বরং তাকে লালন-পালন করা ও তাকে কল্পনার সাহায্যে ব্যবহার করা অতীব প্রয়োজন। গণিত আমাদের অভিজ্ঞতার উর্ধ্বে উঠে যাওয়ার ক্ষমতা এনে দিয়েছে। অতীতের সমস্যা সমাধান করার আমাদের প্রয়োজন নেই, বরং আমরা সমাধান করব সেই সমস্যা যার পূর্বঅভিজ্ঞতা আমাদের নেই এবং যার পূর্বজ্ঞানও আমাদের নেই, ঠিক এ কারণেই আমাদের প্রয়োজন দি পাওয়ার অব ম্যাথমেটিকাল থিংকিং।

(চলবে)


২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার একটা ব্যক্তিগত সমুদ্র থাকলে ভালো হতো

লিখেছেন সামিয়া, ২১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:২৭


আমি এসে বসছি
নরম বালুর উপর,
সামনে বিশাল সমুদ্র,
ঢেউগুলা আমারে কিছু একটা বলতে চাইতেছে,
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।

আমার মাথার উপর বিশাল আকাশ,
আকাশের নিচে শুধু পানি আর পানি,
আমি একলা,
আমার সামনে সমুদ্রের একলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নভোচারীদের বহনকারী ক্যাপসুল

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৫০





ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামসকে নিয়ে নাসা ও স্পেসএক্স-এর স্পেসক্রাফ্ট ড্রাগন ক্যাপসুল পৃথিবীতে পৌঁছে গেছে। ক্যাপসুলের রং পুরোপুরি বদলে গেছে-এটি একেবারে কালো হয়ে গেছে।

এই ক্যাপসুলের অবস্থা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:৪৭



জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দলের নাম ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। রাজনীতি করা ভালো। বোকা, সহজ সরল লোকদের রাজনীতি করা ঠিক না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে... সাজাই এ ঘর ফুলে ফুলে ...

লিখেছেন শায়মা, ২১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:৫৮


ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল দ্বার খোল, দ্বার খোল....
বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে লাগে দোল। সাথে সাথে দোলা লাগে বুঝি আমাদের অন্তরেও।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ক্লোজড ! নতুন করে ওপেন করার সুযোগ নেই......

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১০:৪৫


..বলে মনে করেন জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। প্রধান উপদেষ্টা সাম্প্রতিক সময়ে একটি স্বনামধন্য থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রধানের সাথে বৈঠকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×