মাজার ভবনের সামনের অংশ
আমি কোন পাগল বা পীর, ফকিরের ভক্ত নই। তবে এধরনের আস্তানা বা মাজারগুলো নিজের কৌতুহল থেকেই ভ্রমণ করে থাকি। সেই কৌতুহল থেকেই লেংটার মেলায় যাওয়া।
১৯৯০ সালে নারায়নগঞ্জের শীতলক্ষা নদী পার হয়ে পূর্বপাড়ে সোনাকান্দা এলাকার নদীর তীর দিয়ে একা একা হাঁটতে ছিলাম। চৈত্র মাস, প্রচন্ড গরম। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে নদীর পাড়ে একটি গাছের ছায়ায় বসে আরাম করছি। এমন সময় একটি নৌকা এসে ঘাটে ভিড়ল। নৌকার সবাই প্রায় লাল সালু কাপড় পরা জটাধারী পাগল ধরনের লোক। সাথে কয়েকজন বয়ষ্কা মহিলা আছে তাদের শরীরেও লাল শালু কাপড় জড়ানো। কয়েকজন নৌকা থেকে নেমে এলে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনারা কোথা থেকে আসলেন?
গেরুয়া পরা লোকটি বলল, বেলতলী লেংটার মেলায় গিয়েছিলাম।
তখনও লেংটার মেলা সম্পর্কে আমার কোন ধারনা ছিল না। পরে অফিসে এসে লেংটার মেলার কথা বলতেই একজন বলল, কুমিল্লা জেলার মতলব থানার বেলতলীতে লেংটা পীরের মাজার আছে। এখানে প্রতি বছর চৈত্র মাসে মেলা হয়। তখন থেকেই ওই মেলায় যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু সময় এবং যাতায়াত সম্পর্কে কোন ধারনা না থাকায় যাওয়া হচ্ছিল না।
এবছর সাদা মনের মানুষ-এর কোন এক লেখায় পড়েছিলাম বেলতলীর লেংটার মেলা চৈত্র মাসের ১৭ তারিখে শুরু হয়ে ৭দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সেই কথা মনে হতেই সাদা মনের মানুষের অর্থাৎ কামাল ভাইয়ের কাছে টেলিফোন দিয়ে যাতায়াতের বিষদ বিবরণ জেনে নিলাম। গত শনিবারে যেতে চেয়েও অচেনা রাস্তার কারণে দ্বিধা দ্বন্দে পড়ে যাওয়া হয়নি।
গতকাল এপ্রিলের ৩ তারিখ রোববার খুব সকালে রওনা হবো কিন্তু গুমোট গরম এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় বের হতে গিয়েও বের হওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। পরে সকাল দশটার সময় বের হয়ে প্রথমেই গুলিস্থান এসে বিআরটিসি এসি বাসে উঠে দাউদ কান্দির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভবের চর পার হয়ে দাউদ কান্দি ব্রিজে উঠার আগেই ড্রাইভারকে বললাম, ভাই, আমি এখানেই নামবো। ড্রাইভার বাস থামালে আমার সাথে আরো তিন চারজন নামল।
বাস থেকে নেমে ব্রিজের পশ্চিম পাড়ের অনেক উঁচু খাড়া রাস্তার ঢালু বেয়ে কিছুটা গড়িয়ে কিছুটা দৌড়িয়ে নিচে নেমে এলাম। একজনকে নৌকা ঘাটের কথা জিজ্ঞেস করতেই আঙ্গুল দিয়ে দক্ষিণ দিকে দেখিয়ে দিল। কিছুদূর যাওয়ার পরেই মধ্য বয়স্ক এক দম্পতির সাথে দেখা হলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কোথায় যাবেন? ভদ্রলোক বলল, লেঙটার মেলায় যাবো। তার মুখে লেংটার মেলায় যাওয়ার কথা শুনে খুশি হলাম। আমিও বললাম, আমিও লেংটার মেলায় যাবে।
ভদ্রলোকের সাথে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকার সব যাত্রীই ছিল বেলতলীর। নৌকা একটু পরেই ছেড়ে দিল। দক্ষিণা বাতাসে গোমতি নদীর ঢেউ কেটে নৌকা দক্ষিণ দিকেই তরতর করে এগোতে লাগল। নদীতে বালু বোঝাই বড় বড় ট্রলার, যাত্রীবাহি লঞ্চ, জেলেদের নৌকা দিয়ে মাঝ ধরার পাশাপাশি নদীর দুই পাড়ের মনোরোম দৃশ্য দেখতে ভালই লাগছিল। প্রায় এক ঘন্টা চলার পর নৌকা বেলতলীর ঘাটে গিয়ে ভিড়লে সবার সাথে আমিও নেমে পড়ি।
নৌকা থেকে নেমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা ১-২৬মিঃ। নদীর কিনারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রতি মুহুর্তেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাত্রী বোঝাই নৌকা আসছে। সব বয়সি লোকজনই চোখে পড়ল। সবাই যে লেংটার ভক্ত তা মনে হলো না। কেউ এসেছে ভক্ত হিসাবে, কেউ এসেছে আমার মত জানার এবং দেখার কৌতুহল নিয়ে, কেউ এসেছে মেলায় আগত বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ক্রয় করার জন্য। জটাধারী পাগল যত না চোখে পড়ল তার চেয়ে ভদ্র ধরনের লোকজনের সংখ্যা বেশি ছিল। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নতুন-পুরান দম্পত্তির অভাব নাই।
