পৃথিবীতে এক ধরণের লোক আছে, যাদের আজন্ম কপাল পোড়া। পরীক্ষায় এক নম্বরের জন্য এরা এ-প্লাস মিস করে, প্রমোশন হবার ঠিক আগের দিন বসের সাথে কথা কাটাকাটি হয়ে চাকরি নট হয়ে যায়; দীর্ঘদিনের প্রেমিকা বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে ভেগে বিয়ে করে ফেলে। 'অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়' টাইপ। আমার কপালও মনে হয় এরকম। ক্লাস সেভেনে প্রথম গল্প লিখেছিলাম, সেই শুরু। এখন ত্রিশ পার হয়ে এসেছি, কিন্তু লেখালেখির নেশা ছাড়তে পারিনি। পরিচিত সবাই আমাকে লেখক হিসেবেই চেনে। কবিতা, নাটক, ছোটগল্প, গল্প, স্যাটায়ার, থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন, হরর, রোমান্টিক - সবই কমবেশি লেখা হয়ে গেছে। লেখাগুলোর মানও খুব সম্ভব খারাপ হয়নি, কারণ যাদেরকেই পড়িয়েছি, প্রশংসা করেছে। 'ভাই, এইরকম লেখা অন্য কেউ লেখে না। আপনার গল্পগুলায় একটা আকর্ষণ থাকে, চুম্বকের মত আটকিয়ে রাখতে জানে, শেষ না করে ওঠা যায় না।' প্রতিমাসেই দুই-তিনটে লিটল ম্যাগাজিনে আমার গল্প-কবিতা ছাপা হচ্ছে। কখনো কখনো পত্রিকার সাময়িকীতেও লেখা ছাপা হয়। খুব ভাল লাগে তখন।
কিন্তু যে-ই পাণ্ডুলিপি নিয়ে একটা প্রকাশনীতে যাই, অমনি প্রকাশক একটা সূক্ষ্ম বিরক্তির ভঙ্গি দেখান। 'এইগুলা মানুষ পড়ে না ভাই। বই বিক্রি হয় নামের ওপরে। তারা আপনার বই কিনবে কেন? আপনি কে? আমি যদি এইটা ছাপাই, আমার বিশাল লস হবে। সম্ভব না।' কেউ কেউ কিছুটা ভদ্রতা দেখান, পাণ্ডুলিপির সাথে আট-ন' হাজারের একটা খাম-ও আনতে বলেন। তাহলে হয়তো তারা ভেবে দেখতে পারেন। আমি পরাজিত হয়ে ভগ্ন মনোরথে ফিরে আসি। আর কয়েকটা জোকার হয়তো এই বই ওই বই, বিদেশি ম্যাটেরিয়াল মেরে একগাদা আবর্জনা লিখল, দেখব ওদের পেছনে প্রকাশক সব মাঘ মাসের কামার্ত কুত্তির মত ঘুরছে। কেন? হয়তো দশ পনের মিনিটের মত এদের চেহারা টিভিতে এসেছে, কিংবা অমুক লেখকের সাথে সখ্যতা আছে, তাই। এখন খ্যাতিই সব। প্রতিভার দাম কচুও নেই।
লেখালেখি ছেড়ে দেবার চেষ্টা করেছি অনেকবার। কিন্তু জিনিসটা আমার আত্মার মাঝে খোদাই করা আছে। মাথায় একটা আইডিয়া পেলে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড মানুষের মত মনে হয়, এখনি কাগজে কলমে ওটাকে না নামালে স্বস্তি পাব না যেন। অস্থির, পাগল পাগল লাগে নিজেকে। তাই সে আশা ছেড়ে এখন অন্য পথ ধরেছি। শর্টকাট পথ।
