গেঁয়ো শীত সিরিজের কোন একটি লেখায় আমাদের পিকনিক নিয়ে স্মৃতিকথা লিখব বলেছিলাম। সেই সূত্র ধরেই আজকের লেখা, গরম গরম লেখা বলতে পারেন। এখন অফিসেই আছি। দুপুর ৩.২৮ মিনিট বাজে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। মুখস্থ পড়ার মতন মাথায় গিজ গিজ করছে ফেলে আসা স্মৃতিগুলি, লিখতে খুব একটা সমস্যা বোধ হয় হবে না। লেখার মান ভাল হবে না হয়ত, হয়তবা গোছালো হবে না! জগাখিচুড়ি যাই হোক, আপনি আমার মত গাইয়া অথবা কিছুটা মান্ধাতার মননের হলে, এই এলোমেলো লেখাই ক্ষণিকের জন্য আপনাকে এলোমেলো করে দেবে, এ আমার বিশ্বাস। আসেন, ঘাটাঘাটি কইরা একটু আউলা ঝাউলা হয়ে যাই............
(১)
আমাদের আব্বা, চাচা, জেঠারা ছিলেন পুরোদস্তুর গেরস্থ। চাষাবাদের পাশাপাশি ব্যবসাও করতেন কেউ কেউ। সারাবছরই বাড়িতে কোন না কোন ফসলের টাটকা গন্ধ লেগেই থাকত। তাদের শিক্ষার দৌড় ছিল বড়জোর বিএ অবধি। আমার আব্বা ইন্টার পাশ মানুষ। কর্মে কৃষক হলেও মনন ছিল সচেতনতায় ভরপুর, সেই সচেতনতা ছিল গেঁয়ো সচেতনতা। সম্ভবত গাঁয়ে বসবাসের জন্যই। খুব শাসনে রাখতেন, যেমন তেমন ছেলেপুলেদের সাথে মিশতে দিতেন না, মারবেল, ডাঙ্গুলি, জুয়া, নদীতে বা পুকুরে গোসল, এইসবে ছিল কড়া বাধা। আমরা তোয়াক্কা করতাম না, বাপ চাচারা বাড়িতে না থাকলেই দৌড় মারতাম। ছোটবেলায় আমাদের পিকনিক বা বনভোজন এই শহুরে ছেলেপুলেদের মত ছিল না। আমাদের আব্বা আম্মারা আমাদের কখনোই ছোটবেলায় পিকনিক এর নাম করে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান নাই। আমাদের যেটা ছিল বা আমরা যেটা করতাম সেটাকে বলা যায় চড়ুইভাতি। শীতকালে স্কুল বন্ধ থাকত, গাঁয়ের দশ বারোজন ছেলেপুলে মিলে আমরা এই চড়ুইভাতির আয়োজন করতাম। বাজার থেকে কিছু কিনতে হতো না। আমাদের যা যা লাগত সবকিছুই সবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হতো। চড়ুইভাতি যেদিন হবে তার দু তিনদিন আগে সবাই বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে বাড়ির পিছনের বা সামনের কোন অনাবাদি জমিতে উনুন বানিয়ে কাদা দিয়ে লেপে শুকাতে দিতাম। চড়ুইভাতির দিন চাল, পেঁয়াজ, মরিচ, তেল, লবণসহ যা যা লাগে সবাই ভাগ ভাগ করে নিয়ে আসতাম। বেশীরভাগ সময় তরকারী হিসেবে থাকত ডিম, মাঝেমধ্যে সবাই দশ বারো টাকা করে দিয়ে মুরগী বা হাঁস নিয়ে আসতাম। এরপর সেগুলি নিজেরাই রান্না করে এশার আযানের আগেই খেয়েদেয়ে ঘরে ফিরতাম। এই ছিল আমাদের পিকনিক।
(২)
