আজ এমন এক বিপ্লবীর গল্প বলব যাকে আপনারা অনেকেই চিনেন না । তিনি সিরাজ শিকদারের মত ভুল বিপ্লবের বাঁশীওয়ালা কিনা সেটা আমার বিচার্য নয় ।আমি শুধু বিচার করছি একজন মানুষকে । হাজারো অমানুষের ভীড়ে একজন সত্যিকারের মানুষকে ।
সেই বিপ্লবীর পথ থেকে দুরে সরে এসেছি বহু আগেই ।কিন্তু সেই যে কৈশোরের প্রথম প্রেমের মতই তার গান আর সুরের ঝংকার আমার হৃদয়-মনে করে নিয়েছে আলাদা জায়গা তা দখল করার মত এতদিনেও কিছু পাইনি আমি ।
সুরের অনেক যাদুতে মুগ্ধ হয়েছি আমি । তবু কবি মতিউর রহমান মল্লিকের জন্য একটা আলাদা যায়গা আমার মনে সব সময়ই থেকে গেছে । তার পথ থেকে সরে গেলেও তার গান আছে আগের যায়গাতেই ।নজরুলের পরেই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ভাবধারার গানে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের স্থান ।
প্রথম তার যে গানটি শুনেছিলাম সেটা ছিল একটি হামদ ।গানটার কয়েকটা লাইন এরকম-
“তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন
ভরে যায় তৃষিত অন্তর ॥
————————-
যে মানুষ মানুষের বেদনায়
কেঁদেছিলেন আজীবন মদিনায়
সেই মানুষ হয় যদি এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর ।।”
তিনি বাংলাদেশের মাটিতে হেরার রাজ বুননের স্বপ্ন দেখেন । তার জীবনের পরতে পরতে লেগে আছে সেই আকাংখা বাস্তবায়নের চেষ্টা ।তার গানেও দেখতে পাই-
“আমার গানের ভাষা জীবনের সাথে যেন মিলে মিশে হয় একাকার
নিস্ক্রীয় হয়ে গেছি বলতে না পারে কেউ ব্যাথা ভরা কথাগুলো তার
———————————–
যে পথে চলার নেশা ধরেছিল একদা আমাকে
সে পথের মঞ্জিল আমরণ যেন মোরে ডাকে
নতুন দিনের সেই স্বপ্নলগন মন সবপ্রিয় থাকে অনিবার ।”
৮১/৮২ সালের দিকে যখন শিবিরে ভাঙ্গন হয় সে সময় পুরো খুলনা অঞ্চল চষে বেড়িয়েছিলেন তিনি । তার প্রচেষ্টাতেই আবার ধীরে ধীরে শিবির ঐসব অঞ্চলে আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠে । একটি মাত্র পাজামা আর পাঞ্জাবী ছিল সে সময় তার । সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে রুমে ফিরে লুঙ্গি পরে পাজামা পাঞ্জাবী ধুয়ে দিতেন- পরদিন আবার বেরিয়ে পড়তেন দ্বীনের কাজে ।জামাতের মত একটি সংগঠন যে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার কারণ বোধ হয় মল্লিকদের মত কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষ ।তার সে সময়ের একটি গানে ফুটে উঠেছে তার অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা-
“একজন মুজাহিদ কখনো বসে থাকেনা
অর্থ-বিত্ত নাইবা থাকলো তার
নাইবা থাকলো সাজানো সম্ভার
তবুও সে হয়না হতাশ মুষড়ে পড়েনা ।”
আমার ধারনা ছিল তার কবিতা-গানে শুধু ইসলাম প্রেমের বিষয়ই স্থান পেয়েছে । সেখানে দেশপ্রেম অনুপস্থিত ।কিন্তু আমার সে ধারনা ভেঙ্গে যায় তার কিছু কবিতা পড়ে । একটি কবিতায় তিনি বলছেন-
“সিডর দিয়েছে ডর
বিপন্ন অন্তর
সিডর দিয়েছে স্বজন-হারানো গুমরিত প্রান্তর
দিয়েছে করুণ মৃত্যুর হাহাকার
দিয়ে গেছে খুলে ভয়াল সিডর
বেদনার যত অশ্রুসিক্ত দ্বার
আর দিয়ে গেছে বুকফাটা চিৎকার
ধস্ত বিরান বিবর্ণ সংসার।
———————-
দু-হাজার সাত তছনছ-করা
এলো উদ্মাদা ডর
ভয়ের চেয়েও ভয়ানক ভয়
সিডর ভয়ংকর।”
এমনি আরো অনেক কবিতায় তার দেশপ্রেমের বিষয়টি ফুটে উঠেছে । আল্লাহওয়ালা মানুষ, যিনি রাসুলের তুলনা খুঁজতে গিয়ে সা’দীর কাছে ‘সমতটী নাবালকে’র খেতাব পান, প্রেমেও পিছিয়ে নেই ।
“একটি হৃদয় কলির মত, ওলীর মত,
মেঘনা নদীর পলির মত।
পাখ-পাখালীর উধাও উধাও ক্লান্ত প্রহর,
উথাল পাথাল ধান সিঁড়ি ঢেউ নিটোল নহর
সবুজ খামার হাওয়ার খেলায় সুরের বহর
একটি হৃদয় লতার মত, লজ্জাবতীর পাতার মত
অনেক কথকতার মত ।
ঝুমুর ঝুমুর ঝাউয়ের নূপুর দুপুর বেলা
সুদূর প্রদেশ আলোর ঝালর সাগর বেলা
ঝোপ ঝাড় ও ঝিল জোনাক জোনাক তারার মেলা
একটি হৃদয় ফুলের মত, সুরমা নদীর কূলের মত,
বট পাকুড়ের মূলের মত ।”
বাগেরহাটের ছেলে মল্লিক । তার কবিতা গানে সুযোগ পেলেই সুরুৎ করে ঢুকে গেছে বাগেরহাটের বিস্তীর্ণ প্রকৃতি ।
“দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমার আর দাঁড়ানোই হলো না
শ্বাস নিতে পারলাম না স্বপ্নের দোরগোড়ায়ও
ষাটগম্বুজের মেঘমালায় না
ঘোড়াদীঘির অতলতায় না
অন্ধকারেও না, রদ্দুরেও না
অমাবশ্যায়ও না, পূর্ণিমায়ও না
শোকেও না, সুখেও না।
বস্তুত: খানজাহান আলীর বারান্দায় কিংবা
উঠোনেও আমি আর উদাত্ত হলাম না
উদীর্ণ হলাম না।
তবুও ভালোবেসে যাই বাগেরহাটের সারাবেলা।”
কবি মল্লিক অসুস্থ । হাসপাতালের বেডে শুয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে । দুটো কিডনীই নষ্ট । আছে ডায়াবেটিস ।জীর্ণ শরীর নিয়ে আর কত লড়বেন অসুস্থতার বিরুদ্ধে !তবু তার সাংগঠনিক কাজ শেষ হয়না । তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়েই ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজ করে যান ।
ভুল মত কিংবা পথ নয় আমার কাছে বিচার্য মানুষ ।যে মানুষ মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে যান, তার বেছে নেয়া পথটি ভুল হলেও আমি তাকে স্যালুট জানাই ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১০:৪৬
Click This Link