কার জন্য নারী দিবস? শহুরে নারীর? গ্রাম্য নারীর? গৃহবধূ নারীর? শ্রমিক নারীর? কিষাণী নারীর? হিন্দু নারীর? মুসলমান নারীর? বাঙালি নারীর? ইংরেজ নারীর? ভেবে কূল পাই না কোন সে নারী, যার মুক্তির জন্য বিশ্বের দিবস নির্ধারকরা একটা দিন আলাদা করে ছেড়ে দিয়েছেন - কেবল নারীর জন্যই? কেনই বা দিয়েছেন? প্রশ্নটাতো সহজ আর উত্তরও আমাদের জানা - সকল নারীর জন্যই নারী দিবস! দিনরাত মিডিয়া আমাদের এ-ই তো জানিয়ে আসছে।
আসলেই কি তাই? নরসিংদী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে যে নারী আজ সারাটা দিন তাঁত বুনেছে তাঁর জীবনে এই নারী দিবসের ভূমিকা কী? ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের তালাকপ্রাপ্তা মেজ মেয়েটির কোন কাজে এসেছে আজকের নারী দিবসের র্যালি? কিংবা গাড়ো পাহাড়ের পাদদেশে যে আদিবাসী নারীটি আজ পেটের জ্বালা নেভাতে মিশনারীদের কুঠিতে গিয়ে মুহুর্তেই খৃষ্টান হয়ে গেল তার অন্তর্দহনের আঁচ কি একটুকুও লেগেছে নারী দিবসের লম্বা শোভাযাত্রার গায়ে?
ভালো করে দেখুন, ঐ শোভাযাত্রার শোভা হয়ে আজ বহুদূর হেঁটেছেন আমাদের এই চেনা শহরের চেনা কোন প্রগতিশীলা নারী! নারীমুক্তির শ্লোগানে শ্লোগানে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই হয়তো ঝাপিয়ে পড়েছেন তাঁর গৃহের ১২ বছর বয়েসী পরিচারিকার উপরে! সবাই হয়তো তেমন নন, কেউ হয়তো পরিচারিকাকে পেটান না, বরং স্বামীর হাতে প্রায়ই আহত হন, আর সেকারণেই নারী-মুক্তির মিছিলে যোগ দেন। তারপর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। ফিরে এসে ভাবেন মুক্তি চাই। এই স্বামীর সাথে এক ছাদের নীচে আর নয়। মনে মনে হিসেব কষেন, দেনমোহরের টাকাটা কীভাবে কাজে লাগাবেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। হ্যাঁ, তার দেনমোহর আসলে বেশ অনেকগুলো টাকা। বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হবার সময় তাঁর বড়মামা মূলামূলি করে দেনমোহরের অংকটা বেশ বড়ই বাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রায় সব বিবাহিত বান্ধবীরই এ নিয়ে ঈর্ষা ছিল।
এভাবে কেটে যায় নারী মুক্তির দিনটি। তারপর আসে আবার আটপৌরে দিন-রাত-সকাল-বিকাল। আবার আগের মতই একটা একটা দিন চলা। সকলে ভুলে যান বিশেষ এই দিনটির কথা। ভুলেন না কেবল ফেয়ার এ্যন্ড লাভলী আর পন্ডস্ এর মত কোম্পানির মার্কেটিং এক্সেকিউটিভরা। কেন? কারণ নারীদিবসটি আসলে ওনাদেরও! কেমন করে? তারাও কী নারীমুক্তির জন্য চিন্তিত? না, তা নয়। বরং নারীকে বন্দী করে রাখতে পারলে তাদের লাভ বেশি।
এবার পাঠক বিরক্ত হবেন নিঃসন্দেহে! বিউটি প্রোডাক্টসের ফেরিওয়ালারা কেমন করে কেনই বা নারীকে বন্দি করে রাখতে চাইবেন! তারাই তো বরং নারীকে মুক্তি দেন কালো রঙের যন্ত্রণা থেকে, ফর্সা করে দিয়ে, কুঁচকানো ত্বক মসৃন করে দিয়ে, পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে! তাঁদের দোষ দেয়া কেন মিছিমিছি! তা বটে! ওঁরা মুক্তি দিচ্ছেন নারীকে গায়ের রঙের হীনমন্যতা থেকে। সাহায্য করছেন পুরুষের সামনে নারীর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে! দেশে দেশে আবার এই সাহায্যের ধরণ আর মাত্রা ভিন্ন। যেমন আমাদের মত দেশে যেখানে মানুষের গায়ের রঙ য়ুরোপীয়দের মত অতটা শাদা নয়, বরং কালোর দিকে - তাদের কানের কাছে সারাদিন ওরা চেচাচ্ছেন কালো রঙ খারাপ কালো, রঙ বিশ্রী, কালো মেয়ে তুমি। এই কালো মেয়ে, তোমাকে হীনমন্যতায় ভুগতে হবে। আর ওদিকে য়ুরোপে এই এঁদের মুখেই আবার অন্য কথা! এই মেয়ে তুমি এত ফ্যাকফ্যাকা শাদা কেন! ইশ তোমার চামড়া দেখছি একেবারে ফ্যাকাশে! এসো আমার কাছে এসো, গোপন দাওয়াই আছে! এর নাম ট্যানিং! আরো একটু কড়া হোক তোমার ত্বকের রঙ! দেখো কি সেক্সি দেখাচ্ছে তোমাকে!
আহ নারী-মুক্তি! নারী তোমার মুক্তি হবে কোথায়, কোন মহাদেশে গেলে!