শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
দশটার দিকে সাদিয়া রাসেদকে কয়েকবার মোবাইল করেও পেল না। মোবাইল বন্ধ। রাসেদের মোবাইল ছিনতাই হয়েছে। রাসেদ জানে সাদিয়া সকাল থেকেই বার বার ফোন দিবে কিন্তু সাদিয়ার বাবার ব্যাবহারের কারণে সাদিয়ার সাথে আর কথা বলার ইচ্ছে হলো না। সাদিয়ার বাবা যে আচরণ করেছে তাতে লুচ্চামী না করেও লুচ্চার মুখ নিয়ে তার সামনে যাওয়া আর সম্ভব নয়।
পতিতাগুলো পকেট থেকে টাকা পয়সা বের করে নেয়ার পরেও রাসেদের প্যান্টের ব্যাক পকেটে একটি পাঁচ শত টাকার নোট থেকে গিয়েছিল। রাসেদ পকেট হাতিয়ে সেই টাকা পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল। মাহিলাদের টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়া আর পুলিশের আচরণে তিক্ত অভিজ্ঞতা হওয়ার পর আর এক মূহুর্তও যশোরে থাকতে ইচ্ছে হলো না। বার বার মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করার চেষ্টা করাটা মনে হয় ঠিক হয়নি। একটা পর্যায়ে সাদিয়ার উপর খুব রাগ হলো। সাদিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী তার বাপকে যা কল্পনা করেছিল তা পেল না। মায়ের কথাই ঠিক হলো।
রাসেদ মায়ের সাথে চলেঞ্চ নিয়েই এসেছিল। সব পুলিশের আচরণ যে খারাপ হয় না এটা সাদিয়ার বাপকে দিয়েই দেখিয়ে দিবে। কিন্তু সে চ্যালেঞ্চ আর থাকল না। সাদিয়ার বাবার সাথে পরিচয় হওয়ার আগেই সেই চ্যালেঞ্চ নষ্ট হয়ে গেল। এখন মাকে গিয়ে সে কি বলবে? রাগে দুঃখে অভিমানে সাদিয়ার বাবার সাথে আর দেখা করল না। সকালের ফাষ্ট টিপেই বাস ধরে ঢাকায় ফিরে এলো।
বাসায় ফিরে মাকে নিজের থেকে কিছুই বলল না। কিন্তু মা সাদিয়ার বাবা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল। মায়ের প্রশ্নের জবাবে রাসেদ বলল, সব পুলিশ সমান নয় মা, পুলিশের মধ্যেও ভাল-মন্দ আছে।
সাদিয়ার মা বলল, পুলিশের মধ্যে ভাল-মন্দ আছে সে তো আমিও জানি। তুই সাদিয়ার বাবাকে কেমন দেখলি সেইটা বল?
-- পুলিশ হিসাবে সাদিয়ার বাবা মন্দ নয় মা। তবে চিন্তা করে দেখলাম, তোমার মতের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না মা। তুমি যা ভাল মনে করবে তাই করবো।
ছেলের এমন কথায় রাসেদের মা কিছুই বুঝতে পারল না। কিছুটা বিস্মিত হলো। যে ছেলে সাদিয়ার জন্য পাগল, সাদিয়ার বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, সে ছেলে হঠাৎ করে ঘুরে গেল কেন? তাহলে কি রাস্তায় গিয়ে ও মায়ের কথা ভেবেছে? রাসেদের কথা শুনে অনেকক্ষণ রাসেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সাদিয়ার বাপের সাথে তোর দেখা হয় নাই?
-- হয়েছে।
-- কথা হয় নাই?
-- হয়েছে
-- কেমন লোক?
