আব্দুল করিম নিঃসন্দেহে বাংলা লোকসংগীতে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন। হাওড়ের জলের ধ্বনি, কাঁদা-মাটির গন্ধ আর মানুষের বিবিধ জীবনাচরণের নানামুখী দার্শণিক উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা চিরায়ত সাহিত্যধারাকে। তাঁর অবদানের প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। তাঁর ব্যাপারে আজকে আলোচনায় যাবো না। বরং একটু বুঝতে চেষ্টা করছি, মিডিয়ার কল্যানে তিনি আজ বাউলসম্রাট নামে আখ্যায়িত হচ্ছেন - কিন্তু সেটা কতটা সঠিক?
বাউলধর্ম বাংলা লোকধর্মের বিস্মৃতপ্রায় অবশেষ। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বারে বারে বিদেশি শক্তি এসেছে, সাথে নিয়ে এসেছে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজধর্ম প্রতিষ্ঠায় তারা আক্রমণ করেছে অঙ্গ, বঙ্গ, গৌড়ের লোকায়ত ধর্মবিশ্বাসকে, ফলে তা বিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের ধারায় সুস্পস্ট দু’টো বড় ঢেউ লেগেছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল আমলে এবং তারপর শেষটি লেগেছিল মুসলিম শাসনামনে। মাঝখানে হিন্দু শাসনামলে অবশ্য পরিবর্তনের ধারা স্তিমিত হয়েছে বলেই অনেকে মত দেন, কেননা তখন লোকধর্ম ছিল তীব্র আক্রমণের মুখে। ফলে বিকাশের বদলে তা অনেকটা মিইয়ে গেছে।
মুসলিম শাসনামলের শুরুতেই বাউলধর্ম আবার বদলাতে শুরু করে। পারস্যের মুসলিম সূফিদের আগমনে বাংলায় একধরণের পারসিক-আরবী ভাববাদের বিকাশ শুরু হয়। রাজধর্ম ইসলাম হওয়ার পরে তা অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করে। বাউলদের মাঝেও এর ছোঁয়া লাগে। বাউল দর্শণে স্থান পায় আল্লাহ-নবী বিশ্বাসের ভেদ নির্ণয়ের আলোচনা। কিন্তু তাতে বাউলের দেহতত্ত্ব বদলায়নি মোটেও, বরং আরও গভীর ও সমৃদ্ধ হয়েছে। পর্তুগীজ ও ইংরেজদের আগমনে বাংলায় খ্রীষ্টধর্মেরও খানিকটা প্রভাব পড়ে, তবে তা বাউলধর্মকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। উপরন্তু বাউলরা খ্রীষ্টদর্শণকে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন একেশ্বরী দর্শণকে খারিজ করতে। লালনের গানে বারে বারে এসেছে ইসলামের সাথে খ্রীষ্ট দর্শণের তুলনা যা তুলে ধরেছে একেশ্বরী দর্শণের সীমাবদ্ধতা।
যা-ই হোক, মূল বিতর্কটি হচ্ছে শাহ আব্দুল করিমকে বাউল বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত? যদিও তাঁর গানে দেহতত্ত্ব ব্যপকভাবেই স্থান পেয়েছে, তবুও বাউল দর্শণ কতখানি তিনি ধারণ করতেন সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়ে গেছে। হাওড় অঞ্চলের লোকসংগীতের যে ধারা সেটি কি বাউলস্রোতে মিশতে পেরেছে? কিংবা চেয়েছে? সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার গান স্বমহিমাতেই উজ্জ্বল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় হাসন রাজা কিংবা উকিল মুনশীর গানের কথা। এঁদের সকলের গানই বাণী, সুর বিষয় বৈচিত্রে বাংলা লোকসংগীতের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু বাউল গান, দর্শণ ও ধর্মের সাথে তাদের সরাসরি কোন যোগ নেই। সেটি প্রকৃত অর্থেই আরেকটি ধারা। তাই বাউলসম্রাট বিশেষণ দিয়ে শাহ আব্দুল করিমকে মহিমান্বিত করার বিশেষ কোন দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। তিনি স্বমহিমাতেই ভাস্বর।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১:১৯