ব্লগের সবচেয়ে স্বাধীন জিনিস টি হলো এখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা যায়। কারো ভালো না লাগলেও। আমি এই কারণে যাচ্ছেতাই লিখি। বেশীর ভাগ সময়ই পড়ি। বলতে গেলে আমার শিক্ষকতা জীবনের এখন ভোর বেলা চলছে। হাটি হাটি পা করে শিখছি। ব্লগে হয়ত এই লেখাগুলো দেয়ার কারণ হলো কেউ যদি কোন উপায় বাতলে দেন আর আমি তা প্রয়োগ করে আমার শিক্ষকতা জীবন সহজ করতে পারি তাইই। এছাড়া লিখলে নির্ভার হয়ে পড়ি। মনে হয় যেন খুব একটা বোঝা নেমে গেলো অনেকদিনের।
যাই হোক। আমি খুব এলোমেলো লিখব। যেহেতু ভাল লেখক নই। কেউ পড়ে বিরক্ত হলে আমি খুব দুঃখিত। আজকের ঘটনা দিয়ে শুরু করার আগে বলে রাখি আমি একজন সনাতন ধর্মালম্বী। আমার কর্মস্থল একটি গহীন গ্রামের জনপ্রিয় স্কুলে। এখানে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই বাস। সংগত কারনেই আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক উভয় ধর্মেরই শিক্ষার্থী রয়েছে। আমি প্রায়ই একমাত্র হিন্দু শিক্ষক হবার কারণে একটা অভিযোগ পাই তা হলো কোন মুসলমান শিক্ষার্থী হিন্দু কোন শিক্ষার্থীকে ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছে। বেচারিরা খুব মন খারাপ করে এসে আমার কাছে অভিযোগ জানায়। আমি তাদের বলে বলে ক্লান্ত হই যে, ধর্ম হচ্ছে একটি হীরার মতো তাকে যতই নোংরা জল দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হোক না কেন তা হীরাই থাকবে এবং তোমার ধর্ম তোমার কাছে তাইই। থাক, ওরা বুঝে বলেনি। আমি এখন পর্যন্ত কোন মুসলিম শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এমন অভিযোগ পাইনি।
আজ একটু ব্যাতিক্রম ঘটনা ঘটে গেলো আমার জীবনে। বিভিন্ন কাজের জটিলতায় চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসের ধর্মের ক্লাসটা আমার নিতে হয়েছে। আমি প্রথমে বললাম, যেহেতু সংখ্যায় কম , তাই আগে ওদের টা পড়ে শোনাই। মুসলিম শিক্ষার্থীরা না না বলে চিৎকার করতে লাগলো। আমিও অযোগ্য শিক্ষক হিসেবে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেও ওদেরকে থামিয়ে একটি অধ্যায় পড়ানো শুরু করতেই একটু পর দেখলাম অন্যেরা কানে হাত দিয়ে বসে আছে। এর মধ্যে আমার প্রিয় একজন মেধাবী ছাত্রী এবং আমারই সিনিয়র শিক্ষিকার মেয়েও রয়েছে। আমার ধর্মের কথা অন্য ধর্মের মানুষ শুনতে চাচ্ছেনা তা আমায় কোনদিনই বিচলিত করেনি। আমায় যা আহত করেছে তা হলো এই কক্ষে আমার কিছু হিন্দু শিক্ষার্থীও রয়েছে। ওদের এই কোমল মনের আঘাতটার ব্যাপারে আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষায় আলাদা ধর্মের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়না। সেহেতু তা যেকোন শিক্ষককেই পড়াতে হবে। যেহেতু শিক্ষকতা আমার ধর্ম সেহেতু আমার কোন শিক্ষার্থী কোন ধর্মের তা আমার ধর্তব্যের বিষয় হতেই পারেনা। প্রায় দুদিন পর পর অভিযোগ পাচ্ছি। একমাত্র সনাতন ধর্মালম্বী শিক্ষক বিধায় এবং নবীন বিধায় তা নিয়ে আমি শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় আগ্রহী নই। এর আরেকটি কারণ হতে পারে আরো কিছু ঘটনা। যেমন, আমি আসসালামুয়ালাইকুম অর্থ জানি, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তাই সবাইকে অনেক আগে থেকেই সালাম দিতাম। গড ব্লেস ইউ , যেহেতু একই অর্থ বহন করে। আমার প্রধান শিক্ষিকা একদিন ডেকে আমাকে তা দিতে নিষেধ করলেন। এরপর থেকে আদাব দিতে শুরু করলাম। কিছুদিন বাদে খেয়াল করলাম, আমার আদাবের বিপরীতে আমার প্রানপ্রিয় শিক্ষক শিক্ষিকাগণ মাথাও নাড়াচ্ছেন না। এরপর থেকে কি করা উচিত বুঝতে না পেরে ,কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করেই ক্ষান্ত হতে শুরু করি। আমি যখন ছাত্র ছিলাম আমার একজন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন নুর হোসেন স্যার । যাকে আমি এখনো দেখা হলে পা ধরেই সালাম করি। তিনিও গর্ব করে বলেন যে আমি তার প্রিয় ছাত্র। যাকে দেখেই আমি শিক্ষক হব মাথায় ঢুকে গিয়েছিল।
আমি ঠিক জানিনা গত ১৪ বছরে এদেশে এমন কি হয়েছে যে এত বিদ্বেষের ফেনা বয়স্ক থেকে শুরু করে কচিকাচার ভেতরেও চলে এসেছে? গত ১৪ বছরে ফেসবুক ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে যা ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম বলে আমি মনে করি। আমি যদি নূর হোসেন স্যারের মতো একজন আদর্শ শিক্ষক হতে পারি তাহলে কি আমার মুসলিম শিক্ষার্থীরা আমার পা ছুতে চাইবে নাকি অন্য ধর্মের বলে এড়িয়ে যাবে? আমি কি আমার ধর্মের ভিন্নতার কারণে ওদের মনে জায়গা করতে পারবনা? প্রশ্নগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু আমাকে তো শিক্ষক হতে হবে, অনুসরণ করতে হবে আমার মন্ত্র খানা।
"একজন সাধারন শিক্ষক পড়ান
একজন ভাল শিক্ষক ব্যাখ্যা দেন
একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক শিশুদের অনুপ্রাণিত করেন।"
- কারলাইন্স।
থ্যাংক গড। আমার শিক্ষার্থীদের ধর্ম, বর্ণ, অর্থনৈতিক অবস্থা আমাকে তিল পরিমাণ দ্বিধায় ফেলেনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০২২ রাত ৯:২২