বাংলাদেশের সমাজে ড. ইউনূসের পরিচয় একজন সুদখোর ব্যবসায়ী হিসেবে। আমাদের সদ্য পলাতক গবু-স্বৈরাচারী রাণীমা তার গুণ্ডামি দ্বারা সমাজের যে ক্ষতি করেছেন, তার একটি হলো মানুষের ধর্মানুভূতি কাজে লাগিয়ে ইউনূসের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো। এই কাজে খুব সফল তিনি। কিন্তু তিনি এখানেই থামেননি। গবুচন্দ্রের আদালতে তার বিরুদ্ধে যে সব মিথ্যা মামলা করেছেন, তার সংখ্যা মোট ১৭৪টি। বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে তার আরেকটি যে পরিচয় পাই, সেটা হলো আওয়ামী অত্যাচারে জর্জরিত ইউনূস।
এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তাকে নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরের শিরোনামগুলো দেখলেই বিষয়টি বোঝা যাবে:
১৫ জুলাই ২০২৪: আদালত থেকে লোহার খাঁচা তুলে নেওয়া উচিত: ড. ইউনূস
১২ জুন ২০২৪: আজকে আমরা অনেকক্ষণ খাঁচার মধ্যে ছিলাম, এটা অত্যন্ত অপমানজনক: মুহাম্মদ ইউনূস
০৩ জুন ২০২৪: ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি ব্রিফিং
০২ মে ২০২৪: মানি লন্ডারিং মামলায় জামিন পেলেন ড. ইউনূস, অভিযোগ গঠনের শুনানি ২ জুন
০২ এপ্রিল ২০২৪: দেশে বালা-মুসিবত হচ্ছে, মানুষ যেভাবে চায়, সেভাবে থাকতে পারছে না: ড. ইউনূস
০৩ মার্চ ২০২৪: শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন পেলেন ড. ইউনূস
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪: জীবনে এমন দুর্যোগ কখনো দেখিনি: ড. ইউনূস
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪: আমাদের প্রতিষ্ঠান জবরদখল হয়েছে, আমরা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আছি: ড. ইউনূস
২৮ জানুয়ারি ২০২৪: নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সাজার রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিল করলেন
০২ জানুয়ারি ২০২৪: ড. ইউনূস কি আইনের ঊর্ধ্বে, শাস্তি কি সরকার দিয়েছে: প্রশ্ন ওবায়দুল কাদেরের
০১ জানুয়ারি ২০২৪: যে দোষ করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম, রায়ের পর ড. ইউনূস
০১ জানুয়ারি ২০২৪: ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ড. ইউনূস
ড. ইউনূস সম্পর্কে কিছু পড়ালেখা করতে গিয়ে অনুভব করলাম তার সম্পর্কে সামান্যই জানি। তার ভাবনা-চিন্তা, প্রকাশিত বইগুলি আর বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তৃতাগুলো অন্তর্জালে খুঁজলেই পাওয়া যায়। বাড়ির কাছের লাইব্রেরির ক্যাটালগ ঘেঁটে দেখলাম ইউনূসের বিখ্যাত আত্মজীবনী "দরিদ্র মানুষের ব্যাংকার: ক্ষুদ্র ঋণ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ"এবং অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই এখানে আছে। তার প্রকাশিত সাম্প্রতিক বইটি, যার নাম "তিন জিরোর বিশ্ব: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নির্গমনের নতুন অর্থনীতি," আমার বিশেষ কৌতূহলের বিষয়। বইটি এখনও পড়িনি, তবে এর উপর তার একটি লেকচার শুনেছি।
সারা বিশ্বের মানুষ ইউনূসকে ক্ষুদ্র ঋণের জনক বা উদোক্তা হিসেবে চেনেন। মাইক্রো-ক্রেডিট বা মাইক্রো-লেন্ডিং আর ড. ইউনূস নাম পাশাপাশিই উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশে মহাজনের হাত থেকে গ্রামের কজন দরিদ্র নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ঘটনাক্রমে গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু। উন্নত বিশ্বেও দরিদ্র মানুষেরা যে ঋণ নেয়, সেখানে মহাজনের মতোই কয়েকগুণ সুদ দিতে হয়। কানাডায় গরিবের ঋণ হিসেবে প্রচলিত পেডে লোনের (Payday loan) সুদের হার ৪০০ থেকে ৭৮০ শতাংশ। অতএব প্রচলিত ব্যাংক যেহেতু দরিদ্র মানুষের প্রয়োজনে ঋণ দেয় না, এই সমস্যার একটা সমাধান হিসেবে মাইক্রো-লেন্ডিং পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা কতটুকু, এটি অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার বিষয়। ক্ষুদ্র ঋণের চেয়েও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় "সামাজিক ব্যবসার" ধারণাটি। ইউনূস বলেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষকে দেখা হয় ক্ষুদ্রভাবে। মনে করা হয়, মানুষ শুধু তার নিজ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। আর বেশি বেশি অর্থ উপার্জনকে মনে করা হয় সফলতা। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের চোখে যে টিনের চশমা লাগিয়ে দেয়, সেখানে লাভ আর টাকা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। কিন্তু মানুষ যে আরও বড়। ইউনূস মনে করেন মানুষ একই সাথে নিজের স্বার্থ এবং পরার্থপরতা দ্বারা চালিত এক সামাজিক প্রাণী। অতএব তিনি যে চশমার নকশা করতে চান, সেটাতে অর্থ থাকলেও পাশাপাশি মানুষও থাকে। ব্যবসাকে তিনি টাকা কামানোর রাস্তা নয়, মানব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধানের হাতিয়ার হিসেবে দেখেন।
তিনি ঘোষণা করেন যে পুঁজিবাদী ইঞ্জিনটি ভেঙে গেছে। এখন স্বীকার করার সময় হয়েছে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনিবার্যভাবে ব্যাপক বৈষম্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশ ধ্বংসের দিকে মানুষকে পরিচালিত করে। আমাদের একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দরকার যা আত্মস্বার্থের মতোই শক্তিশালী সৃজনশীল শক্তি হিসেবে পরার্থপরতাকে প্রকাশ করে।
আমি মনে করি আমাদের নতুন প্রজন্ম পরিবেশগত ধ্বংসের বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন হতে শুরু করেছে। তেমনি ভাবে একটা সময় তারা মহাজনি বা কর্পোরেট দাসত্ব এবং সম্পদের কেন্দ্রীকরণ নিয়ে সচেতন হবে। আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮ জন মানুষের সম্পদ পৃথিবীর ৪০০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি। ধনী ১% মানুষের পৃথিবীর ৯৯% সম্পদের মালিক। আর এই সমস্যাকে সামাজিক ব্যবসা দিয়ে মোকাবেলা করা যেতে পারে। ইউনূস বলেন বনসাই হয়ে থাকার জন্য আর অন্যের অর্থকে বাড়ানোর জন্য তো মানুষের জন্ম হয়নি। এ যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের "ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি" নভেলায় বুড়ো সান্তিয়াগোর সেই কথারই পুনরাবৃত্তি, "মানুষতো হেরে যাওয়ার জন্য জন্মায়নি"।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যখন গ্রামীণ ব্যাংক প্রথম চালু হল তখন নারীদের ঋণ দেওয়ার আগে তাঁদের দিয়ে পাঁচজনের একটা গ্রুপ করতেন তিনি। সেই দলের একটি কাজ ছিল নারীরা একত্র হয়ে প্রথমে শরীরচর্চা করতেন। ইউনূস মনে করতেন, নারীদের পরিবর্তনের নিয়ন্তা হতে হলে প্রথমে জড়তার প্রাচীর ভাঙতে হবে। তাঁদের মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক জড়তা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি।
এই যে অসামান্য তাত্ত্বিক এবং স্বপ্নদ্রষ্টা, তিনি কি পারবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনে সফল হতে? ফাঁকা মাঠে ক্ষমতা দখলের মোহে উন্মাদ হয়ে ওঠা বিএনপির নেতা-নেত্রীদের তিনি কি কয়েক বছরের জন্য শরীরচর্চার মত করে রাজনীতির মাঠে সুস্থধারার রাজনীতি করাকে নিশ্চিত করতে পারবেন? অথবা ধর্মান্ধদের অপ-রাজনীতি থেকে বিরত রাখতে? রাজনীতির ময়দানের দানব এবং সাম্প্রতিক নিষ্কৃতি পাওয়া দুষ্ট জিনগুলোর আছর থেকে কি তিনি গণমানুষের রাজনীতিকে মুক্ত রাখতে পারবেন?
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ১:৫৫