-- ভাল
-- রাসেদের মা শুধু বলল, ভাল হলেই ভাল।
রাসেদ মায়ের কাছে ছিনতাই থেকে সাদিয়ার বাবার সাথে দেখা হওয়ার সমস্ত ঘটনা চেপে গেল। এরকম অনাকাংখিত লজ্জাজনক ঘটনা মায়ের কাছে বলাও সম্ভব নয়। তবে যশোর থেকে ফিরে রাসেদ একদম চুপ হয়ে গেল। মায়ের সাথে আগে যেমন সাদিয়াকে নিয়ে প্রশংসামূলক কথা বলতো এখন সে সাদিয়া সম্পর্কে কিছুই বলে না। মন মরা হয়ে এক সপ্তাহ বাসায় কাটিয়ে দিল।
হঠাৎ রাসেদের এই পরিবর্তন দেখে রাসেদের মা কিছু বুঝতে না পারলেও তার পরিবর্তনটা ঠিকই লক্ষ্য করল। সে মনে মনে ভাবল, পুলিশের মেয়ে বিয়ে করতে নিষেধ করেছি এটা হয়তো তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। মেনে নিতে গিয়ে হয়তো ভেবে পাচ্ছে না এখন কি করা উচিৎ। সাদিয়ার ভাবনা চিন্তার কারণেই হয়তো রাসেদ চুপ হয়ে গেছে, বিনা করণে কোন কথা বলছে না।
যশোর থেকে ফিরে পুরো এক সপ্তাহ রাসেদ ইউনিভার্সিটিতে গেল না। সাদিয়া প্রত্যেক দিন এসে রাসেদকে খুঁজে বেড়ায় কিন্তু রাসেদের দেখা পায় না। এক সপ্তাহ পড়ে রাসেদ ইউনিভার্সিটিতে গেলেও ক্লাসে না গিয়ে লাইব্রেরীর উত্তর পার্শ্বে গাছতলায় বসে থাকল। রাসেদ ক্লাসে না গিয়ে গাছ তলায় লুকিযে থাকলে কি হবে সাদিয়া ঠিকই খবর পেয়ে যায়। ক্লাস থেকে বের হয়ে সোজা রাসেদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাথে ক্লাসের অন্য বান্ধবীরাও আছে। এসেই সাদিয়া রাসেদকে জিজ্ঞেস করল, তুমি যশোরে গেলে না কেন?
রাসেদ কোন কথা বলল না।
সাদিয়া আবার জিজ্ঞেস করল, ফোন বন্ধ রেখেছ কেন?
রাসেদ সাদিয়ার এ কথারও কোন জাবাব না দিয়ে চুপচাপ নিচের দিকে মুখ করে বসে থাকল।
রাসেদ কথা না বলায় সাদিয়া উত্তেজিত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, কি হলো, কথা বলছো না কেন?
রাসেদ কথা বলতেই এসেছিল কিন্তু সাদিয়াকে দেখেই তার বাবার আচরণ চোখে ভাসতে লাগল। তার বাবার আচরণে ক্ষিপ্ত হয়েই রাসেদ জেদের বসে সাদিয়ার সাথে কথা না বলে চুপ করে বসে আছে।
এদিকে সাদিয়া মনে মনে ভাবতে লাগল, হয়তো রাসেদ মায়ের কথামতো যশোর না গিয়ে তাকে এরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মায়ের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে ডুব মেরেছে। সেই জন্য হয়তো বার বার প্রশ্ন করলেও রাসেদ কোন কথার জবাব দিচ্ছে না। বার বার প্রশ্ন করে প্রশ্নের কোন উত্তর না দেয়ায় সাদিয়া আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। উত্তেজিত হয়ে বলল, বুঝতে পেরেছি-- মায়ের কথায় পিছুটান মেরেছো, মায়ের কথামতই যদি চলবে তাহলে আমাকে ভালবাসতে গেলে কেন? ভালবাসার পর যদি বিয়ে করার সাহস না থাকে সেটা আমাকে বললেই হতো। কিন্তু বিয়ে করার কথা বলে এর মধ্যে আমার বাবাকে জড়ালে কেন? জড়ালেই যদি বাবার সাথে দেখা করতে চেয়ে দেখা করলে না কেন?
সাদিয়ার এতগুলি প্রশ্নমূলক কথা বলার পরও রাসেদ কোন কথা না বলে চুপ করে থাকল। রাসেদের কাছ থেকে প্রশ্নের জবাব না পেয়ে সাদিয়া আরো ক্ষেপে গেল। ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তেজিত গলায় বলল, এই হারিমীর বাচ্চা, কথা বলছিস না কেন? তোর মায়ের দাম আছে আমার বাবার দাম নেই? তুই আমার বাবার কাছে আমাকে ছোট করলি কেন?
রাসেদ ভেবেছিল সাদিয়া যদি সামনে এসে কথা না বলায় কান্নাকাটি করে তবে তার বাবার প্রতি নাখোশ হলেও তাকে সে গ্রহণ করবে। সাদিয়ার বাবার আচরণের কারণে দীর্ঘ দিনের প্রেমকে নষ্ট করবে না। কিন্তু তার এই ভাবনার বিপরীত ঘটে গেল। রাসেদের মাকে তুলে গালাগালি করায় রাসেদ ভিতরে ভিতরে ফুসতে লাগল। যাও একটু কথা বলার ইচ্ছা ছিলা সেটাও আর বলার ইচছা হলো না।
সাদিয়ার গালাগালিতে রাসেদ আরো কঠিন হয়ে গেল। কথা তো বললই না এমন কি মাথা তুলে সাদিয়ার দিকে একবার তাকালও না। রাসেদের এরকম মাথা নিচু করে বসে থাকার কারণে সাদিয়ার মেজাজ আরো চড়ে গেল। রাগ সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে রাসেদের গালে ঠাস করে চড় মেরে বসল। চড় খাওয়ার পরও রাসেদ কোন কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে বসেই রইল।
সাদিয়ার হাতে চড় খাওয়ার পরও রাসেদ চুপচাপ বসে থাকায় বান্ধবীরাও আশ্চার্য হয়ে গেল। তারাও ভেবে পাচ্ছে না রাসেদ হঠাৎ এরকম হয়ে গেল কেন। একটা পুরুষ মানুষ তো এত চুপ করে থাকার কথা না। সে কি পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি?
সাদিয়া বাস্টার্ড মাস্টার্ডসহ রাসেদের মাকে তুলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে করতে রাগে দুঃখে উত্তেজনায় কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
সাদিয়া চলে যাওয়ার পর বান্ধবী আকিফা রাসেদের এমন ভূমিকার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য থুতনি ধরে মুখটা উপর দিকে তুলে ধরল। চেয়ে দেখে রাসেদের চোখ দিয়ে জল টপ টপ করে পড়ছে।
রাসেদের চোখে জল দেখে আকিফা কিছু বলার সাহস পেল না। অনেকক্ষণ পর কাছে বসে আদরের সুরে বলল, রাসেদ, ভাই আমার, তুই খুলে বল তো তোর কি হয়েছে? তুই সাদিয়ার চড় খাওয়ার পরও কথা বললি না কেন?
রাসেদ আকিফার কথায় চোখ মুছতে মুছতে শুধু বলল, পরে একদিন বলবো রে। এখন মেজাজ ঠিক নেই, এখন বলতে পারবো না।
আকিফা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তোর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছি, তোর এখন এখানে থাকা ঠিক নয়, তুই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যা।
রাসেদ আর একমুহুর্ত দেড়ি না করে বাসায় চলে গেল।
তিন দিন পরে রাসেদ ইউনিভার্সিটিতে এলো। আজকেও ক্লাসে না গিয়ে লাইব্রেরীর পাশের সেই কাঁঠাল গাছ তলায় বসে থাকল। ক্লাস শেষে ক্লাসের আর কারো চোখে না পড়লেও আকিফার চোখে পড়ল। আকিফা কাউকে সাথে না নিয়ে একা একা রাসেদের কাছে এসে বসল। রাসেদ আকিফাকে দেখে মুখ তুলে একটা হাসি দিয়ে আবার মুখ নিচের দিকে দিল।
আকিফা দু’একটি অন্য কথা বলে জিজ্ঞেস করল, তুই সাদিয়ার ব্যাপারে নিরব হয়ে গেলি কেন রে? একটু খুলে বলতো?
রাসেদ মাথা নিচু করেই বলল, না শুনলে হয় না।
-- না শুনলেও হয়, তবে সেদিনের সাদিয়ার আচরণটা আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে, আর তোর নিরব ভূমিকাটাও আমার কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে। তুই খুলে না বললে নানা ধরনের প্রশ্ন মনের মধ্যে জেগে উঠছে।
-- সাদিয়া এভাবে চড়াও হবে আমি বুঝতে পারি নি রে। বুঝলে ইউনিভার্সিটিতেই আসতাম না।
-- সাদিয়া এমন করবে এটা তো আমরাও বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলে তো তোকে এসেই ভাগিয়ে দিতাম। তবে কথা হলো-- রহস্যটা কি বলতো? কি হয়েছে তোর? তিন বছর প্রেম করে হঠাৎ করে পিছুটান দিলি কেন?
-- সে অনেক কথা রে।
-- যত কথাই হোক, না বললে বুঝবো কি করে?
