১)
মানবের কল্যানে মহৎ-কর্ম সাধনের পুরষ্কার হিসেবে হাততালি এবং ভালোবাসা উভয়ই কাম্য এবং নায্য। সেখানে বরং নিরস-নিরব থাকা সেই মহত-কর্মের মূল্যায়ণে ব্যর্থতার পরিচয়। এক্ষনে প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিটেইনের রানির পৌত্র উইলিয়াম কী কী মহত-কর্মের স্বীকৃতি-স্বরূপ বিশ্বব্যাপী এই রকমের হাততালি অর্জন করলেন? এই সরল প্রশ্নের মীমাংসা না করে, ব্রিটিশ রাজ-বাড়ির বিবাহের দীর্ঘ ও আবেগ-বিগলিত বর্ণনা দান করে রেহমানবাবু পাঠকদের প্রতি অবিচার করেছেন। আশা করছি, এর একটি ব্যাখা তিনি হাজির করবেন এবং পাঠকদের আস্থা অর্জনে তার সৎ-প্রচেষ্টার প্রমাণ রাখবেন।
এক সময় এমন কথা প্রচলিত ছিল যে "ব্রিটিশ-রাজের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না।"। এমন দাবীর কারণ ছিল পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ ভূমি ছিল তখন ব্রিটিশ-রাজের দখলে। দখলকৃত স্থানগুলির আরেক নাম উপনিবেশ। আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি উপনিবেশ কাকে বলে। অন্তত উপনিবেশে বন্দী বাসিন্দাদের উত্তরসূরী হিসেবে তা ভুলে যাওয়াটা নিতান্ত অন্যায়ই বটে। তবুও দুয়েকটা কথা মনে করিয়ে দিই। ১৮৫৭ সালে যখন বাংলা-বিহার-পাঞ্জাব-লক্ষ্ণৌসহ সমগ্র ভারত ব্রিটিশ-রাজের ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় শুরু হয় ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ব্রিটিশ-রাজের প্রায় ২,০০০ সৈন্য-সামন্ত নিহত হয় তাতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের সংগ্রাম পরাস্ত হয়। তারপর শুরু হয় ব্রিটিশ-রাজের প্রতিশোধ। কামানের মুখে বেঁধে তোপ দেগে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কাতারবন্দী মানুষকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে - এভাবে আরো চমকপ্রদ নানা কায়দায় প্রায় ১ কোটি ভারতীয় মানুষ হত্যা করে ব্রিটিশ-রাজ।
রাশিয়ান চিত্রশিল্পী ভাসিলি ভেরেসচাগিন ভাশিলিভিচের আঁকা Blowing from Guns in British India
হত্যা করতে করতে ক্লান্ত অনেক ব্রিটিশ-সেনার বিবরণ ইতিহাসে এখনো পাওয়া যায়। বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে পাইকারী গণহত্যা 'জাস্টিফাই' করেছিল ব্রিটিশ-রাজ এভাবে যে, বিদ্রোহ করে ভারতীয়রা ইউরোপীয় মানুষের উপরে নির্যাতন করেছে। দেখুন কথা! পরদেশ দখল করে তার মানুষকেই কি-না বিদ্রোহের অভিযোগে নিধন! ব্রিটিশ-রাজের এই হচ্ছে জাস্টিফিকেশন।
এই প্রতিশোধের পটভূমিতে ইংরেজ কার্টুনিস্ট জন টেনিয়েলের আঁকা ছবি 'British Lion Attacks Bengal Tiger'
রেহমানবাবু কি ভুলে গেছেন ব্রিটিশ রাজ-পরিবারের সেই ইতিহাস?
