বাপ মা অনেক চিন্তা ভাবনা করে তাদের একমাত্র ছেলের নাম রাখলেন- আইনস্টাইন। বলে রাখা ভালো, আমার এই গল্পের নায়কের নাম- আইনস্টাইন। সে ঢাকার উত্তরাতে নিজের ফ্লাটে থাকে। সে একজন ব্যাংকার। তার পেশা চাকরি কিন্তু তার শখ গোয়েন্দাগিরি করা। সে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছেন। যারা তাকে চিনেন- তারা সকলে তাকে সম্মান করেন। গোয়েন্দা আইনস্টাইনের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর। শ্রী নগর থানা। আমি তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। বিশাল পুরোনো দিনের জমিদার বাড়ি।
আইনস্টাইনের কোনো ভাই বোন নেই। সে একা। বাপ মার খুব আদরের সন্তান ছিল আইনস্টাইন। বাপ-মা চেয়েছিলেন তাদের আদরের সন্তান স্যার আইনস্টাইনের মতো জ্ঞানী হোক, বুদ্ধিমান হোক, বিজ্ঞানী হোক। কিন্তু বাস্তব জীবনে আইনস্টাইন কিছুই হতে পারেন নি। সে একটা বেসরকারী ব্যাংকে চাকরি করে এখন অবসরে আছেন। আইনস্টান বিয়ে করেন নি। তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আইনস্টাইন আপনি কেন বিয়ে করেন নি(?)- আইনস্টাইন হাসি মুখে বলেন, আমি সময় অপচয় করতে চাই না। প্রতিটা মুহুর্ত আমি কাজে লাগাতে চাই। মানব জীবন খুব বেশী মূল্যবান। আইনস্টাইন পৃথিবীর সব গোয়েন্দা গল্প পড়ে ফেলছেন। এমনকি সব ডিটেকটিভ মুভি গুলো তার সব দেখা। আইনস্টানকে কেউ কোনো প্রশ্ন করে আটকাতে পারেন না। অনেকে আইনস্টানকে গুগল বলে থাকেন। আমার কোনো কিছু জানার থাকলে বা কোনো প্রশ্নের উত্তর জানার ইচ্ছা হলে আমি আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিই।
আইনস্টাইন চেয়েছিলেন আমি তার সমাধান করা ঘটনা গুলো লিখি। কারন আমি তার সাথে থেকে-থেকে নিজের চোখে দেখেছি তিনি কিভাবে রহস্যের সমাধান করেন। মোট ১০৩ টি ঘটনার সমাধানের সাক্ষী আমি। আইনস্টাইনের সর্বশেষ ঘটনাটি আজ আমি লিখব। এই ঘটনার সমাধান করার পর'ই তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। হাসপাতালে তিনি আমার কোলে মাথা রেখেই মারা যান। একটা ১৭/১৮ বছরের ছেলে তার বাসায় যায়। ছেলেটার নাম- রবীন। আইনস্টাইন রবীনকে নিজের হাতে কফি বানিয়ে খাওয়ান। কফি খেয়ে রবীন একটা ধারালো ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আইনস্টাইনকে প্রায় মেরে ফেলে। আইনস্টানের হাতে তখন একটা জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটে মাত্র দু'টা টান দেওয়া হয়েছিল। আইনস্টাইনকে হত্যা করে রবীন নিজে পুলিশের কাছে ধরা দেয়।
আইনস্টাইন যখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালে পড়ালেখা করছে তখন রুপা নামে একটা মেয়ে তাকে ভীষন পছন্দ করতো। বেশ কয়েকবার কলা ভবনের সামনে তাদের গল্প করতে দেখা গেছে। রুপা সব সময় শাড়ি পরতো। পুরো ক্যাম্পাসে সবাই রুপার প্রশংসা করতো। অনেক ছেলেই রুপার পেছনে ঘুরঘুর করতো। কিন্তু রুপা কাউকে পাত্তা দেয় নাই। তাকে শুধু দেখা যেত আইনস্টাইনের আশে পাশে থাকতে। সবাই ধরেই নিয়েছিল আইনস্টানের সাথে রুপার বিয়ে হবে। এখন রুপা থাকে আমেরিকা। এবং সে সত্যি সত্যি বিয়ে করেনি। রুপা আমাকে এবং আইনস্টাইনকে তার বাসায় যেতে বলেছিল। ভিসাও হয়ে গেছে, যাবার তারিখও সব ঠিকঠাক। কিন্তু আইনস্টাইন না ফেরার দেশে চলে গেলেন!
রাত এগারোটায় আইনস্টাইন আমাকে ফোন করলেন। বললেন, শাহেদ রেডি হয়ে চলে আসো। শ্যামলী যেতে হবে।
আমি বললাম, ঘটনা কি?