ক্রাইম থ্রিলারগুলো লেখার সময় একটা জিনিস দেখেছিলাম, এটা সাধারণ মানুষকে টানে সবচে বেশি। অবশ্য লিখতে কষ্টও বেশি। সবকিছু যেন লজিক্যালি ঘটে, প্লটটা যেন জমজমাট হয় - এসব তো আছেই, সাথে সাথে খুঁটিনাটি ঠিক রাখা, রিসার্চ করা ইত্যাদি মিলিয়ে প্রচুর সময় এবং পরিশ্রম যায় এর পিছনে। আমিও অনেক রিসার্চ করে গল্পটল্প লিখতাম। কিন্তু যত যাই করি, লেখার সময় মনে হত যেন পাঠকের সাথে প্রতারণা করছি। আমি তো জীবনে তেমন কোন ক্রাইমই করিনি, তাহলে আমার গল্পের চরিত্রটা যখন গুলিতে কারো খুলি উড়িয়ে দিচ্ছে, তখন তাঁর অনুভূতি কেমন- এটা বুঝব কি করে? সুতরাং সৎভাবে থ্রিলার লিখতে চাইলে আমার উচিত অন্ততঃ একটা খুন করা। খুন করলে দুটো অপশন আছে, কোনটাতেই আমার ক্ষতি নেই।
যদি খুন করে ধরা না পড়ি, তাহলে লেখনিতে ওই অভিজ্ঞতার বদৌলতে তাজা বাস্তবের ছোঁয়া লাগবে, প্রকাশকরা এতে আকৃষ্ট হবেই। আর যদি ধরা পড়ে যাই, তাহলে তো আরও ভাল। এখনি দেখতে পাচ্ছি, পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে হেডলাইন, 'ধরা পড়ল নৃশংস খুনিঃ অবিশ্বাস্য মোটিভ!' খ্যাতি আর কাকে বলে! তারপর খালি গল্প-কবিতার সংকলন বেরুবে একে একে, আর বিকবে হাজারে হাজারে। ব্যাপারটা একটু চরম পর্যায়ে চলে যায় অবশ্য, কিন্তু কি আর করার, সময়টাই এমন।
এখন থেকে নিয়মিত ডায়েরি রাখব ভাবছি। খুনটা কিভাবে করব, কি লাগবে- সব খুঁটিনাটি লিখে রাখার জন্য একটা ভাল উপায় এটা। আজ থেকে রিসার্চ শুরু।
২৯শে জানুয়ারি
'ডায়েরি'
আজ একটা লোকের পেছনে দেড় ঘণ্টার মত ঘুরলাম। কিভাবে অনুসরণ করতে হয় তার প্র্যাকটিস করছি। লোকটার মধ্যে তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। সামান্য বেঁটে, টেকো, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, ছোট্ট একটা ভুঁড়ি আছে- সব মিলিয়ে অতি সাধারণ। আমি যে তাঁর পিছে পিছে ঘুরছিলাম তাও মনে হয় বুঝতে পারেনি। লোকটার বাসা চিনে এসেছি।
আর খুনের ব্যাপারটা ভেবে দেখলাম। একবার খুন করলে জিনিসটা বড্ড বেশি...সাধারণ হয়ে যায়। ধরলাম কাউকে খুন করে ফেলেছি, ছুরি ব্যবহার করে। এখন লেখায় সেটা দিলাম। কিন্তু যত বাস্তবভাবেই বর্ণনা দেই না কেন, জিনিসটা তো- ছুরি ঢোকালাম, বের করলাম- এই? তারপর? আরও কতশত ধরণে মানুষ খুন করা যায়, সেগুলোও ট্রাই করে দেখা উচিত। অনেকগুলো ইংলিশ ছবিতে সিরিয়াল কিলারদের দেখেছি। একের বেশি খুন করলে সিরিয়াল কিলার হওয়াই উত্তম। মানুষের কাছে আকর্ষণীয় লাগবে। দেখি, এটা নিয়ে খোঁচাখুচি করতে হবে।
৪ই ফেব্রুয়ারি
'ডায়েরি'
