বাঙালি নাকি আত্মঘাতী, এরকম একটা বই পড়েছিলাম। কিন্তু বাঙালি যে এমন ক্যাচাল-প্রিয় হতে পারে এটা ব্লগে সময় না দিলে জানতে পারতাম না। ব্লগে ক্যাচালের কদর এবং কাটতি দেখে বোঝা যায় যে বাঙালি সমাজে সুস্থ, যুক্তিশীল আলোচনার জায়গাটা ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
আমাদের কলহ-প্রবণ হয়ে ওঠার কারণটা কি? আমরা কি ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল এবং ধর্মান্ধ? কোনো প্রকার যুক্তিশীল আলোচনায় কি আমাদের আস্থা নেই? নাকি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা এবং যুক্তি-বুদ্ধি-তর্ক জনপ্রিয় হয়নি বলে আমরা ছিদ্রান্বেষী, কুৎসা পরায়ণ এবং পশ্চাৎপদ একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে চলেছি?
ব্লগে ইদানীং কদর্য ভাষার ব্যবহার খুব বেড়ে গেছে। দেখতে পাচ্ছি কেউ কেউ এখন ব্লগে এসে যাকে বলে "বাহ্যে করা" তাই শুরু করেছেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে কী পরিমাণ রেমিট্যান্স যাচ্ছে, সে বিষয়ে একজন একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। পোস্টটিতে কোনো ধরনের আলোচনা বা বিশ্লেষণ ছিল না। কতগুলো তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ভারতে এবং অন্যান্য দেশে সরকারি হিসাবমতে কী পরিমাণ রেমিট্যান্স চলে যাচ্ছে। পোস্টের শিরোনামটি ছিল অর্বাচীন ধরনের একটি প্রশ্ন- "ভারতীয়রা গত ১০ মাসে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার, তাহলে অবৈধ পথে কত?" অবৈধ পথে ভারতে কত রেমিট্যান্স যাচ্ছে তা কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে, অবৈধ পথে যে ভারতে রেমিট্যান্স যাচ্ছে এই যুক্তির পূর্বানুমানগুলো নিয়ে যুক্তিপূর্ণ একটি আলোচনা তখনও সম্ভব ছিল।
হতবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম যে, পোস্টের কোন মন্তব্যে যখনই পূর্বানুমানগুলোকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তখনই পোস্টদাতা তাকে "দাদা বাবু, তোমার এতো জ্বলছে কেন", "ভারতের কথা কইলেই তোমরা জ্বলে উঠো কেন", "খাও এখানে, হাগো এখানে, বাকি সবকিছুই ওখানে, সেটা তো আমরা জানি" এই ভাবে উত্তর দিচ্ছেন। সেই লোকের একটি মন্তব্যের ভাষা এমন: "ভারত খারাপ একথা তো একবারও বলিনি দাদাবাবু, তাহলে কেন আবারো সেই ভারত নিয়ে তোমার পু--কি জ্বলছে? ট্রাম্পকে কে যেন বাপ বাপ ডেকে দেশের বিরুদ্ধে মুখে ফেনা তুলেছিল? মনে আছে গেরুয়া দাদা বাবু? তখন তো তোমাদের পু--কি জ্বলেনি, কেন গেরুয়া দাদা বাবু?"
