আজগর সাহেব মাঠের এক কোনায় চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছেন। মাঠে ছেলেদের ৭/৮ টা গ্রুপ খেলছে। এই শহরে বাচ্চাদের খেলার জায়গার বড় অভাব। এইটুকু জায়গায় এতগুলি ছেলে খেলছে যে, কে কোন গ্রুপ্রে খেলছে বোঝা মুশকিল। তবুও আজগর সাহেব প্রতিদিন বিকেলে এই মাঠের পাশে এসে দাড়ান। ওদের খেলা দেখেন। দেখতে খুব ভাল লাগে। বিকালটা এভাবেই কেটে যায়।
আজগর সাহেবের বয়স প্রায় ৬০। একা মানুষ, নির্ঝঞ্জাট। মাঠ থেকে একটু দূরেই একটা বাসা নিয়ে থাকেন। জীবনে বিয়ে থা করেননি। বৌ ছেলে মেয়ে নেই। কাছের আত্মীয় বলতে একটা ছোট ভাই আর বোন। তারাও প্রায় ২৫ বছর যাবত পরিবার সহ বিদেশে থাকেন। ভাই জার্মানীতে আর বোন অস্ট্রেলিয়াতে। ওখানেই সেটেল্ড। ৩/৪ বছর পর পর একবার দেশে আসেন, সপ্তাহ খানেক থাকেন আবার চলে যান। আর আসলেও তারা স্বসুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আজগর সাহেব ওদের খুব একটা কাছে পান না। মাসে যদিও দু একবার ফোন করে ওরা আজগর সাহেবের খোজ খবর নেন, তবে সেটা খুবই ফরমাল কথা বার্তা। মাঝে মাঝে আজগর সাহেবের পুরনো দিনের কথা গুলি মনে পরে। ভাই বোনদের সাথে খেলা, ঝগড়া, শাসন, তার কাছে ওদের আবদার আরো কত কি। খুব মিস করেন সেই দিন গুলি, তখন তার মনটা বিষন্নতায় ভরে যায়। সময়ের সাথে সবকিছু কিভাবে বদলে যায়!
এক সময় আজগর সাহেব চাকরী করতেন, প্রাইভেট চাকরী। তার বয়স যখন ৫০ তখন সবকিছুর উপর তার একটা বিতৃষ্ণা এসে যায়। তিনি সব ছেড়ে ছুড়ে বেড়িয়ে পরেন। ঘুরে বেড়ান দেশের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। ঘুরতে ঘুরতে যেখানে ভাল লাগত সেখানেই তার ঘাটি গাড়তেন। ২/৩ মাস থাকতেন তারপর আবার নতুন কোথাও। এক সময় তার শরীর ভেঙে পরল। আগের মত আর অনিয়ম শরীরে সহ্য হয় না। ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ সহ বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বেধেছে তত দিনে। হাতের টাকা পয়সায় ও টান পরল। তখন ভবঘুরে জীবন ত্যাগ করে বছর পাঁচেক আগে এখানে থিতু হয়েছেন। নিজের জমানো যা ছিল তার সাথে পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে যা পেয়েছেন তাই দিয়ে তার চলছে। এখন আর কাজ বলতে কিছু করেন না, শুধু সকাল বিকাল আশে পাশে ঘুরে বেড়ান আর স্মৃীতির জাবড় কাটেন।
আজগর সাহেবের দেখা শুনা করার জন্য একটা লোক আছে। মানিক তার নাম। আজগর সাহেব তার নিজ এলাকা থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন। বয়স ৩৫। মানিক ও তার মত একা, কোন পিছুটান নেই। দুজন মিলে চিলে কোঠার একটা বাসায় ভাড়ায় থাকেন। বাসায় ৩টা ঘর আর সামনে খোলা ছাদ। বাসাটা আজগর সাহেবের চমতকার লাগে। পাঁচ বছর ধরে একই বাসায় আছেন, বদল করার কোন চিন্তাও নেই।
আজগর সাহেবের প্রাত্যহিক জীবন বলতে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মসজিদে নামাজ পড়া, তারপর মাঠের চারপাশে ঘন্টা খানেক হাটা। এখানে শুধু আজগর সাহেব একাই হাটেন না, এলাকার আরো অনেক পুরুষ মহিলা হাটাহাটি করেন। এখানে প্রতিদিন যারা আসেন তারা প্রায় সবাই আজগর সাহেবের পরিচিত। এদের মদ্ধ্যে অনেকের সাথে তার সম্পর্ক বেশ গভীর। হাটাহাটির ফাকে যখন তারা বিশ্রাম নেন তখন তারা আড্ডায় মেতে ওঠেন। ফেরার পথে মোড়ের টং দোকানে একসাথে