একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘবরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ।
হ্যাঁ, এই ভাটি অঞ্চলেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই। পুরো অঞ্চলটাই হাওর এলাকা হিসেবে পরিচিত। বিখ্যাত হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার পাশেই এর অবস্থান। কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম এর পুরোটা, নিকলী, তাড়াইলও করিমগঞ্জের কিছু অংশ, নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ী, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের কিছু এলাকাজুড়ে এই হাওর বিস্তৃত। বর্ষায় বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে মহাসাগরের রুপ নেয়। আমাদের স্কুলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে উত্তরদিকে তাকালে একেবারে মেঘালয় সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় দুইশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধু পানি আর পানি। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
সুরমা নদীর একটি অংশ ধনু নদী নামে অবিভক্ত বাংলার প্রথম ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসুর জন্মস্থান ইটনা উপজেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ব্যাপক ধান চাষ হয়। শুধুমাত্র এই ফসলটির উপর এই অঞ্চলের প্রায় দেড় কোটি মানুষ নির্ভরশীল। এই বিশাল এলাকাজুড়ে সেচ দেয়ার জন্য একমাত্র এই নদীটিই ভরসা। বরাক নদীতে বাঁধ নির্মিত হলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলের মানুষজনের উপর। হুমকির মুখে পড়বে সুরমা ও কুশিয়ারা সহ মেঘনা নদীর অববাহিকা। কারণ সিলেটের অমলসিদ পয়েন্ট থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বরাক নদী। একটি ভাগের নাম হলো সুরমা, অন্যটি কুশিয়ারা। ৩৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমা ও ১১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুশিয়ারা নদী হবিগঞ্জের মারকুলির কাছে প্রথমে কালনী নামে, পরে মেঘনা নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছে।
আমাদের এখানে যা ধনু নামে পরিচিত। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে মেঘনা অববাহিকায় পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যাবে। এই বাঁধের ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে এই অঞ্চলের প্লাবনভূমি। স্বাভাবিক মৌসুমে প্লাবনভূমিতে পানি পাওয়া যাবে না। উজানে বাঁধ নির্মাণ করার ফলে প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরণ, মওসুম এবং পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ বর্ষাকালে পুরো অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ফলে যে পরিমাণ পলি আমাদের কৃষিজমিতে পড়ে তখন এর মাত্রা অনেক কমে যাবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উর্বরতা হারাবে কৃষিজমি। সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুষ্ক হওয়ার ফলে কমপক্ষে ছয়টি জেলা- সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণায় ধান উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীমহোদয় বলেছেন- দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। টিপাইমুখ বাধের প্রভাব আলোচনার টেবিলে আমরা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে তারা অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনা করবে। কিন্তু এই আলোচনা কখন হবে? বাঁধ নির্মাণ করার পর? নাকি আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের যাবতীয় অন্যায় আচরণ মেনে নেয়ার দাসখৎ দিয়েছে ?মুখ্যমন্ত্রী হাসিনাতো আবার দাদাগোরে খুব ভালা পায়।
টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে এই ব্লগের কিছু প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক, তথাকথিত দেশপ্রেমিক ব্লগার আশ্চর্যরকমভাবে নীরব। অথচ আওয়ামী লীগ-বিএনপি, আস্তিক-নাস্তিক, ব্লগীয় ক্যাঁচাল এইসব ফালতু বিষয় নিয়ে ওনাদের মাতমাতির অন্ত নেই। কাকে কিভাবে হেনস্তা করা যায় কেবলি এই চিন্তা। প্রকাশ্য দলাদলি করে কিভাবে ব্লগের পরিবেশ অস্থির করা যায় সেই চেষ্টা। মাত্র গুটিকয়েক ব্লগার এই বিষয়ে নিয়মিত লিখছেন। এদের মধ্যে ধীবর, বাবুয়া, দিনমজুর, ফকির ইলিয়াসসহ ও আরো নাম না জানা কয়েকজন আছেন।
আর সেইসব ব্র্যান্ডেড ব্লগাররা কিভাবে মডারেশন নিজের দলের পক্ষে নেয়া যায়, কিভাবে দলীয় গালিবাজগুলোকে বিপক্ষশক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় সেই ছক কষতে ব্যস্ত। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে কিছু করার বা বলার এখনই হলো মোক্ষম সময়। ব্লগে লিখলেই যে কিছু হয়ে যাবে তা নয়, কিন্তু একেবারে যে কিছু হবে না তাও নয়। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর অভিযান এই ব্লগের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। যা পরবর্তীতে বিশাল জনসমর্থন পেয়েছে। তাই আপনারা যারা এই ব্লগের অনেকের আদর্শ, যাদের লেখনী ধারালো তারা এর বিভিন্নদিক ব্যবচ্ছেদ করে নিয়মিত লিখুন। যারা যতো বেশী জ্ঞানী সমাজে তাদের দায়বদ্ধতাও ততো বেশী। রোমান্টিক বিপ্লবী চে গুয়েভারার একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছেন- Yesterday was too early, tomorrow is too late, the time is today.
আসুন আর কালক্ষেপণ না করে এখনই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।