হাইস্কুলে উঠবার পরে আমাদের পিকনিক এর ধরন কিছুটা বদলে গিয়েছিল বটে। সেও অবশ্য বড় হবার সাথে সাথে বাড়ি থেকে প্রাপ্ত কিছুটা স্বাধীনতার কারনেই। এই পিকনিকও তখনকার অথবা এখনকার হাইস্কুলের ছেলেপুলেদের মতন ছিল না। এটাও চড়ুইভাতি টাইপই ছিল তবে কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে। আমরা যেহেতু গাঁয়ের স্কুলে পড়তাম, সেহেতু স্কুল থেকে আমাদের কখনো শিক্ষাসফর এর নাম করে আমাদের শিক্ষকেরা দেশের কোন ঐতিহাসিক জায়গা দর্শনে আমাদের নিয়ে যান নাই, যাবার নামও কখনো মুখে তুলতে দেখি নাই। সম্ভবত এই জন্য মুখে তুলেন নাই কারন আমাদের আব্বা আম্মারা এজাতীয় প্রস্তাবে কখনো রাজিও হতেন না, পয়সাও দিতেন না। শহুরে স্কুলের ছেলেপুলেরা প্রতিবছর যেত, আসার সময় হরেক রকম জিনিস পত্তর কিনে নিয়ে আসত, আমরা হা করে তাকিয়ে দেখতাম। আমরা অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণিতে পড়বার সময় ক্লাসের আট দশজন বন্ধু মিলে এই পিকনিক এর আয়োজন করতাম। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের থেকে, কমিটির সদস্যদের থেকে এবং যেসমস্ত ক্লাস অংশগ্রহন করতে ইচ্ছুক তাদের থেকে চাঁদা উঠাতাম (এখানে অবশ্য বাড়তি ইনকাম থাকত) সেগুলি উঠানো হলে, সেই ছোটবেলার মতনই স্কুলের মাঠে উনুন বানিয়ে রাখতাম, নির্দিষ্ট দিনে বাবুর্চি ভাড়া করে নিয়ে আসা হতো। একদিকে বাবুর্চি রান্না করতেন আর অন্যদিকে ছাত্র ছাত্রীরা খাবারের লোভনীয় গন্ধের ভাঁড় নাকের ডগায় নিয়ে ক্লাস করত। কিছু কিছু সিনিয়র ছাত্র থাকত ক্লাসের বাইরে বাবুর্চির নানাবিধ যোগান দিতে। অর্ধকে দিন ক্লাস শেষে শুরু হতো খাওয়া দাওয়া, এরপর লটারি, গান, নাচ, কৌতুক আর সন্ধ্যাবেলা ছুটি।
(৩)
আমরা কলেজটুডেন্ট! পুরোপুরি স্বাধীন, কলেজের নাম করে সিনেমা দেখে বাসায় ফিরলে কিছু বলে না। উত্তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে সারাদিনভর স্রোতের নদীতে ঝাকিজাল দিয়ে মাছ ধরলেও আব্বা রাগের থেকে বরং খুশিই হন। কলেজের বান্ধবীকে প্রেমপত্র দিলেও তারা আমাদের আব্বাকে বলে দেয় না! বাইরে থেকে দু টাকার কে-টু সিগারেট ফুকিয়ে গন্ধমাখা মুখ নিয়ে বাসায় ফিরলেও আম্মা; “শয়তানটা কলেজের বাজে ছেলেদের সাথে মিশে নষ্ট হয়ে গেলো” এই বলার বাইরে আর কিছু করেন না। প্রতিদিন আব্বা বিশ তিরিশ টাকা করে দেন নাস্তা করার জন্য! নানান রকম, নানান ধরণের বন্ধু বান্ধবী, আড্ডা, নবীন বরণ, নতুন নতুন প্রেম, আরও কত্ত কি! কলেজ থেকে অবশ্য বার্ষিক বনভোজন বা শিক্ষাসফর এর আয়োজন করা হতো, অনেকেই যেতো, আমরাও যেতাম, ঘুরতাম, আড্ডা, নাচে গানে আনন্দ ভরপুর মন নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আমাদের জাঁকজমক পিকনিক বলতে যা করতাম সেটা অবশ্যই কলেজের আয়োজন এর বাইরে তবে কলেজের বন্ধুরা মিলেই। এসময় আমরা অংশগ্রহণকারী বন্ধুরা সবাই ৫০০/৬০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে অচেনা কোন গ্রামের ফাকা অনাবাদী কোন জমি বা নদীর ওপারে গিয়ে রাতভর হৈ হুল্লোর করতাম। বেশীরভাগ সময়ই নৌকা ভাড়া করে সেখানে উচ্চ সাউন্ডে হিন্দি গান চালিয়ে নাচতে নাচতে পিকনিক এর জন্য নির্ধারিত জায়গায় যেতাম। এরপর বাজার সওদা সেরে কেউ ব্যস্ত হয়ে যেতো রান্নায়, কেউ সিডি টিভি সেট আপে, কেউ সাউন্ডবক্স সেট আপে, কেউ তাবু টানানোতে, কেউবা