এভাবে প্রবল ঘৃণা ছড়ানোর জন্য এই ডিজিটাল প্লাটফর্মের ব্যবহার দেখে বাকরুদ্ধ হতে হয়। সেদিন বলতে পারিনি যে, চিন্তার অক্ষমতা কথার হুল ফোটালে পরিবর্তন হয় না। অন্যকে তীব্র বাক্যবাণে আহত করার মধ্যে কোন নৈপুণ্য প্রকাশ পায় না। আপনার কটুকথা ও তীব্র বাক্যবাণ ডিজিটাল প্লাটফর্মে জমা করে রেখে লাভ কী! ভালো কথা যদি বলতে না পারেন তাহলে অন্তত চুপ থাকুন। কেননা, আপনার নোংরা কথাগুলো রিসাইকেল করার মতো যন্ত্র এখনও বাজারে আসেনি।
অথচ এই ডিজিটাল প্লাটফর্মটিকে কী দারুণ ভাবেই না ব্যবহার করা যেত! আমি প্রায়শই কাজে অকাজে বিভিন্ন তথ্যের জন্য নেটে সার্চ দিই। বাংলা ভাষায় লিখে কিছু খুঁজলে এই ব্লগের কিছু না কিছু উঠে আসেই। যেমন সম্প্রতি "মুক্তিযুদ্ধের দর্শন" এটা লিখে সার্চ দিলাম। বেশ কয়েকটি পত্র-পত্রিকার কিছু বাজারি ধরনের লেখার সাথে সাথে সামহোয়ার-ইন-ব্লগের একটি লেখাও এল।
মূল কথাটা এই যে আমাদের ভালো চিন্তা-ভাবনাগুলো সহজে জমা করে রাখার জন্য এই প্লাটফর্মটি ব্যবহার করা যায়। ব্লগের পাতা আপনার দেশ-রাজনীতি-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য বিষয়ে মৌলিক চিন্তাভাবনাগুলো সংগ্রহের আদর্শ স্থান হতে পারে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস "লোটাকম্বল"-এ একজন প্রধান শিক্ষকের কথা ছিল। তিনি ক্লাসে ঢুকেই ছাত্রদের বলতেন, ওরে এসেছিস যখন তখন দেয়ালে একটা আঁচড় রেখে যা। তারপর নাকি রামমোহন বায়, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ এরকম অনেকগুলো নাম বলে রবীন্দ্রনাথে এসে সেই শিক্ষক স্তব্ধ হয়ে যেতেন, তার চোখ ছলছল করে উঠতো! তার কথার মত করে আমিও বলি, ব্লগে রেজিস্ট্রেশন যখন করেই ফেলেছেন, বাংলা ব্লগে একটা আঁচড় রেখে যান।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "...আমাদের কি কিছু বলিবার নাই? মানবসমাজকে আমাদের কি কোনো সংবাদ দিবার নাই?...আমাদের পদপ্রান্তস্থিত সমুদ্র কি আমাদিগকে কিছু বলিতেছে না? আমাদের গঙ্গা কি হিমালয়ের শিখর হইতে কৈলাসের কোনো গান বহন করিয়া আনিতেছে না? আমাদের মাথার উপরে কি তবে অনন্ত নীলাকাশ নাই?...আমরা কি কেবল আমাদের উঠানের মাচার উপরকার লাউ কুমড়া লইয়া মোকদ্দমা এবং আপীল চালাইতে থাকিব!"
ইচ্ছে হয় যে বলি - হ্যাঁ, আমাদের বলার মতো বেশ কথা আছে। মানবসমাজকে দেওয়ার মতো বার্তাও আছে কিছু। সমুদ্রের ভাষা আমাদের কানে যে নতুন কথা বলছে, হিমালয়ের চূড়া থেকে যে গান ভেসে আসছে, সেই গান দিয়ে আমরা ব্লগের পাতা ভরিয়ে দেব। মাথার উপরের অনন্ত নক্ষত্রবিথী আর নীলাকাশ আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হবে।
পাদটিকা: "বাহ্যে করা" কথাটি এখন প্রায় অপ্রচলিত হয়ে গেছে। এর অর্থ পরিপাকের মধ্যমে বর্জ্যের নিষ্কাশন। শব্দটি প্রথম নজরে পড়ে শ্রীমের লেখা "শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত" গ্রন্থে। মনে হয়েছিলো, বেশ তো, এই ক্রিয়া প্রকাশের জন্য এমন ভদ্রগোছের শব্দ বাংলাভাষায় তো আর একটিও নেই!