রাসেদ যশোর যাওয়ার সমস্ত ঘটনা আকিফার কাছে খুলে বলল। আকিফা তার ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, রাসেদ, এত কিছু ঘটনা ঘটল তারপরেও তুই নিরব থাকলি কেন? তুই তো সাদিয়াকে সব কিছু খুলে বলতে পারতিস?
-- ওর বাবার আচরণে যতোটা না ক্ষুব্ধ ছিলাম, সেদিনের আচরণে তার চেয়েও বেশি ঘৃণা এসে গেছে রে। এই জন্য ওর সাথে আর কথাই বলতে ইচ্ছা করছে না।
-- তাই বলে তুই সাদিয়ার চড় খেয়েও নিরব থাকবি?
-- নিরব না থেকে কি করবো। ও তো ওর বাবার প্রতি খুব দুর্বল। এসব ঘটনা বললে হয়তো ও বিশ্বাস করবে না।
-- ওকে না জানালে ও কি করে বিশ্বাস করবে?
-- আমি আর ওর সাথে কথাই বলবো না। পারলে তুই জানিয়ে দিস।
দুই দিন পরে আকিফা সাদিয়াকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই রাসেদ কে চড় মারলি কেন রে?
সাদিয়া উত্তেজিত ভাবে জবাবে বলল, মারবো না, হারামাজাদা যশোর যাওয়ার কথা বলে যায় নাই। আমার বাবার কাছে আমাকে ছোট করেছে। দেখা করতে চেয়ে দেখা করে নাই। বাবার কাছে খুব বড় মুখ করে ওর যাওয়ার কথা বলেছিলাম। অথচ সে তার মায়ের কথায় আমার সাথে বেঈমানী করেছে।
আকিফা বলল, রাসেদ যে যশোরে যায় নাই এটা তুই কি করে বুঝলি?
-- গেলে তো বাবার সাথে দেখাই করতো?
-- আমি জানি ও যশোর গিয়েছিল।
-- না-- হারামজাদা যশোরে যায় নাই।
-- সে যশোর গিয়েছিল এবং তোর বাবার সাথে দেখাও করেছিল।
-- প্রশ্নই আসে না। কুত্তার বাচ্চা যশোর যায় নাই। গেলে বাবা কখনই আমাকে মিথ্যা বলবে না।
আকিফা খুব বিশ্বস্ততার সাথে বলল, রাসেদ যশোর গিয়েছিল এবং তোর বাবার সাথে দেখাও করেছিল। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা ঘটায় পরিচয় দিতে পারে নাই।
কি বলিস তুই, দুর্ঘটনা ঘটলে বাবা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে রক্ষা করার চেষ্টা করতো। ওই কুত্তা তোকে মিথ্যা বলেছে। ও আসলে যায় নাই।
আকিফা সাদিয়ার মত উত্তেজিত না হয়ে আস্তে আস্তে বলল, রাসেদ গিয়েছিল এবং তোর বাবার সাথে দেখাও হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এমন একটা অঘটন ঘটে যার কারণে সে তোর বাবার কাছে পরিচয় দিতে পারে নাই।
-- কি এমন আশ্চার্য ঘটনা ঘটে যে বাবার কাছে পরিচয় দিতে পারে নাই?
-- তোর বাবার সাথে এমন একটা লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে যার ফলে লজ্জায় সে আর তোর বাবার সামনে দ্বিতীয়বার যায় নাই।
-- কি এমন ঘটনা খুলে বল তো?
