রানা একটা মেয়েকে প্রচন্ড ভালবাসত। মেয়েটির নাম মৌ। ফেসবুকে রানার বন্ধু সোহেল, মৌ এবং রানার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড ছিল। সেখান থেকেই রানাকে মৌ চেনে ও ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠায়। রিকোয়েস্টটা একদিন ঝুলেয়ে রেখেছিল রানা, এক্সসেপ্ট করবে কি করবো না এই ভেবে। রানা সোহেলের কাছে খোজ নিয়ে জানল মৌ ওকে যথেস্ট পছন্দ করে। শেষ মেস একসেপ্ট করেই ফেলল।
এর পর মেসেঞ্জারে রানাই প্রথম ওকে নক দিল। মেয়ে মানূষ সেধে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে আবার আগে নক দেয়ার মত নির্লজ্জ হয়ত হবে না এই ভেবে। এর পর টুকটাক চ্যাটিং, ফোনে রাত জেগে কথা বলা, দেখা করা, হাত ধরা, কেমন একটা প্রেম প্রেম খেলা। রানা ওকে তুমি করে বললেও মৌ রানাকে আপনি করে বলে। এভাবে দিন যায়, মাস যায় কিন্তু মৌ রানাকে ফরমালি ভালবাসার কথা বলে না। আর রানা বললেও এড়িয়ে যায়। রানার চাপাচাপিতে একসময় বলেই ফেলল দেখেন আপনার সাথে আমার কোন কমিটমেন্টে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি আমার বাবা মায়ের কথা ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। রানা বলল আমি কি তাহলে তোমাদের বাসায় প্রোপোজাল পাঠাবো? মৌ বলল লাভ নেই, এখন আমাকে বিয়ে দেবে না। তার কথা শুনে রানা পুরাই হতাশ। রানা বলে তাহলে এতদিন আমার সাথে এভাবে কথা, ঘোরা ফেরার মানে কি, যদি আমার প্রতি তোমার কোন ইমোশান ই না থাকে? সে বলে ইমোশান নেই তা না, আছে। আর আপনার সাথে কথা বলতে, সময় কাটাতেও আমার ভাল লাগে। কিন্তু আমি আপনাকে কোন কথা দিতে পারছি না। তবে আপনার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তার এই কথায় রানা যা বোঝার বুঝে ফেলল। এই মেয়ে শুধু তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। কিন্তু ভালবাসা এক নেশার মত, কিছুতইে পিছু ছাড়তে চায় না। রানা তারপর ও চেষ্টা করে যায় নানান উপায় যাতে মহারানীর মন গলে। শুধু একবার বলে ভালবাসি।
এদিকে রানার বাসা থেকেও বিয়ের জন্য চাপ আসতে থাকে, একটার পর একটা মেয়ের মেয়ের ছবি দ্যাখে আর নানান বাহানায় রিজেক্ট করে দেয়। কোন মেয়ের উপর ই আর মন বসে না। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কানা ঘুসা করতে শুরু করে দিয়েছে সে ছেলের রিলেশান আছে, কিন্তু রানা এই ব্যর্থ প্রেমের কাহীনি কাউকে কিভাবে বলে? রানা মৌয়ের পিছনে লেগেই থাকে, কিন্তু কাজ হয় না।