মানুষ খুনের আগে একটা ছোটোখাটো জন্তু খুন করার কথা ভাবছিলাম। বেশি বড়ও না, ছোটও না। হাত মকশো করা আর কি! কাল রাতে বাড়িতে ঢোকার আগে রাস্তায় পেয়ে গেলাম। একটা পিচ্চি কুত্তার বাচ্চা থাবার ওপরে মুখ রেখে শুয়ে আছে, কুঁই কুঁই করছে মৃদুস্বরে। আমি চারপাশে ভালমত দেখে শালাকে কোলে তুলে নিলাম। কি বাজে দুর্গন্ধ গায়ে! নিঃশ্বাস বন্ধ করে কোনোমতে ঘরে নিয়ে ছেড়ে দিতেই হতভাগা আবার হাতপা লম্বা করে শুয়ে পড়ল। অসুস্থ নাকি! এই আধ্মরাটাকে খুন করে কিই বা হবে (মন খারাপ হয়ে গেল কিছুটা), তাই অহিংসধর্ম প্রয়োগ করতে হল। একটা বড় বালতি পানি ভর্তি করে ওটাকে হাত পা ভালমত বেঁধে আলতো করে শুইয়ে দিলাম। তেমন লাফ ঝাপ দিল না, এ ব্যাটা ক'দিন পর এমনিতেই মরে যেত মনে হয়। প্রথমে আগ্নেয়গিরির মত কয়েকটা বুদবুদ-বিস্ফোরণ, তারপর আস্তে আস্তে বুদবুদের সংখ্যা কমে শরীর ঝাঁকি দিতে শুরু করল। ওটার চোখের মণি দুটো তখন অসুস্থ মনে হচ্ছিল না, কেমন প্রবলভাবে জীবন্ত হয়ে উঠছিল! পাঁচ মিনিটের মাথায় বুদবুদগুলো নেই হয়ে গেল। আর কোন নতুন বুদবুদ উঠছে না।
লাশটা রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েই আমি বাড়ির দিকে দৌড় লাগালাম। নতুন কটা লাইন এসেছে মাথায়! ঘরে ঢুকেই লিখে ফেললাম-
'আজ শিহরণ, শব্দস্পর্শগন্ধহীন রুদ্ধশ্বাসে হৃদয়স্পন্দন
শান্ত হল। জন্ম-সাধনাহীন রিরংসার উত্তাপে
করে ফেলা খুনের আগে কিছুক্ষণ
কেতকীর গন্ধে হাত কাঁপে।
চঞ্চল অধীর দুটি হাত,
সে গন্ধে সাপের মত মসৃণ
মৃত্যুর মত ডেকে আনে রাত
অস্ফুট, ধূসর, শীর্ণ; আর কেমন ক্ষীণ।'
খারাপ হয়নি, তাই না?
ও, রিসার্চের কথা বলা হয়নি। অনেকগুলো ছবি দেখলাম, সেভেন, আমেরিকান সাইকো, ডিরেঞ্জড, হ্যানিবল - ভালই লাগল। যা বুঝলাম সিরিয়াল কিলাররা একটা নির্দিষ্ট থিমের ওপর কেন্দ্র করে খুন করে। সবার নিজস্ব একটা খুনিশীলতা থাকে। আমারও একটা ভাল থিম দরকার। তবে অস্ত্র কি হবে এটা মোটামুটি ঠিক করা হয়ে গেছে। মেইন অস্ত্র হবে হাতুড়ি। একটা মিডিয়াম সাইজ হাতুড়ি ঘরের কোথাও না কোথাও আছে মনে হয়। খুঁজে দেখতে হবে। আর একটা কাঁটাচামচ থাকবে। পিছন থেকে প্রথমে মাথায় বাড়ি দিয়ে অচল করে দেব, তারপর বাম চোখটা চামচ দিয়ে বের করে আনব। এটা অনেক ইন্টারেস্টিং। বাংলাদেশি সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে কেউ যদি বিবিসি বা হিস্টোরি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে, তাহলে এই স্টাইলটা নিশ্চিত ওদের নজর কাড়বে। আর বাংলাদেশি কিছু প্রোগ্রাম আছে না, 'তালাশ' বা এরকম নাম? ওরা তো লুফে নেবে।
আসল সিরিয়াল কিলারদের ওপরেও খোঁজখবর নিলাম। সত্যি কথা বলতে বমি এসে যাচ্ছিল আমার। অধিকাংশই পেডোফাইল, রেপিস্ট, কিংবা মানসিক ভাবে অসুস্থ। এসব কি?? খুন করা একটা ব্যাপার (এটা তো এক টাইপের শিল্প), আর খুনের সাথে ওসব মিশিয়ে ফেলা আরেক ব্যাপার। শালাদের পেলে চোখ গেলে দিতাম একেবারে।
৮ই ফেব্রুয়ারি
'ডায়েরি'
অবশেষে...প্রথম খুন!
