গ্রিসের ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সংগ্রহটি হচ্ছে- প্রেক্সিটেলাসের আফ্রোদিতি।গ্রিসের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্করের নাম প্রেক্সিটেলাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০-৩৩০)।বলা হয় প্রেক্সিটেলাস(praxiteles)এর আফ্রোদিতি পৃথিবীর প্রথম তৈরি নগ্ন নারী ভাস্কর্য।কস শহরের জন্য প্রেক্সিটেলাস দুটি আফ্রোদিতি নির্মান করেন।
গ্রিকরা যে ভালোবাসার দেবীকে বলে আফ্রোদিতি ঠিক তাকেই রোমানরা বলে ভেনাস।প্রেক্সিটেলাস পেরিয়ান মার্বেল দিয়ে এই ভাস্কর্যটি গড়েছিলেন।আফ্রোদিতি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যেন সত্যিকারের রক্ত-মাংসে গড়া একজন মানুষ।তার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ,ত্বকের উজ্জলতা এমনকি ত্বকের ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠা শিরাগুলো জীবন্ত মানুষের মতো।
প্রেক্সিটেলাসের ভাস্কর্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি চারদিক থেকে দেখা যায়।সামনে,পেছনে,ডান কিংবা বাঁ থেকে এই ভাস্কর্য কতটা নিঁখুতভাবে বানানো তার প্রমান পাওয়া যায়।প্রেক্সিটেলাসের এই ভাস্কর্যটি নিয়ে ইতিহাসবিদরা বলেন-শিল্পী তার প্রেমিকা(Phryne) কে দিনের পর দিন নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে এই আফ্রোদিতি গড়েছেন।আবার কেউ কেউ বলেন- প্রেক্সিটেলাস সত্যিকারভাবেই আফ্রোদিতিকে স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং দেখা নারীকেই তিনি ভাস্কর্যে রুপ দিয়েছেন।
পৌরাণিক কাহিনী বলে,প্রেক্সিটেলাস এর নগ্ন ভাস্কর্য দেখে আফ্রোদিতি(তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কখন এই ভাস্কর প্রেক্সিটেলাস তার সম্পূর্ন উদোম শরীর এভাবে নিঁখুতভাবে দেখলো) বলেছিলেন-Paris did see naked,/Adonis and Anchises,/except I knew all three of them,/Where did the sculptor see me?(এখানে, আফ্রোদিতি নিজে স্বীকার করেছেন প্যারিস,এ্যাডোনিস আর এ্যানচিজেস তিনজন পুরুষের নাম।এই তিনজন ছাড়া অন্যকোন পুরুষ আফ্রোদিতিকে সম্পূর্ন নগ্ন দেখেনি।'কিন্তু কথাটা বোধহয় সত্য নয়'।)তবে আফ্রোদিতির সাথে তার স্বামী হেফিস্টাসের(ভলকান) সম্পর্ক কখনও ভালো ছিল না।তিনি হলেন অগ্নির দেবতা।মাইথোলজি অনুযায়ী,স্বামীর চেহারা তেমন আর্কষণীয় ছিল না বলে আফ্রোদিতি তাকে কখনো নিজের বিছানায় ঘুমাতে দিতেন না।নানাবিধ গোপন প্রনয়ে তিনি ছিলেন আসক্ত।অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আফ্রোদিতি দেবতাদের মধ্যে ছিলেন অনন্য।স্বর্গ কিংবা মর্ত্য যেখানেই তিনি সুন্দর যুবক দেখতেন সেখানেই তিনি ছুটে যেতেন রমণেচ্ছায়।যুদ্ধের দেবতা এরেসের সাথে ছিল তার দীর্ঘদিনের অনৈতিক সম্পর্ক।এতগুলো অনৈতিক সম্পর্ক থাকার জন্য আফ্রোদিতির সন্তানদের প্রকৃত জনক কে তা নির্ধারন করা অসম্ভব।
একদিন সঙ্গমরত অবস্থায় স্ত্রী আফ্রোদিতি এবং প্রেমিক মারসকে জালে আটকে ফেলেন ক্রদ্ধ স্বামী ভলকান।এ দৃশ্য নিয়ে পৃথিবীতে বেশ ক'টি মাস্টারপিস আছে।স্ত্রীর ব্যভিচারে হেফিস্টাস(ভলকান) রুস্ট ছিলেন।(এ নিয়ে একটি বিশ্ববিখ্যাত পেইন্টিং আছে,নাম হলো- Vulcan Surprising Venus and Mars)।
পৃথিবীর কোন নারী সবচেয়ে বেশি সুন্দরী তা নির্ণয় করার ভার পড়েছিল যুবক প্যারিসের উপর।হেরা,অ্যাথেনা এবং আফ্রোদিতির মধ্যে প্যারিস আফ্রোদিতিকে বেছে নিয়েছিলেন।ভালোবাসার দেবীর অজানা ছিল না একজন পুরুষকে কি করে কাত করতে হয়।গ্রিক মাইথোলজিতে স্পষ্ট লেখা আছে প্যারিসকে বাগে আনতে আফ্রোদিতি সম্পূর্ন বিবস্ত্র হয়েছিলেন।গ্রিক পুরানে উল্লেখ আছে... Aphrodite then let her robe fall,exposing her nudity.