আকিফার কথায় সাদিয়া কিছুটা নরম হলে আকিফা রাসেদের যশোর যাওয়ার পর থেকে ছিনতাই হওয়া এবং তার বাবার সাথে লজ্জাজনক বাতচিতের ঘটনার সমস্ত কাহিনী খুলে বলল। আকিফার কাছে রাসেদের দুর্ঘটনা এবং বাবার দুর্ব্যাবহারের কথা শুনে সাদিয়া লজ্জায় চুপসে গেল। রাসেদের মত সাদিয়ারও বাবার প্রতি ঘৃণা এসে গেল। সাদিয়া বিগত তিন বছর হলো রাসেদকে চেনে। সে খারাপ ছেলে নয়। কিন্তু তার বাবা তাকে জঘন্য ভাষায় কথা বলাতে বেদিক হয়ে গেল। রাসেদ নির্দোষ হওয়া সত্বেও তাকে চড় মেরেছে। এই ভুলের জন্য মনে মনে অনুশোচনা করতে লাগল। মনের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। একটা পর্যায়ে সে হু হু করে কেঁদে উঠল।
তার কান্না দেখে আকিফা শান্ত হতে বললেও শান্ত হতে পারল না। কাঁদো কাঁদো অবস্থায় ভেজা ভেজা চোখ নিয়ে নিথর হয়ে বসে ভাবতে লাগল, একি করল সে, না জেনে না শুনে তাকে কেন চড় মারল। চড় মারা হাত এই মুহুর্তে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বাম হাত দিয়ে ডান হাত মোচড়াতে লাগল।
আকিফার কাছে ঘটনা শুনে বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হলো। অনেক বড় মুখ করেই রাসেদকে বাবার কাছে পাঠিয়েছিল। রাসেদও মায়ের সাথে চ্যালেঞ্চ করেই গিয়েছিল। কিন্তু এরকম একটা ঘটনা ঘটবে এটা সাদিয়া কল্পনাও করে নাই। রাসেদের মা কি কারণে পুলিশের উপর নাখোশ সেটা সে জানে না। তবে তার নাখোশ হওয়ার বিষয়টি এই ঘটনায় আরো জোড়ালো হলো। বিনা করণেই রাসেদের মাকে গালিগালাজ করেছে। অথচ সে নির্দোষ। রাসেদকে চড় মারা থেকে রাসেদের মাকে গালি দেওয়ার সব ঘটনা তার মনে পড়তে লাগল। নিজেকে খুব অপরাধি মনে হতে লাগল।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আকিফার কাছে আস্তে আস্তে বলল, এখন আমার কি হবে রে আকিফা? আমার কি সব শেষ হয়ে গেল রে? আমি এখন কি করবো রে?
আকিফা আশ্বাস দিয়ে বলল, এত ভেঙে পরছিস কেন? ধৈর্য ধর না, একটা সমাধান অবশ্যই হবে।
--তুই কি রাসেদ কে ডেকে আনতে পারবি?
-- কেন?
-- আমি ওর পা ধরে মাফ চেয়ে নিব।
-- কোন হাত দিয়ে পা ধরবি?
-- কেন?
-- ডান হাত দিয়ে তো চড় মেরেছিস, শুধু বাম হাত দিয়ে ধরলে তো অপমান করা হবে-- -
-- তাই তো! বলেই সে আকিফার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আকিফার কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বাবাকে ফোন করেই ইচ্ছে মত গালাগালি করতে লাগল। হঠাৎ মেয়ে ক্ষেপে গেল কেন বাবা বুঝতে পারছে না? কান্নারত মেয়ের গালাগালির ধরন দেখে বলল, আরে পাগলী কি হয়েছে খুলে বল না?
-- রাসেদ দেখা করার পরও তুমি মিথ্যা বললে কেন? বলেই কাঁদতে লাগল।
-- আরে পাগলী সে ছেলে তো আসেই নাই, আমার সাথে দেখা করলো কখন?
-- যাওয়ার কথা ছিল সকাল দশটায়, বাস থেকে নেমে রিক্সায় যাওয়ার পথে ছিনতাই হওয়ায় সে ভোর পাঁচটায় থানায় গিয়েছিল, আর তুমি তাকে পুলিশী কায়দায় অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছো। যে কারণে সে আর নিজের পরিচয় দিতে পারে নাই।
