somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় - আকাশ হাতে প্রভাত আলো

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা
ফিরে’ মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসে এই গানটি শুনিয়েছিলেন
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর যেন গানের কথাকে সত্যি প্রমাণ করেই ১৯৮৯
সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথিতযশা এই শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে। তবে
বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যে এই শিল্পীর স্বরলিপি চিরদিনের জন্য
খোদাই করা হয়ে গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারতের বারাণসীতে ১৯২০ সালের ১৬ জুন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ
করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি প্রকৌশলী হবার জন্য পড়াশোনা করলেও,
শেষপর্যন্ত তা আর তাঁকে টানেনি। যাদবপুর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তিও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গানের টানে ছেড়েছেন সেই
পড়াশোনা। কিছুদিন অবশ্য লেখালেখি করেছিলেন দেশ পত্রিকাতেও।
কিন্তু যাঁর হবার কথা সঙ্গীতশিল্পী, তিনি কি অন্য কোনো কাজে মন
বসাতে পারেন! ১৯৩৩ সালে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সহযোগিতায় ‘অল ইন্ডিয়া
রেডিও’র জন্য প্রথম গান ‘আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন’ রেকর্ড করেন
হেমন্ত। কিন্তু গানটি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। শেষতক ১৯৩৭ সাল
থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করেন সঙ্গীত জগতে। এই বছর তিনি নরেশ
ভট্টাচার্যের কথা এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানী
কলম্বিয়ার জন্য ‘জানিতে যদিগো তুমি’ এবং ‘বলো গো তুমি মোরে’ গান
দুটি রেকর্ড করেন। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে গান গাইবার
জন্য ইডেন গার্ডেনের স্টুডিওতেও নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। এরপর
থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই তিনি ‘গ্রামোফোন কোম্পানী অফ
ইন্ডিয়া’র জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৮০ সালে এক টেলিভিশন
সাক্ষাৎকারে তাঁর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গুরু হিসেবে তিনি ওস্তাদ ফয়েজ
খানের নাম উল্লেখ করেন। ১৯৪০ সালে কমল দাসগুপ্তের সুরে প্রথম হিন্দি
গানের রেকর্ড বের করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
১৯৪১ সালে এই শিল্পী তাঁর প্লে-ব্যাক সংগীত জীবন শুরু করেন ‘নিমাই
সন্ন্যাস’ ছবির মাধ্যমে। এরপর থেকেই তিনি ভারতীয় বাংলা সিনেমার
একজন অপরিহার্য শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন। ফলে দর্শক-শ্রোতা একের
পর এক কালজয়ী বাংলা গান উপহার পেয়েছেন। ১৯৪৪ সালে ‘ইরাদা’
ছবিতে প্লে-ব্যাক করে হিন্দি গানের শ্রোতাদেরকেও নিজের জাত
চিনিয়েছিলেন হেমন্ত। একই বছরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম নিজের
কম্পোজিশনে দুটো গান করেন। গান দুটির গীতিকার ছিলেন অমিয় বাগচী।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন।
তবে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ১৯৪৪ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’
সিনেমাতে। এছাড়াও কলম্বিয়ার লেবেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের
করেছিলেন তিনি। তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হেমন্ত আত্মপ্রকাশ
করেন ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমার মাধ্যমে।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই হেমন্ত নিজেকে সম্ভাবনাময়
শিল্পী এবং কম্পোজার হিসেবে সবার নজর কাড়েন। সেসময় তিনিই
ছিলেন একমাত্র পুরুষ কণ্ঠশিল্পী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কাজ
করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে বলিউডি সিনেমা ‘নাগিন’ এর সঙ্গীত পরিচালক
ছিলেন তিনি। এই ছবির গান সেসময় দুই বছর ধরে টপচার্টের শীর্ষে অবস্থান
করেছিল এবং এই সিনেমার জন্যই হেমন্ত ১৯৫৫ সালে ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট
মিউজিক ডিরেক্টর’ এর পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি বাংলা সিনেমা