আইনস্টাইন বললেন- এক বাসায় চুরী হয়েছে। দেখি চোরকে ধরতে পারি কিনা।
আমি খুব বিরক্ত হয়ে বললাম, চুরী তো হয়েই গেছে। এখন ঘুম বাদ দিয়ে যাওয়ার দরকার কি? সকালে গেলেই তো হয়।
আইনস্টাইন বললেন, রাতের আলামত সকালে পাওয়া যাবে না। কোনো কিছু নিয়েই অবহেলা করা ঠিক না। কুইক।
কোনো রহস্য উদঘাটনে গেলেই আইনস্টাইন সব সময় তার লাইসেন্স করা পিস্তটা সাথে করে নিয়ে নেন। পিস্তলটা বেশ কয়েকবার ধরার সুযোগ আমার হয়েছে। আইনস্টানের চোখ শকুনের চেয়েও পাওয়ারফুল। নাক খুব পরিস্কার। মুহুর্তের মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন। খুব বুদ্ধিমান মানুষ। কিন্তু কথা বার্তায় আর চালচলনে এক ধরনের সারল্য আছে। যা সবাইকে মুগ্ধ করে।
আমরা শ্যমালী'র সেই বাড়িতে গেলাম। বাড়ির কর্তার কাছ থেকে জানতে পারলাম পুরো ঘটনা। তার ছোট পরিবার। বাবা মা আর ভাই বোন। পরিবারে মোট সদস্য সংখ্যা চারজন। ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করেন। অডিট অফিসার। তার ছেলে রবীন আর মেয়ে লিজা কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে।
চোর আলমারি ভেঙ্গে একটা গলার চেইন রেখে, বাকি সব গহনা নিয়ে গেছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল ছিল সেটাও নিয়ে গেছে। ঘরের দরজা ছিল লাগানো। চোর বারান্দার গ্রীল কেটে ঘরে ঢুকেছে। সেসময় বাসায় কেউ ছিল না। আমি আইনস্টাইনের সাথে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি আনাচে-কানাচে ঘুরলাম। আলমারি এবং বারান্দার গ্রীল ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলাম। পরিবারের প্রতিটা সদস্যের দশ মিনিট করে কথা বললাম।
আমি আইনস্টাইনকে বললাম, এই চোর খুজে বের করা সম্ভব না। এতক্ষনে মনে হয় চোর ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছে।
আইনস্টাইন বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন।
আমি বললাম স্যরি।
বাড়ির কর্তা অডিট অফিসার বললেন, পুলিশ এসেছিল। তারা তদন্ত করবে বলেছে। পুলিশের উপর আমার কোনো আস্থা নেই, তাই আপনাকে ডেকেছি। যদি এক সপ্তাহের মধ্যে চোর ধরতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে পাঁচ লাখ টাকা দিব।
আইনস্টাইন বললেন, এক সপ্তাহ লাগবে না, আমি এখনই বলে দিচ্ছি টাকা কে চুরী করেছে!
পুরো পরিবারটি আইনস্টাইনের কথা শুনে থ! একেবারে থ। তাদের চোখে মুখে সীমাহীন বিস্ময়!
আইনস্টাইন বললেন, টাকা এবং গহনা চুরী করেছে আপনার ছেলে রবীন।
রবীনের মা রেগে গিয়ে বললেন, এসব কি বলছেন আপনি? ছিঃ।
আইনস্টাইন রবীনের মার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি জানি আমার কথায় আপনি অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু আমাকে বলতে হবে। সত্য কথা বলতে এক ধরনের আনন্দ হয় আমার। এই আনন্দ পেতে আমি কখনও কার্পন্যবোধ করি না। আইনস্টাইন তার চশমার কাচ পরিস্কার করতে করতে বললে, রবীনকে চুরী করতে সহযোগিতা করেছে আপনার মেয়ে লিজা।
রবীনের বাবা বললেন, আমার ছেলে মেয়ে চুরী করবে কেন?
আইনস্টাইন বললেন, আপনার ছেলে মেয়ে নেশায় আসক্ত। সে যেন ঠিকভাবে নেশা করতে পারে এজন্য সে তার বোনকেও নেশা করতে শিখিয়েছে। নেশার টাকা সংগ্রহ করতে গিয়েই তারা চুরীর নাটকটা সাজিয়েছে। আর বারান্দার গ্রীল কেটেছে আপনার মেয়ে। কাটা গ্রীল দেখে যেন মনে করা হয়- বাইরে থেকে চোর এসেছিল। আপনার মেয়ের ঘরে খাটের নিচে খুঁজলে হেসকো ব্লেড পাওয়া যাবে।
আইনস্টাইন চলে আসার আগে রবীন প্রশ্ন করলো- আপনি কিভাবে বুঝলেন আমরা দুই ভাই বোন মিলে চুরী করেছি?
আইনস্টাইন বললেন, তোমার আবেগ আর ভালোবাসার কারনে তোমাদের চুরীটা ধরতে পেরেছি। যদি বাইরের চোর চুরী করতো তাহলে সব গহনা নিয়ে যেত। একটা চেইন ফেলে যেত না। তোমরা জানো চেনটা তোমাদের মায়ের ভীষন প্রিয়। তাই তোমরা সব গহনা নিয়ে গেলেও চেনটা নাওনি, তোমাদের মায়ের কথা ভেবে।
লিজা প্রশ্ন করলো- আর কিভাবে বুঝলেন আমরা দুই ভাই বোন নেশা করি।
আইনস্টাইন বললেন, আমার ছোট কাকা নেশা করতেন। তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি দিনের পর দিন। নেশা গ্রস্ত লোকদের চোখ দেখলেই বুঝা যায়। খুব কঠিন কিছু না।
পরিবারের কর্তা বললেন, আমি কথা দিয়েছিলাম। আমি এখনই আপনাকে চেক লিখে দিচ্ছি।
আইনস্টাইন বললেন, আমি টাকার জন্য আপনার কেস হাতে নিইনি। এটা আমার শখ।
আইনস্টাইন আর আমি চলে আসার সময় রবীন চিৎকার করে বলছিল- আমি প্রতিশোধ নিবো। কঠিন প্রতিশোধ নিবো।
ছেলেটা ঠিকই কঠিন প্রতিশোধ নিলো!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:০৮