২)
ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। ভারতের বিদ্রোহের প্রায় ১৫৪ বছর পরে, গত কয়েক মাস ধরে লিবিয়া নামক আফ্রিকার একটি রাষ্ট্রের কিছু মানুষ অস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহ করছে তাদের সরকারের বিরুদ্ধে। এই বিদ্রোহের কারণ, ধরণ, ন্যায্যতা ইত্যাদি নিয়ে কথা হতে পারে, কিন্তু চলুন আমরা বরং এক ঝলক দেখে আসি ব্রিটিশরা কি করছে এ নিয়ে। ব্রিটিশরা শুরু থেকেই সেই সশস্ত্র-বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছেন। বিদ্রোহীদের যেহেতু যুদ্ধ-বিমান নেই, তাই তাদেরকে সাহায্য করার জন্য জাতিসঙ্ঘের রাবার-স্ট্যাম্পের ছাপের জোড়ে ন্যাটোকে সাথে নিয়ে লিবিয়ার উপরে বিমান হামালায় ঝাপিয়ে পড়েছে। তাদের মিলিটারি এডভাইসাররা লিবিয়ায় বিদ্রোহীদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদেরকে অস্ত্র দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। কি আশ্চর্য! যে ব্রিটিশরা নিজের উপনিবেশের বিদ্রোহে ২০০০ সৈন্য নিহত হবার প্রতিশোধ হিসেবে ১ কোটি মানুষ হত্যা করে তারা আজকে পরদেশের বিদ্রোহীদের পক্ষে লড়াই করে?
তারচেয়েও আশ্চর্য বিষয়, যেদিন ব্রিটিশ-রাজবাড়িতে বিবাহ-উৎসব, আর তার নিমিত্তে গোটা পৃথিবীজুড়ে মিডিয়া-সুনামি বয়ে গেল, তার পরদিনই, ন্যাটো তথা ব্রিটিশবাহিনী-যুক্ত বিমানবাহিনী মিসাইল আক্রমণে হত্যা করলো লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফীর এক পুত্র ও তার তিন শিশুকে। ব্রিটিশ-রাজ চুপ। রাজপৌত্র উইলিয়ামের মত গাদ্দাফী-পুত্রেরও বয়স ২৯। তার তিন শিশু জানতো না কেন তাদের ঘরে মিসাইল এসে পড়লো।
জনাব রেহমান দাবী করেছেন একমাত্র ব্রিটিশ রাজ-পরিবারই বিশ্বের কোটি কোটি শিশুর ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ দাবী করতে পারে, কারণ তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন রূপকথা। শিশুর জন্য রূপকথাই বটে। কিন্তু তিনি ভুলে থেকেছেন ব্রিটিশ-রাজাক্রান্ত সেইসব শিশুদেরকে যারা তাদের রক্তের দামে ব্রিটিশ-রাজের রূপকথার গল্প যুগিয়ে চলেছে শতের পর শতক ধরে।
৩)
লিখার সময় সঠিকভাবে না লিখলেও রেহমানবাবু বাঙলায়ই লিখেন এবং যতদূর জানি বাঙলায়ই কথা বলেন, সে হিসেবে তিনি আমাদেরই একজন। আমরা মানে এই আমরা যারা প্রায় দু'শো বছর ধরে একটু একটু করে জেনেছি ব্রিটিশ-রাজের রূপকথার পেছনের প্রাণ-নাশী রূঢ় বাস্তবতা। তাঁর নির্লজ্জ তোষামোদি আমাকে লজ্জিত করেছে। ব্রিটিশ-রাজবাড়ির বিবাহের উল্লাসে দিগম্বর হয়ে যে সকল বিবেকহীন মূর্খ পথে নেমেছে, তাদের সকলের পক্ষ থেকে ক্ষুদিরামের কাছে, তিতুমীরের কাছে, প্রীতিলতার কাছে, সকল বাঙালির কাছে, ভারতীদের কাছে, আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানদের কাছে, আফ্রিকার কালো দাসদের কাছে, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কাছে, ব্রিটিশ-রাজের হাতে নির্যাতিত সমগ্র মানব-জাতের কাছে আমি লজ্জিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১১ রাত ১১:১৩