বিশ্বব্যাপী জনসাধারনের আয়ত্বে ইন্টারনেটের আগমন যখন ঘটে ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে, তখন থেকেই দিনে দিনে ওয়েবসাইট নির্মান সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠেছে। এর সাথে সাথে তৈরী হয়েছে নানা বিজনেস মডেল বা ব্যবসায়িক কৌশলের।
সফটওয়ার কোম্পানিগুলো আগে ব্যবসা করতো সফটওয়ারকে পণ্যের মতো কেনা বেচা করে। কিন্তু ইন্টারনেট আসার সাথে সাথে নতুন কৌশল আসে - ওয়েবসাইটভিত্তিক সার্ভিস। ব্রাউজারের মাধ্যমে ওয়েবমেইল, মেসেঞ্জারের মাধ্যমে চ্যাট - এসবের পাশাপাশি হালে শুরু হয়েছে ওয়ার্ড প্রসেসর, স্প্রেডশীট, প্রেজেন্টেশন - এই সবগুলোকেই ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হাতের নাগালে এনে দেয়া।
প্রথম দিকে এরকম সেবাদাতা সাইটগুলো নগদ পয়সা ছাড়া সেবা দিতে নারাজ ছিলো। মনে আছে, এক সময়ে ইয়াহু মেইলে ফ্রি দিতো ৬ মেগাবাইট, আর পয়সা দিলে ২০ মেগাবাইট। এর বেশি অল্প গেলেই মেইল বাউন্স শুরু করতো। কোম্পানীগুলো প্রথমে ভেবেছিলো, "ফেলো কড়ি, মাখো তেল" - এই পদ্ধতি ওয়েবদুনিয়াতেও কাজ করবে।
কিন্তু দেখা গেলো, প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিনা মূল্যে অনেক সার্ভিস দিতে শুরু করেছে। আম-জনতাও বোকা না - সার্ভিস পেতে হলে টাকা দিতে হবে, টাকা না দিলে মুখ বন্ধ করে সার্ভিস দাতা কোম্পানির হম্বি তম্বি স্বৈরাচারী আচরণ সব সইতে হবে - সে যুগ আর নেই। ইয়াহুর পয়সা নেয়া ইমেইলের প্রতিদ্বন্দ্বী সার্ভিস হিসাবে এলো গুগলের জিমেইল, বিনা মূল্যে বিপুল জায়গা দিলো। "দাও টাকা, নইলে ইমেইল মুছে দিলাম", "টাকা দাওনা তো সার্ভিস চাও কেনো" - এরকম মানসিকতার সব সাইট রাতারাতি ধরা খেলো।
২০০০ সালের দিকের ডট কম বিপর্যয়ের পরে এখন সব কোম্পানিই সাবধানী হয়ে গেছে। ইউজারেরাই এখন নমস্য - তাদের খুশি রাখতে পারলেই যে আয় হবে কোনো না কোনো ভাবে, সেটা এখন সবাই বোঝে। তাই এখন খোদ মাইক্রোসফটও অফিস লাইভের মাধ্যমে তাদের অনেক সার্ভিস দিচ্ছে বিনা মূল্যেই।
---
এতো কথা মাথায় আসলো আসলে গত সপ্তাহের এক বক্তৃতা শুনে। ইন্টারনেটে অনেক কিছুরই পথিকৃত ইয়াহু!র একটা রিসার্চ সেন্টারও আছে, সেখানে ওয়েব প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলে। সেই ইয়াহু রিসার্চের প্রধান বিজ্ঞানী প্রভাকর রাঘবন গত সপ্তাহে ইয়াহুর ব্যবসায়িক কৌশলে ব্যবহার করা প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুগলের মতো ইয়াহুর মূল আয়টি আসে বিজ্ঞাপন থেকে। সার্চ করার সময়ে মূল ফলাফল বামে আসে, আর পাতার একেবারে ডানদিকে কিছু সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন দেখা যায়। ১০০ জনে দুই এক জন হয়তো সেখানে ক্লিক করে। তখন বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানি ইয়াহুকে কিছু পয়সা দেয়। অল্প মনে হলেও কোটি কোটি সার্চ দিনে করা হয়, কাজেই মোট হিসাবে পরিমাণটা কম না। বিলিয়ন ডলারের কোঠায় দাঁড়ায় সেটা।
বিজ্ঞাপনগুলো আবার নিলামের মতো, যে কোম্পানী বেশি টাকা দিবে বিজ্ঞাপনে, তাদের বিজ্ঞাপনকেই আগে দেখাবে।
তো, একজন প্রশ্ন করলো ডঃ রাঘবনকে, বিজ্ঞাপনে ক্লিক করাতে যদি পয়সা পাওয়া যায়, তাহলে ইয়াহু! বামদিকের সার্চ রেজাল্টের সাথে বিজ্ঞাপন মেশাচ্ছেনা কেনো? ওখানে সার্চের ফলাফল হিসাবে খোঁজ করা শব্দগুলোর সাথে সম্পর্কিত সাইটের লিংক না দেখিয়ে, যারা টাকা দিচ্ছে বিজ্ঞাপনে, তাদের লিংক দেখালেই তো চলে। ইউজারেরা তো মাগনা মাগনা সার্চ করছে, ওদের পাত্তা দেয়ার দরকার কী? এমনি এমনি ফ্রি রেজাল্ট পাচ্ছে, সেই রেজাল্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন না আসল রেজাল্ট, তা নিয়ে ইউজারেরা কথা বলার অধিকার রাখবে কেনো!! না পোষালে অন্য সাইটে যেতেই পারে। ইয়াহু নিজের যাতে লাভ, তা করলেই পারে।
জবাবে ডঃ রাঘবন বললেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রস্তাব আসেনি তা না। কিন্তু ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা যাক - ইউজারদের জন্যই তো বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দেবে। সেই ইউজারেরা যদি সন্তুষ্ট না হয়, তাদের কাংক্ষিত সার্চ ফলাফলের বদলে যদি বিজ্ঞাপন পান, তাহলে ইয়াহু হয়তো আজকে কিছু বিজ্ঞাপনের পয়সা পাবে। কিন্তু এই অতৃপ্ত ও অসন্তুষ্ট ইউজার ইয়াহু দিয়ে আর পরে সার্চ করবে না। ফলে আখেরে ক্ষতিটা হবে ইয়াহুরই ... ইউজারেরা না আসলে বিজ্ঞাপন দাতারাও চলে যাবে।
কাজেই ইয়াহুর (এবং গুগলেরও) নীতি হলো, ইউজারদের নমস্য বলে জ্ঞান করা, তাদের খুশি রাখা। ইউজারদের খুশি রাখলে বিজ্ঞাপন দাতারা সেই ইউজারদের টানেই আসতে থাকবে।
তাই আজকের ওয়েব দুনিয়াতে ইউজাররাই হলো নমস্য - ওয়েবসাইটের প্রাণই হলো ইউজারেরা। বিনা মূল্যে সার্ভিস নিলেও তাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্যেই ওয়েবসাইটগুলো করে চলে প্রাণপণ চেষ্টা, তা হয়তোবা অনেকটা নিজেদের স্বার্থেই।
----
বিশেষ দ্রষ্টব্য - লেখাটির সাথে এই ব্লগ সাইট বা অন্য কোনো সাইটের আচরণের বা ব্যবসা-কৌশলের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো মিল খুঁজে পেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়, ও তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১:৫৩