আশে পাশের কোন বাড়ি থেকে রাতে শোবার জন্য খড় চুরি করতে! সবকিছু সেট আপ হয়ে গেলে শুরু হয়ে যেত হৈ হুল্লোর! হৈ হুল্লোর এর ধরনটা বলে নেয়া যাক, যে গ্রামে আমরা পিকনিক করছি সেখানে যদি কলেজের কোন বান্ধবীর বাড়ি থাকত এবং যদি তার কোন ছদ্মনাম থাকত, মাউথপিস হাতে নিয়ে সেই নাম ধরে চলতো নানান মজা ঠাট্টা! আবার রাতের খাবারে যদি রান্না হচ্ছে মুরগী বা হাঁস, তো মাউথপিস হাতে নিয়ে কেউ চিল্লায় চিল্লায় হুদাই কোন বন্ধুর নাম ধরে ডাকতো; “জিওন, তুমি যেখানে থাকো না কেন, তারাতারই খাসিটা আর ছুরিটা নিয়ে আমাদের মাইকের কাছে চলে আসো, আমাদের সময় খুব কম, খাসিটা তারাতারি জবাই করতে হবে!” আশেপাশের গাঁয়ের লোকেদের শুনানো হতো আর কি! এরপর বাকীরাত কেটে যেতো এমনি নানা মজা আর উৎসবে। সে রাতে সেই গ্রামের লোকেদের ঘুম হারাম!
(৪)
পিকনিকের একালঃ
এখন গাঁয়ের মানুষেরাও বেশ ফ্রী মাইন্ডেড। তারা আর গেঁয়ো সচেতন নেই। শহুরে সচেতন বনে গেছেন। তাদের ছোট্ট ছেলেপুলেদের নিয়ে তারা সাজেক, কক্সবাজার, চিড়িয়াখানা সব ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন। হাইস্কুল পড়ুয়া ছেলেপুলেরা আগের মতই শিক্ষাসফরে যায়, ভিন্নতা শুধু একটাই। আগে আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের অনেকটা বেঁধে রাখতেন তাদের গণ্ডির ভেতর। এখনকার শিক্ষকদের অত সময় কোথা! তারা তাদের বেগম আর সন্তানদের সময় দিতে কুল পান না! ওদিকে ক্লাস সেভেন এইটে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা ঝোপের আড়ালে প্রেম করে! অথচ ঐ বয়সে আমরা কোন মেয়েকে চিঠি অবধি দেবার সাহস পেতাম না এই ভয়ে যে; যদি বাসায় আব্বাকে বলে দেয়! কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আরও ভিন্ন! এখানে পিকনিকের কোন জায়গা নাই, এরা পিকনিক বা বনভোজন চিনে না, এরা শীতকাল এলে সাজেক, কক্সবাজার বা বাইরে কোথাও যেখানে যায় সেটাকে ট্যুর বলে! চারজন মেয়ে, চারজন ছেলে, চারটা কামরা, ডিএসএলআর, সেলফিস্টিক, খাওয়া দাওয়া না হলেও চলে!
একালের পিকনিক সবাই যে এভাবে কাটিয়ে দেয় তা বললে ভুল বলা হবে, কিছু কিছু এরকম দেখা যায়। আর আমার দেখা সিংহভাগই আমি এমনটাই দেখি আশেপাশে সিনিয়র, জুনিয়র অথবা বন্ধুদের ভেতর!
দ্রষ্টব্যঃ আমি কিছুটা মান্ধাতার। একজন নতুন ব্লগার হিসেবে আমি আপাত এসব লেখাতেই চালিয়ে যাচ্ছি! অন্তত লিখছি আর কি! সাম্প্রতিক অথবা যুগোপযোগী, যাই বলি না কেন! সেরকম লেখা লিখতে হলে আমার কাছে মনে হয় ব্যাপক পড়াশুনা থাকা প্রয়োজন। আমার কাছে মনে হয় আমি এখনো পরিণত নই! অযৌক্তিক কিছু লিখে পাকনামি দেখানোটা নিছক হাস্যকর ছাড়া আর কিছু হবে না। লিখতে লিখতে একদিন লেখা হয়ে যাবে হয়তো, অন্তত লেখা তো চলুক! কি বলেন? শুভকামনা সবার জন্য! স্মৃতি নিয়ে বাঁচুন, নিজের শেকড় আঁকড়ে বাঁচুন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৪১