এভাবে বছর দুয়েক পার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে বিয়ের কথা বললে বা ভালবাসি বলার জন্য চাপ দিলে মৌ রাগ করে রানার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়, আবার তার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য কত কি করা লাগে। বার বার উপেক্ষিত হওয়ার মানুষিক চাপ, পারিবারিক ও সামাজিক এই চাপ যখন আর রানা নিতে পারছিল না তখন অনেক কষ্টে সিদ্ধান্ত নিল আর না। এবার এসব ছাড়তে হবে। এ মোহ থেকে আমাকে বের হতে হবে। আস্তে আশ্তে মন শক্ত করল রানা। এবার সব শেষ করার পালা। এর মদ্ধ্যে মৌয়ের পরীক্ষা শুরু হল। যতই মৌ রানাকে ভাল না বাসুক ব্রেকআপের কথা বললে ও নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। রানা সিদ্ধান্ত নিল মৌয়ের পরীক্ষা শেষ হলে তার পর মনের দুঃখ সুখের সব কথা বলে সরে আসবে। এরপর মৌয়ের মনে যদি ওর জন্য কোন অনুভূতি থাকে তো ফিরবে, নইলে না।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হল। পরীক্ষার পর ছুটিতে মৌ বাড়িতে গেল। রানার মনে হল এটাই সব চেয়ে ভাল সময়। বাবা মায়ের কাছে থাকায় ধাক্কা টা সহজে সামলে উঠতে পারবে। যতই মৌ রানাকে ভাল না বাসুক, রানা তো ওকে ভাল বাসে। ওর কোন ক্ষতি রানা করতে পারবে না। ওকে কষ্ট দিতে পারবে না।
যাক এরপর মন শক্ত করে রানা দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল হোয়াটস এয়্যাপে। চঠির সারমর্ম এমন- “তোমার অপারগতা সত্বেও আমি দীর্ঘদীন যাবত তোমাকে বিরক্ত করে আসছি যেটা আমার উচিত হচ্ছে না। আর যেহেতু তোমার আর আমার ভবিষ্যত আলাদা সেহেতু তোমার আর আমার এভাবে মেলা মেশাও উচিত না। তোমার হাত ধরে তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হবার অধিকার আমার না, অন্য কারো। যাকে তুমি বিয়ে করবে। আমি তার অধিকার হরন করতে পারি না। তোমার সাথে কাটানো এই দিন গুলি সত্যিই মধুর ছিল। এ দিন গুলির কথা আমি কোনদিন ভুলব না। তোমাকে এতদিন বিরক্ত করার জন্য পারলে ক্ষমা কোর।”
মেসেজ পড়ার পর মৌ রিপ্লাই দিল, যাক আপনি এতদিনে আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন। আপনার সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলি ভাল ছিল। ভাল থাকবেন। এর পর সে রানাকে ফেসবুক ফোন, হোয়াটস এয়্যাপ সহ সব মাধ্যমে ব্লক করে দিল। মেয়েটা যে হঠাত করে একটা শক খেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মৌ ভাবতেই পারেনি রানা এমন কিছু করতে পারে।
সব শেষ করার পর রানার ভিতর টা কেমন শূন্য মনে হচ্ছে। কিছুই ভাল লাছছে না। মনে হচ্ছে জীবন থেকে সব কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু রানা জানে হয়ত এর চেয়ে ভাল আর কিছুই হতে পারে না। তবুও প্রতিটা মুহুর্ত খুব বাজে ভাবে কাটে। মাঝে মাঝে মনে হয় আবার ওকে নক দেই। সব কিছু আগের মতই হয়ে যাক। কখনো মনে হয় মৌা যদি নক দিত? কিন্তু কিছুই হয় না। সময় কেটে যায়।
তিন দিন পর এক বিকেলে সোহেল রানাকে কল দিল। বলল, তোমার পাখি তো আমাকে ফোন দিছিল, তুমি নাকি তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ কইরা দিছ? রানা বলল হ রে দোস্ত প্রেসার আর নিতে পারতেছিলাম না। তো কি কইল?
