আমার নাম রোজী। বয়স আঠাশ। আমি ঢাকার নাম করা একটা পার্লারে কাজ করি। আজ আপনাদের পার্লারের সুখ দুঃখের গল্প শোনাবো। আমি এই পার্লারে কাজ করছি প্রায় তিন বছর। আমি ইডেন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি। বিয়ে হলো চার বছর হয়ে গেল। তিন বছর প্রেম করে বিয়ে করেছি। অফিস থেকে রাতে গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে। এবং সন্ধ্যায় নাস্তা দেয়। দুপুরের খাবার তো বাসা থেকেই বক্সে করে নিয়ে যাই।
ইদানিং ঢাকা শহরে পার্লারের অভাব নেই। অল-গলি ভরে গেছে। আমি যে পার্লারে কাজ করি, ধরুন সেই পার্লারের নাম- লাসভেগাস। ঢাকা শহরে লাসভেগাসের অনেক গুলো শাখা আছে। আমাদের শাখাতেই সবচেয়ে বেশি ইনকাম হয়। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক একজন নারী। তিনি কত টাকার মালিক কে জানে। প্রতিদিন যদি গড়ে তিন লাগ টাকা ধরি, তাহলে মাসে ৯০ লক্ষ টাকা। খরচ যদি ১০ লাখ টাকাও ধরি- তবুও থাকে ৮০ লক্ষ টাকা। আমি বুঝি না আমাদের এত ইনকাম কিন্তু বেতন এত কম দেয় কেন? আমাদের এখানে একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে-কারো জন্মদিন থাকলে- আমরা সবাই মিলে তার জন্মদিন পালন করি। সবাই কিছু কিছু টাকা দিয়ে কেক কিনে এনে কেক কাটি। তবে আমাদের পার্লারের একটা অলিখিত নিয়ম হলো- আমরা কেউ কারো ফেসবুক ফ্রেন্ড হতে পারব না।
লাসভেগাসে আমরা মোট- ৩৩ জন কাজ করি। আমি পার্লারের ক্যাশিয়ার। আমার বেতন মাত্র আট হাজার দুই শ' টাকা। কিন্তু আমাদের পার্লারে এমন অনেক আছে মহিলা আছে তাদের বেতন- ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাদের হয়তো খুব একটা লেখা পড়াও নেই। কিন্তু তারা একটা বউ সাজালে কম পক্ষে বিশ থেকে ২৫ হাজার টাকা বিল হয়। আর যাতা সিনিয়ার এক্সপার্ট তারা নেয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার। আমি এত লেখা পড়া করেও মাত্র আট হাজার দুই শ' টাকা বেতন পাই। এই চাকরিতে জয়েন করার আগে- আমাকে সিভি জমা দিতে হয়েছে। মোট ৬ মাসে তিন বার সিভি জমা দিয়েছি। তারপর তারা ডেকেছে। লম্বা ইন্টারভিউ দিয়েছি। ইন্টার ভিউ'র পর ট্রেনিং হয়েছে সাত দিন। তারপর জয়েন করেছি। সপ্তাহে একদিন ছুটি। সরকারি ছুটির দিন গুলোতে কোনো ছুটি নেই। ছুটি চাইলেও পাওয়া যায় না। ডিউটি দশ ঘন্টা। মনে মনে লক্ষ সিভি জমা দিয়েছি। কোথাও কেউ ডাকেনি। কিন্তু আমি লেখা পড়ায় ভালো, আমার রেজাল্ট ভালো। শুধু আমার মামা-চাচা নেই। আর টাকার জোর নেই। আমার কি একটা ভালো চাকরি পাওয়া উচিত ছিল না?