চা খান দেশ, বিদেশ, সংসার, রাজনীতি নিয়ে আলাপ করেন। এরপর বাজার করে বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরে পত্রিকা দেখতে দেখতে বা টিভি দেখতে দেখতে দুপুর চলে আসে, ওদিকে মানিক রান্না শেষ করে। খাওয়ার পর আজগর সাহেব একটু ভাত ঘুম দেন। এরপর উঠে মসজিদে যান। আছরের পর আজগর সাহেব এই মাঠে আসেন। বাচ্চাদের খেলা দেখেন, হৈ হুল্লোর উপভোগ করেন। এই সময়টা আজগর সাহেবের খুব ভাল লাগে। এই ঢলে পরা রোদ, হাল্কা বাতাস, বা্চ্চাদের উচ্ছাস আজগর সাহেব কে নিজের ফেলে আসা শৈশব কৈশোরে নিয়ে যায়। মাগরিবের নামাজের পর আজগর সাহেব আবার এখানে হাটেন ঘন্টা খানেক তার পর এশার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরেন। এভাবেই কেটে যায় তার দিন। তবে মাঝে মাঝে যে ব্যাতিক্রম হয় না তা নয়।
আজগর সাহেব ইদানিং খুব তাড়াতাড়ি বিছানায় যান, কিন্তু ঘুম সহজে আসে না। শুয়ে শুয়ে তিনি ফেলে আসা জীবনের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করেন। কোন কোন দিন হিসেব মেলে, কোন দিন মেলে না। পুরোনো দিনের স্মৃীতি গুলো মনে পরে। মনে পরে তার ভালবাসার পরীর কথা। কোন একদিন তিনি ও পরী একে অপরকে কথা দিয়েছিলেন তারা দুজন দুজন কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। আজগর সাহেব কথা রেখেছেন কিন্তু পরী কথা রাখেনি। ব্যবসায়ী ধনী পাত্র দেখে বাবার কথা মত বিয়ের পিঁঢ়িতে বসে পরেছে, নিজের ভবিষ্যত নিয়ে কোন ঝুকি নেয় নি।
প্রায় ১৮ বছর পরে, বছর দশেক আগে শেষবার পরীর সাথে আজগর সাহেবের দেখা হয়েছিল বসুন্ধরা সিটিতে। প্রথম দেখাতেই চিনে ফেলেছিলেন। ওর চোখ দুটো আগের মতই মায়াবী, হাসিতে দুস্টুমি। হয়ত আগের চেয়েও আর একটু সুন্দরী হয়েছে। সুখে থাকল নাকি চেহারায় জেল্লা আসে। এক ছেলে, এক মেয়ে, স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখেই আছে। দামী শাড়ি, গয়না, গাড়ি, বাড়ি, অভাব বিহীন জীবন। সুখে তো থাকবেই। আজগর সাহেবের সাথে কথা বলার সময় চেহারায় কেমন তাচ্ছিল্লের একটা ভাব ছিল। যে মেয়ে এক সময় তার বুকে মাথা রেখে পরম নিশ্চয়তা পেত তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আজগর সাহেবের হজম হয় নি। তাই এরপর আজগর সাহেব সন্যাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন। আচ্ছা পরী কি আসলেই সুখে আছে? আজগর সাহেব পরীর সাথে দেখা করার পর ফেরার সময় যখন পেছন ফিরে তাকিয়েছিলেন তখন পরীর মলিন চেহারাটা আর বিষন্ন চোখ দুটিই দেখতে পেয়েছিলেন। পরী কি আসলেই ভাল আছে না সবই ভাল থাকার অভিনয়?
আজগর সাহেব ও যদি ওয়াদা ভুলে অন্য কাউকে নিয়ে ঘর বাঁধতেন, তবে হয়ত তারও একটা সুখের সংসার থাকত, বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতেন। এই নিঃসঙ্গ একাকী জীবন হয়ত কাটাতে হত না। কিন্তু আজগর সাহেব তা পারেন নি।
বিকেলের সূর্য পুরোপুরি ঢলে পরেছে। ছেলেরা খেলা শেষ করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। মসজিদ থেকে আজানের করুন সুর ভেসে আসছে। হঠাত করেই করেই যায়গাটা কেমন ফাকা হয়ে গেছে। পরন্ত বিকেলের এই সময়টা আজগর সাহেবের একদম ভাল লাগে না। এই সময়টা যেন তার মতই নিঃসঙ্গ, একাকী। আজগর সাহেব মসজিদের দিকে হাটছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৫:৩০