জিনিসটা এত সোজা হবে কল্পনাই করিনি। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে গাবতলি নেমেছিলাম। হাতে হাতুড়ি, পকেটে স্টেইনলেস স্টিলের কাঁটাচামচ। মনে মনে একটু আশ্চর্যও হচ্ছিলাম, কেউ দুবার তাকিয়ে দেখলও না- তাঁদের পাশে একটা লোক হাতে হাতুড়ি ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে! যাকগে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হেঁটে এক স্যুট পড়া কর্পোরেটকে অনুসরণ করা শুরু করলাম। সন্ধ্যা নামছে তখন।
দশ বার মিনিট হাঁটার পর একটা পরিত্যক্ত দালানের পিছে এসে পড়লাম। আশেপাশে কেউ নেই। লোকটাও অসতর্ক। সুযোগ বুঝে ব্যাটার পেছনে জোরে করে হাতুড়ি বসিয়ে দিলাম। কি আশ্চর্য, থ্যাঁচ করে হাতুড়ির অর্ধেকটাই মাথার ভেতরে ঢুকে গেল! এত নরম হয় মানুষের খুলি! আমি আশ্চর্য হয়ে হাতুড়ির মাথায় লেগে থাকা থিকথিকে মগজের দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় লোকটার পড়ে যাবার শব্দে সম্বিৎ ফিরল। কাঁটাচামচের কাজ এখন। লোকটার মাথা থেকে ক্ষীণ একটা রক্তস্রোত এসে মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছে, আমি সাবধানে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। চোখের কোটরের ওপরে যে হাড়টা আছে, তাঁর গা ঘেঁষে চামচ ঢুকিয়ে বয়াম থেকে তেঁতুলের আচার ওঠানোর মত করে একটা টান দিলাম। তিনবারের প্রচেষ্টায় পেছল সাদাটে চোখটা বেরিয়ে এল। আজ শিক্ষণীয় বিষয় দুটো।
এক- সাথে একটা রুমাল রাখতে হবে, হাতুড়ির মাথা মোছার জন্য।
দুই- কাঁটাচামচ ব্যবহার করা যাবে না। অনেক রক্ত পড়ে, হাতে-গায়ে লেগে যায়। অন্য কিছু ইউজ করতে হবে।
খুন করার পর কেমন লাগছে আমার? আমি বলব অন্য রকম একটা কিছুর অনুভূতি। কিন্তু উপভোগ করিনি মোটেই। একটা ঝামেলা বলে মনে হচ্ছিল ব্যাপারটাকে। অবশ্য আনন্দের ব্যাপার হল ঘটনার পরপরই একটা সাইকো থ্রিলারের আইডিয়া এসেছে মাথায়। একটা যুবতী মেয়ে হবে মূল চরিত্র। মেয়েটা আপাতঃদৃষ্টিতে উচ্ছল, সবার সাথে মেলামেশায় পারদর্শী। সে আসলেও তাঁর পরিবার, বন্ধুদের ভালবাসে। কিন্তু মেয়েটার মানসিকতায় একটা সমস্যা আছে, তাঁর বিশ্বাস এই জগতে মানুষ যত বেশি কষ্ট পাবে, মৃত্যুর পর সে তত কম শাস্তি পাবে। তাই ভালবাসার টানে সে এই জগতে কষ্ট দেবার ভারটা নিজের হাতেই তুলে নেয়।... ভাল লাগছে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে। গত পাঁচ দিনে অনেকটা লিখেও ফেলেছি।
আর...এই কদিনে লেখার প্রতি ভালবাসাটা আরও যেন গাঢ় হয়ে গেছে। লেখালেখি আমার প্রথম প্রেম। মানুষ ভালবাসার জন্য কতকিছুই করে, খুন আর এমন কি!