প্রতিদিন গড়ে আড়াই শ' থেকে তিন শ' মেয়ে আমাদের এখানে সাঁজতে আসে। কেউ আসে ম্যাসেজ নিতে, কেউ ভ্রু প্লাক, কেউ চুল কাটাতে। কেউ আসে বিয়ের মেকাপ নিতে, কেউ আসে বগল পরিস্কার করত, কেউ স্পা, কেউ ফেসিয়াল অথবা পেডিকিউর-মেনিকিউর ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিদিন নানান বয়সী মানূষ আসে নানান ভাবে নিজেকে সাঁজাতে। না দেখলে আপনারা বিশ্বাস করবেন না- নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থান করার জন্য বা অন্যের চোখে নিজেকে সুন্দর ভাবে প্রকাশ করার জন্য- তারা পাগল হয়ে যায়। আমাদের এখানে স্কুলে পড়া মেয়ে থেকে শুরু করে- ৫০ বছরের মহিলা পর্যন্ত আসেন। তাদের এক কথাই আমাকে সুন্দর বানিয়ে দাও। যত টাকা লাগে নাও। তারা এসে পানির মতো টাকা খরচ করে। যেমন ২/১ জন এর কথা বলি- এক ঘন্টা সার্ভিস নিয়ে তারা ৫০/৬০ হাজার টাকা খরচ করে ফেলে। দিনের শেষে আমাদের ক্যাশে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা জমা হয়। এই টাকার হিসাব আমি রাখি। কোনো কোনো দিন পাঁচ শ' থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত কম হয়। তখন এই টাকা আমার বেতন থেকে কেটে নেয়া হয়। এত ভিড়ের মাঝে ক্যাশ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। ক্যাশে আমরা দুইজন বসি। কেউ নগদ টাকা দেয়, কেউ ক্রেডিট কার্ড দেয়, কেউ আবার মোবাইল থেকে বিকাশ করে।
পার্লারে একটানা ৮/৯ ঘন্টা কাজ করি সেটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু বেতন খুব কম। তার চেয়ে বড় সমস্যা সারা দিনে একবারও মোবাইল ব্যবহার করা যায় না। অফিসে ঢোকার পর-পরই মোবাইল লকারে রেখে দিতে হয়। আমি ইচ্ছা করলেও সারাদিনে আমাদের বাসার কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারি না। এবং কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। সারাদিন অফিস করে রাত ৯ টায় বাসায় ফিরে আমি রান্না করতে বসি। আমার স্বামী সন্ধ্যা ৭ টায় বাসায় ফিরে। আমরা দুইজন মিলে যা ইনকাম করি- তাতে আমাদের সংসার চলে। মাস শেষে হাতে কিছুই থাকে। বাড়ি ভাড়া দেই ১৪ হাজার টাকা। আমার কোনো বাচ্চা নেই। ইচ্ছা করেই বাচ্চা নেই না। এত খরচ চালাবো কি করে? খুব শখ হয়- আমার একটা বাচ্চা থাকবে। তাকে গোছল করাবো, খাওয়াবো, ঘুম পাড়াবো এবং লেখা পড়াশেখাবো। শুধু স্বপ্ন দেখি, আর রাজ্যের ভাবনা ভেবে রাখি- কিন্তু আমার কোনো স্বপ্নই সত্য হয় না। সময় হু হু করে চলে যাচ্ছে।
বড় বড় শহর ছাড়া গ্রামের নারীদের কাছেও পার্লারের বেশ চাহিদা আছে। বিউটি পার্লার যেহেতু শুধু নারীদের সাজানোর ও যত্নের জন্য তাই এখানে পুরুষদের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষেধ। মেয়েরা বিভিন্ন ডিজাইনে চুল কাটানোর জন্য পার্লারে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চুলের আগা গোল করা, ‘ভি’ আকৃতির করা, স্টেপ করা, লেয়ার করা ইত্যাদি। আমি সৌন্দর্য চর্চার বিরোধী নই। কারণ পরিচর্যা ছাড়া কোনো কিছুই তার স্বরূপে টিকে থাকে না। বিউটি পার্লারের মেয়েরা ওড়না ছাড়া অবস্থায় থাকে। এবং তাদের কালো বা মেরুন রঙ্গের জামা পড়ে ডিউটি করতে হয়। আমার এলাকার অনেকেই আসেন আমার পার্লারে। তারা আমাকে দেখে অবাক হোন। আমি পার্লারে কাজ করি এটা যেন তারা মেনে নিতে পারেন না। যাই হোক, আমি মাসে তিন হাজার টাকার ফ্রি সার্ভিস পাই। সবচেয়ে বড় কথা পার্লারের চাকরির নিরাপত্তা আছে। এখানে কোনো পুরুষ নেই। যৌনহয়রানির কোনো ভয় নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:০৬