সোহেল- তেমন কিছু না জাস্ট কইল তুই কি মেসেজ দিছোস, দিয়া যোগাযোগ বন্ধ কইরা দিছোস। এর পর আমি কইলাম তা তো ঠিক ই করছে, তুমি দুই বছর ধইরা ছেলেটাকে ঘুরাইচেছ, টাইম পাস করতেছ, ও যে কি পরিমান প্রেশারে আছে সেটা চিন্তা করছ কখনো? আমার এই কথা শুইনা কইল হ আমি টাইম পাছ করতেছি, কইয়া ফোন কাইটা দিল।
সোহেলের এই কথা শুনে রানার মনের মধ্যে ভিষন আলোড়ন শুরু হল। রানা ভাবছে, মেয়েটা কি সত্যিই আমাকে ভাল বাসে? রানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে এখনি মৌকে কল করে বলি সোনা আমার ভুল হইছে। কিন্তু পারে না। কিছুটা ইগো, কিছুটা হেরে যাওয়ার ভয়। আবার মনে হয় ও কোনদিন আমার হবে না। এটা হয়ত সাময়িক আবেগ বা আমার দিক থেকে না বলায় জেগে ওঠা ইগো।
তবুও কেন যেন রানার মনে হচ্ছে ও খুব তারাতারি রানার সাথে যোগাযোগ করবে। সব কিছুই আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এর ২ দিন পর মেয়েটার কাছ থেকে লম্বা একটা এসএমএস আসল, যার সারমর্ম সব দোষ আমার। সে আমার সাথে টাইম পাছ করে নাই, আমি যেন তার সাথে আর যগাযোগ না করি। রানার ফোন নম্বর ডিলিট করে ফেলায় সোহেল কে ফোন করেছিল, এখন ঢাকায় ফিরে নোট বুক থেকে রানার ফোন নাম্বার নিয়ে এস এম এস করেছে।
রানার মনে আশার আলো উকি দিল। সাথা সাথেই মৌকে রিপ্লাই করল- হ্যা সব দোষ আমার। কিন্তু তুমি আমার সাথে দেখা কর। তোমার সাথে আমার খুব গুরুত্বপূর্ন কথা আছে। কিন্তু মৌ রাজি হয় না। যাই হোক এস এম এস এর পর এস এম এস দিয়ে মৌকে দেখা করার জন্য রাজি করাতে পারল। যেহেতু সে রানাকে ফোনে ব্লক করে রেখেছিল, ফোনে কথা বলার সুযোগ ছিল না।
একটি শপিং মলে ওরা দেখা করবে বলে ঠিক হল। রানা একটু আগেই পৌছে গেল। অপেক্ষার এক পর্যায়ে তিনি এলেন। মুখ ভার। রানা মৌ এর সাথে খুব একটা কথা বলে না, কখন বিস্ফোরন ঘটে এই ভয়ে। সে বিভিন্ন দোকানে ঘোরাঘুরি করতে থাকে, রানাও তার সাথে ঘুরতে থাকে। কেউ কারো সাথে খুব একটা কথা বলে না। মৌ আশা করে রানা সব দোষ স্বীকার করে সরি বলবে আর তখন সে রানাকে ঝাড়ি মারবে। কিন্তু প্রায় আধ ঘন্টা এভাবে চলার পর মৌ অধৈর্য হয়ে যায়। রানাকে জিজ্ঞেস করে কিছু বলছেন না কেন? কি কথা বলার জন্য এখানে আসছেন? রানা উত্তর দেয় কিছু বলার জন্য তো আসি নি, তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হল তাই আসছি। এক সময় মৌ বলল চলেন কোথাও বসি। রানা বলল চল। ওরা একটা রেস্টুরেন্টে বসল। মৌ আস্তে আস্তে ইজি হচ্ছে। খাবার ফাঁকে রানা মৌকে খাবার মুখে তুলে খাইয়ে দিল। মৌ কোন রিয়াক্ট করল না। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল। এর মধ্যে বিকাল প্রায় শেষ। রানা বলল চল তোমাকে হলে পৌছে দেই।
ওরা একটা রিক্সা নিল। রিক্সা মৌয়ের হলের দিকে চলছে। বাতাসে মৌয়ের খোলা চুল গুলি উড়ছে, মাঝে মাঝে অবাধ্য চুল গুলি উড়ে এসে রানার চোখ মুখ ঢেকে দিচ্ছে। শেষ বিকেলের হলুদাভ আলো টা মৌয়ের মুখে লেগে মুখটা ঝলমল করছে, ওকে দাড়ুন লাগছে। রানা ওর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, চোখ ফেরাতে পারেনা। মৌ গুন গুন করে গান ধরে। রানা মৌয়ের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নেয়। মৌ হঠাত রানার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলে কি দেখছেন? রানা কাচু মাচু করে বলে তোমাকে। মৌ বলল আমাকে দেখা লাগবে না, আমার দিকে তাকাবেন না। রানা সামনের দিকে মুখ ঘোরায়। হঠাত মৌ রানার গালে টুপ করে একটা চুমু খেল। রানা ওর দিকে ফিরে দেখে ও অন্য দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। রানা আর কিছু বলল না, শুধু ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। শেষ বিকেলের এই আলোয় ওকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। রানার শুধু মনে হচ্ছে- পাইলাম, আমি ইহা পাইলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৩