মেয়ের কথা শুনে ছালাম দারোগার সম্বিৎ ফিরে এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল। ওইটাই যে সেই ছেলে সেটা সে ঘুণক্ষরেও বুঝতে পারে নাই। নিজের কৃত কর্মের জন্য নিজেই আফসোস করতে লাগল। কিন্তু এই মূহুর্তে মেয়েকে তো শান্ত করা দরকার। তা না হলে বাপের উপর মেয়ের ভুল বোঝাবুঝি চরম আকার ধারণ করবে। বাপ মেয়ের সম্পর্কের মাঝেও ফাটল ধরতে পারে। ছেলের সাথে সম্পর্ক থাক বা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। মেয়েকে বোঝাতে হবে। নইলে যে কোন অঘটন ঘটতে পারে। এমন কি মেয়ে আত্মহত্যাও করতে পারে। সেই চিন্তা করেই মেয়ের কথার জবাবে চটপট বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, মা, ছেলেটা ভাল নয় মা, ওটা একটা লুচ্চা। ওকে তুই ভুলে যা। ও তোর কাছে ভাল হওয়ার জন্য ছিনতাইকারীর কথা বলেছে ও আসলে খারাপ জায়গায় গিয়েছিল মা। বাবা হয়ে তোকে আর কিছু বলতে পারছি না। তুই আমার কথা বিশ্বাস কর।
বাবার কথা বিশ্বাস না করে সাদিয়া বাবাকে আরো গালাগালি করতে লাগল।
মেয়ের গালাগালি শুনে ছালাম দারোগা বলল, মা, তুই ওই ছেলেকেই জিজ্ঞেস কর ও কোথায় গিয়েছিল এবং ওর কাপড়ে লিপিস্টিকের দাগ এলো কোথা থেকে? ছেলেটার কাছ থেকে প্রশ্নগুলোর জবাব নিয়ে তারপর আমাকে যত পারিস গালি দে।
-- বাবা, আমি ওকে ভাল করেই চিনি। নিজের দোষ চেপে যাওয়ার জন্য তুমি আমার কাছে মিথ্যা বলছো। এটা তোমার পুলিশী কায়দা।
-- যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়, যারা ওই সময় থানায় ডিউটিতে ছিল তাদের তুই জিজ্ঞাসা করে দেখ না? ও যে লুচ্চামী করেছে এবং তার চিহ্ন যে ওর শরীরে ছিল সেটা ওরাই বর্ণনা দেরে।
-- থানায় যারা ডিউটি করে তারা তো তোমার কথা মতই কথা বলবে বাবা। তারা কি সত্যি কথা বলবে?
-- এর পরেও যদি তোর বিশ্বাস না হয় ছেলেটাকে সাথে নিয়ে আমার সামনে আয়। আমি ছেলেটার কুকীর্তি সামনাসামনি প্রমাণ করে দেব।
রাসেদের লুচ্চামী সম্পর্কে বাবার কনফিডেন্স নিয়ে কথা বলা দেখে সাদিয়াও কিছুটা নরম হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল নিশ্চয় রাসেদ খারাপ কিছু করেছে। তা না হলে যশোর গিয়ে ফোন বন্ধ রাখল কেন। যশোরে যদি ফোন ছিনতাই হয়ে থাকে ঢাকায় এসেও তো ঘটনাটা আমাকে বলতে পারতো। তা না বলে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। লুচ্চামী করেছে বলেই হয়তো আমার কাছে বলার সাহস পায় নি।
রাসেদের ব্যাপারে সাদিয়ার মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিল। খারাপ কিছু যদি নাই দেখবে তবে বাবা কেন তার প্রতি নোংরা ভাষা ব্যাবহার করবে? কোন বাবাই চায় না তার মেয়ের খারাপ কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক হোক। নিশ্চয় বাবা প্রমাণাদি পাওয়ার পরেই এমন আচরণ করেছে। ছেলেদের মন তো বলা যায় না, সুযোগ পেয়ে রাতের অন্ধকারে খারাপ জায়গায় যেতেও পারে। বাবার কথায় রাসেদের প্রতি সাদিয়ার অবিশ্বাস এসে গেল।
কিন্তু রাসেদের উপর সাদিয়ার অবিশ্বাস বা ঘৃণা যত না কাজ করছিল তার চেয়ে বেশি দ্বিধা দ্বন্দে¦ পড়ে গেল চড় মারা নিয়ে। যত খারাপই হোক, দীর্ঘ দিন প্রেম করে তার গালে চড় মারাটা বোধ হয় ঠিক হয় নি। চড় মারার পর তার সামনে কি আর যাওয়া সম্ভব? সাদিয়া এই চিন্তা করেই চুপ হয়ে গেল।
পরক্ষণেই আবার মনে মনে ভাবতে লাগল পুলিশের ঘরে জন্ম নিয়ে ভালই হয়েছে, তা না হলে রাসেদের এমন চরিত্র কোন দিনই জানা সম্ভব হতো না। বাবা যখন তাকে লুচ্চা হিসাবে আবিষ্কার করেছে তখন ওকে আর বিয়ে করা উচিৎ হবে না। ওর পিছন ছেড়ে দেয়াই ভাল। মরে গেলেও আর ওর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।
(সমাপ্ত)
গল্প ঃ পুলিশের মেয়ে প্রথম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:২২