এ্যাডোসিন এত হ্যান্ডসাম ছিল যে,আফ্রোদিতি সবসময় তার জন্য উতলা হয়ে থাকতেন।গ্রিক মাইথোলজি অনুযায়ী বনে যখন এ্যাডোসিনের মৃত্যু হয় তখন তার ঠোঁটে আফ্রোদিতির ঠোঁট ছিল।এ্যাডোসিনের সাথে আফ্রোদিতির অসম ভালোবাসার একটা সাইকোলজিক্যাল দিক আছে।এ থেকে একটি সত্য বেরিয়ে এসেছে যে,শুধু ছেলেরা যে সুন্দরী মেয়ে পছন্দ করে তা নয়,মেয়েরাও সুন্দর পুরুষ পছন্দ করে।আফ্রোদিতির স্বামী হেফিস্টাস(ভলকান) দেখতে মোটেই সুন্দর ছিল না।আর এ নিয়ে আফ্রোদিতির অতৃপ্তি ছিল আজীবন।সুন্দর পুরুষদের সাথে সম্পর্ক গড়ার জন্য আফ্রোদিতির নাম সর্বজনবিদিত।এ ধরনের নানাবিধ অবৈধ সম্পর্কের জন্যও আফ্রোদিতি গ্রিক মাইথোলজির সবচেয়ে আলোচিত নারী চরিত্র।
প্রেক্সিটেলাস কি বোঝাতে এই ন্যুড ভাস্কর্যটি গড়ে তুলেছেন তা বোঝা মুশকিল।তবে ভাস্কর্য বিশ্লেষকদের মতে,এখানে দেবী আফ্রোদিতির স্নান পূর্বাবস্থার রুপ তুলে ধরা হয়েছে।খুব সম্ভবত আফ্রোদিতি স্নান করার পূর্ব মুহূর্তে তার শরীর থেকে সব আচ্ছাদন বাঁ হাত দিয়ে খুলে ফেলছেন।গ্রিক পুরান অনুযায়ী অনৈতিক রতিকর্ম শেষে ভালোবাসার দেবতা আফ্রোদিতি সব সময় Ritual bath নিতেন অর্থাৎ এক অদ্ভুত ধর্মীয় আচার।আফ্রোদিতি সতী ছিলেন না কিন্তু পবিত্র ছিলেন।তার নানাবিধ ইন্দ্রিয় দোষ থাকলেও অভিগমন শেষে তিনি প্রতিবার নিজের শরীরকে পবিত্র করে তুলতেন ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে।(দেবীরা যা করে গেছেন মানবীরা তা আর করতে পারে না।)
নগ্নতার যে আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে তা তো কেউ উপেক্ষা করতে পারে না।একজন নারীর নিরাবরন দেহ কতটা শৈল্পিক এবং কতটা হৃদয়গ্রাহী হতে পারে তা প্রেক্সিটেলাস তার মার্বেলের তৈরী আফ্রোদিতির মাঝ দিয়ে প্রকাশ করেছেন।এখানে একটা বলে রাখি ন্যুড মানেই অশ্লীল নয়।পৃথিবীতে যদি কোন জিনিস সত্যিই পুত-পবিত্র থেকে থাকে তবে তা হলো মানুষের শরীর।তাই- Nudity is beauty এবং It anything is sacred,the human body is sacred দুটি পরস্পরবিরোধী কন্সসেপ্ট।
পুরুষ যতই মহাবীর,মহাশক্তিশালী হোক না কেন তাকে পরাভূত হতে হয় নারীর কামাগ্নির কাছে।এক কথায়, আফ্রোদিতি সাহসী,গর্বিত এবং পবিত্র।