১৩ই ফেব্রুয়ারি
'ডায়েরি'
কাঁটাচামচের বদলে কি নেওয়া যায় তাই ভাবছিলাম। অনেকে নাকি পিয়ানোর স্ট্রিং ব্যবহার করত (আমার কাছে ওটা নেই, তবে জিআই তার আর ডাটা কেবল আছে। ওতে কি আর কাজ চলে নাকি!)। সরাসরি কসাইয়ের ছুরি (নাহ, বেশি বর্বরের মত হয়ে যায়) কিংবা এসিডও (এটা তো আরও না) ব্যবহারের কথা শুনেছি। কিন্তু আমার পছন্দ হচ্ছিল না। শেষে একটা চীনা মুভি দেখার সময় জিনিসটা মাথায় এল- চপস্টিক ইউজ করলে কেমন হয়! আমার কাছে অবশ্য চপস্টিক নেই, তবে কমদামি চুলের কাঁটা পাওয়া যায়, দেখতে প্রায় একই রকম। ওগুলো কানের ফুটোয় ভরে হাতুড়ি দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। সাথে রক্ত ছিটকে শরীরে আসারও ঝামেলা নেই। পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি।
এই পদ্ধতিতে দুটো 'রিসার্চ' করলাম। একটা ঝাঁকড়া-চুলো ছোকরা, আর আরেকটা বৃদ্ধা। ছোকরার মাথা নিগ্রোদের মত শক্ত ছিল, আর আমিও ঠিকমত পা ফেলতে পারিনি, ফলে বাড়ি-টাও যুতমত হয়নি। হতভাগা পাগলের মত দৌড় দেয়। আমি কোনোমতে হাতুড়ি ছুঁড়ে দিলে 'থক' করে ওর মাথায় লাগে। ভাগ্য ভাল হাতের সই ঠিক ছিল। রাগ করে ছোকরার লাশ নর্দমায় ফেলে দিয়ে এসেছি। আর বৃদ্ধার ওপরে কাজটা সবচে দ্রুত এবং নিখুঁত হয়েছে। পার্কে বসে ছিল, পেছন থেকে আস্তে মেরে অজ্ঞান করে সাথে সাথেই চুলের কাঁটা গেঁথে দিয়েছি। পুলিশ লাশটা যখন পায়, তখন মহিলা বেঞ্চিতে শুয়ে ছিল, পাখিরা ঠুকরে ঠুকরে চোখ খেয়ে নিচ্ছিল।
সিনেমা দেখে ধারণা করেছিলাম, একটানা খুন হতে থাকলে পুলিশ হয়তো খুনি ধরতে পাগল হয়ে যায়। এখনও ঠোলাদের তেমন কোন ব্যস্ততা দেখছি না। খুনের জায়গায় কয়েকদিন পুলিশ গিজগিজ করল, তারপর আবার সব স্বাভাবিক। তবে মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। অনেকগুলো কাগজে ফলোআপ রিপোর্ট হচ্ছে- 'শহরে ত্রাসঃ খুনের পেছনে কার হাত?', 'কে এই হাতুড়ে-খুনি?' ইত্যাদি ইত্যাদি। হতভাগারা 'অজ্ঞাত খুনি'র একটা ভাল নাম-ও দিতে পারে নি। সামনে একটা সাংবাদিক আর একটা ঠোলাকে ধরে চুলের কাঁটার ট্রিটমেন্ট দিতে হবে।
লেখা তরতরিয়ে এগোচ্ছে। অর্ধেকটা শেষ করে এনেছি প্রায়। এতটা জীবন্ত ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিয়ে আমি আগে কোন লেখা লিখিনি, পড়লে নিজেরই গা শিউরে ওঠে মাঝে মধ্যে। বিশেষ করে মেয়েটা চিলেকোঠার ঘরে যে কাজটা করে....থাক, আগে লিখে নিই পুরোটা। তারপর। পাণ্ডুলিপির প্রথম কিছু অংশ কয়েকটা প্রকাশনীতে পাঠিয়েছি। দেখা যাক কি হয়!