‘শাপমোচন’ এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের
জন্য চারটি গান করেছিলেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি
মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। পরবর্তী সময়ে এই জুটি পেয়েছিল
অসম্ভব জনপ্রিয়তা।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে হেমন্ত বহু বাংলা এবং হিন্দি ছবির গান
গেয়েছেন। এছাড়াও তিনি প্রচুর রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ড বের করেন।
শিল্প সমালোচক ও শ্রোতাদের অনেকেরই মতে, তাঁর বাংলা সিনেমার
গানগুলো সে সময়ে যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তা এখনো পর্যন্ত
বহাল রয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত
বাংলা ছবির মধ্যে রয়েছে ‘হারানো সুর, দ্বীপ জ্বেলে যাই, নীল
আকাশের নীচে, স্বরলিপি, শেষ পর্যন্ত, কুহক, দুই ভাই এবং সপ্তপদী’। এছাড়াও
হিন্দি ছবির মধ্যে রয়েছে ‘নাগিন, জাগ্রিতি এবং এক হি রাস্তা’।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্বাধীনতার
পক্ষে গান করেছিলেন। তিনি সেসময় বিভিন্ন ক্যাম্প এবং শরণার্থী
শিবিরে ঘুরে বেড়াতেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, তিনি
চ্যারিটি শো করে এর অর্থ তুলে দিয়েছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরের
সাহায্যার্থে। তাঁর গাওয়া ‘মা গো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তি
প্রিয় শান্ত ছেলে’ গানটি সেসময় দারুণভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো
মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে
অভিষেক ঘটে ‘অনিন্দিতা’ ছবির মাধ্যমে। ছবিটির প্রযোজকও ছিলেন
তিনি নিজেই। তবে ‘অনিন্দিতা’ ছবিটি বক্স অফিসে সেরকম সাড়া
জাগাতে পারেনি। এর পর সত্তরের দশকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘রাগ
অনুরাগ, ফুলেশ্বরী এবং দাদার কীর্তি’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
এর ফলে তিনি বাংলা ছবির জগতে প্রধান সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে
পরিচিতি লাভ করেন। অবশ্য এরপর তিনি প্রখ্যাত সুরকার সলীল চৌধুরীর
কম্পোজিশনে তাঁর ৪০ এবং ৫০ এর দশকের কিছু কাজ আবারও নতুন করে করেন।
১৯৮০ সালে এই সঙ্গীত প্রতিভার এক গুরুতর হার্ট অ্যাটাক হয়। যার ফলে তাঁর
কণ্ঠ এবং শ্বাসযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই হার্ট অ্যাটাকের পর থেকেই তিনি আর
অ্যালবামের কোনো কাজ করতেন না। তবে এই সময় তিনি ‘অল ইন্ডিয়া
রেডিও’ এবং দূরদর্শনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ১৯৮৯ সালের
সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ‘মাইকেল মধুসূদন
অ্যাওয়ার্ড’ নেওয়ার জন্য। এসময় তিনি একটি কনসার্টেও অংশ নেন। এরপর
ভারতে ফিরে গিয়েই আবারো একটি হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়েন
তিনি। দ্বিতীয়বারের এই অ্যাটাক তাঁকে আর উঠতে দেয়নি। ১৯৮৯ সালের
২৬ সেপ্টেম্বর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অনেক
অনেক কালজয়ী গানের শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেঁচে আছেন তাঁর
গানের মধ্যে। নতুন করে আর কোনো কাজ তার করা হবে না। তবে
‘গ্রামোফোন কোম্পানী অফ ইন্ডিয়া’ তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পর থেকে প্রতি বছরই
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলো নিয়ে একটি নতুন অ্যালবাম
প্রকাশ করে আসছে। হেমন্ত গেয়েছিলেন ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে
যাবো, আমিও নদীর মতো আসবো না ফিরে আর আসবো না ফিরে
কোনোদিন’। দেহলোকে সত্যিই তিনি আর ফিরে আসবেন না কোনো দিন।
কিন্তু তাঁর সৃষ্টিই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরদিন। ভক্তদের মাঝে তিনি
ফিরে ফিরে আসবেন বারবার।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:২০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন পড়বেন, ফিকাহ জানবেন ও মানবেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:০০



সূরাঃ ৯৬ আলাক, ১ নং থেকে ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১। পাঠ কর, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন
২।সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে
৩। পাঠ কর, তোমার রব মহামহিমাম্বিত
৪। যিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

×