২৭শে ফেব্রুয়ারি
'ডায়েরি'
লেখক হতে গেলে প্রচার প্রসার দরকার। তাই এবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছি কাজে। সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে অ্যাকাউন্ট খুলেছি। দিনে দশ ঘণ্টা করে ওসবে বসে থাকছি আর মানুষের সাথে বকবক করছি। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে কিনা কে জানে! ব্লগেও একটা নিক খুলে নিলাম। লেখালেখি করার জন্য জায়গাটা ভাল। বড় কথা হচ্ছে ওখানে সাইকো টাইপের কিছু লিখলে সেটাকে গল্প বলেই সবাই ভেবে নেয়, উৎসাহ দেয়! ডায়রি এখন থেকে ওখানেই লিখব।
আর সবচে বড় ব্যাপার, দুটো প্রকাশনির সাথে কথা হয়েছে। তারা আগ্রহী। পুরোটা উপন্যাসটাই পাঠাতে বলেছেন। এখনকার যে পরিস্থিতি, মানুষ নাকি এরকম লেখা পছন্দ করবে (আমি কি হাসবো?) আমার মাথায় আরেকটা উপন্যাসের আইডিয়া এসেছে। লেখা শুরু করে দেব আজ কালের মধ্যেই। ও, আরেকটা কথা, ঠোলাকে ট্রিটমেন্ট দেওয়া শেষ। একটু মাথা খাটাতে হয়েছে অবশ্য। ট্রাফিক কন্ট্রোল করছিল, আমি গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছি- 'স্যার পার্কের পিছনে এক দাড়িঅলা লোক হাতুড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে স্যার। তাড়াতাড়ি আসেন।' স্যার বলাতে বিগলিত হয়ে, নাকি হাতুড়ে-খুনি (ওফ! কি বিটকেলে নাম!) কে ধরার লোভে- কে জানে, বেচারা তুমুল আগ্রহে আমার সাথে সাথে দৌড়ে পার্কের পেছনে এল। তারপরে আমি আবিস্কার করলাম ঠোলা মারতে একটা হাতুড়ির বাড়ি বেশি লাগে। এটা জানতাম না আগে।
২৪শে মার্চ, রাত দশটা
'সামহয়ারইন ব্লগ'
সুখবর! সুখবর!! সুখবর!!!
ব্লগের সকল বন্ধুদের অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, স্রষ্টা আমার প্রতি সদয় হয়েছেন! গত মাসে কয়েকটা প্রকাশনীর কাছে আমার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলাম। এদের মাঝে প্রকাশক শিহাব ভাই সেটা পড়ে খুবই উৎসাহিত হন এবং আমার সাথে মোবাইলে তার কথা হয়। এরপর কয়েকবার তিনি আমার সাথে দেখা করেছেন। অবশেষে গতকাল রাতে তিনি নিশ্চিত করলেন যে, আমার প্রথম বইটি তার প্রকাশনী থেকেই বের হচ্ছে।
বইয়ের নাম নির্বাচন এবং মুখবন্ধ লিখে দেবার জন্য জনপ্রিয় সাহিত্যিক মাসুদুল আলমকে প্রাণঢালা ধন্যবাদ। চমৎকার রক্তাভ প্রচ্ছদ করেছেন ঋক নাঈম। এপ্রিলের প্রথম সপ্তা থেকেই বইটা 'স্বপ্নিল প্রকাশনী' থেকে পাওয়া যাবে, নাম 'রক্ত ও আকাশ'। দাম মাত্র দেড়শ টাকা।
কিনবেন কিন্তু।