পুরো মেলা জুড়ে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম বেশির ভাগ নারী পুরুষই একটি করে লাল গামছা ঘাড়ে গলায় জড়িয়ে রেখেছে। কেউ কেউ এক গামছা পড়েছে আরেকটি গায়ে জড়িয়ে ঘুরছে। লাল গামছা পরতেই হবে এমন কোন শর্ত আছে কিনা জানি না। দু'একজনকে জিজ্ঞেস করলেও সুদুত্তর দিতে পারে নাই।
দাউদ কান্দি ব্রিজের পশ্চিম পাড় থেকে তোলা ছবি।
এই লঞ্চ ঘাট থেকেই বেলতলী যাওয়ার নৌকা ছাড়ে।
জেলের নৌকা
আহা অনেক দিন পর এমন দৃশ্য চোখে পড়ল।
তারাও বেলতলীর যাত্রী।
নৌকা থেকে বেলতলীর সর্বত্র লাল নিশান উড়ানো দেখেই বোঝা যায় মেলার রমরমা অবস্থা।
বেলতলী ঘাটে নৌকা থেকে নামার পালা।
বেলতলী লঞ্চঘাট
লঞ্চঘাট থেকেই শুরু হলো মেলার দোকান
মাজারের সামনের মনোরোম তরোণ।
বিশাল মমবাতি জ্বালিয়ে একদল ভক্ত মাজার প্রাঙ্গণে এসেছে।
মানত করা ছাগল হাতে এক মহিলা মাজারে যাচ্ছে।
বৃদ্ধের মাথার বিশাল গামলায় হয়তো মানত করা চাল ডাল হবে।
এক পাগল বসে বসে মনের সুখে গান গাচ্ছে।
মমবাতি মাথায় নিয়ে পাগলদের নৃত্য।
ব্যান্ড পার্টির ঢোলের তালে উন্মত্ত পাগলা পাগলীর দল।
মাজারের ভিতরে মহিলা ভক্তবৃন্দ।
রঙ বেরঙের বাহারি মালা।
লেংটার মাজার সম্পর্কে যা জেনেছি।
সোলেমান লেংটা উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আউলিয়ার দাবিদার। বাংলা ১২৩০ সালে কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার গোবিনাদপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আলা বক্স ভূঁইয়া। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন মতলবের বিভিন্ন অঞ্চলে। সোলেমান লেংটা কখনো পোশাক পরিধান করতেন না। তাই তার মাজারটি লেংটার মাজার হিসাবেই পরিচিত। লেংটা ১৮ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন। পরে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলির রাধানগরে এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখন সেখানে তার আওলাদরা আছে বলে দাবি উঠেছে এবং তারা প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় ওরসের ডাক দিচ্ছে।
শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটার ফকিরি লাভ সম্পর্কে জানা যায়, ইমাম উদ্দিন মিয়ারা ছিল তিন ভাই। তিন ভাই নৌকা করে ভাদ্র মাসের এক অমাবস্যা রাতে সোনারগাঁয়ে তাদের পীরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। নৌকার মাঝি ছিলেন সোলেমান শাহ। পথিমধ্যে বৃষ্টি হয়, তিন ভাই আরাম করে নৌকার ভেতর। সোলেমান শাহ ভিজে ভিজে নৌকা চালায় এবং গন্তব্যে হাজির হয়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়ে পীর আসে এবং এ দৃশ্য দেখে তার রাগ হয়। পীর তখন তিন ভাইকে উলঙ্গ হয়ে আসতে বলে। তিন ভাই চিন্তায় পড়ে যায়। আপন মায়ের পেটের তিন ভাই কীভাবে উলঙ্গ হয়ে একে অপরের সামনে আসবে। পীর সাহেব মাঝি সোলেমানকে উদ্দেশ্য করে কাছে আসতে বলে। সোলেমান কাছে যায়। পীর তাকে হা করতে বলেন এবং মুখে ফুঁক দেয়। সেখান থেকেই সোলেমান লেংটা হয়ে বাড়ি ফিরে।
সোলেমান লেংটার অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তার মধ্যে সোলেমান লেংটা কালিপুর রমিজ উদ্দিন প্রধানীয়ার বাড়িতে যান। সেখানে দেখেন নারীরা নদী থেকে ঘট পুড়িয়ে ঘর, উঠান লেপছে। তিনি তাদের পানি আনার কষ্ট দেখে তাদের চোখ বন্ধ করতে বলেন। তারা চোখ বন্ধ করলে লেংটা তার নফস টেনে প্রায় ২/৩ হাত লম্বা করে পুরো উঠান পানিতে ভিজিয়ে দেয়। এ ঘটনা তিনি বিভিন্ন গ্রামে করেছেন। এক সময় মানুষ হজ্বে যেত জাহাজে কিংবা পায়ে হেঁটে। অনেক দিন লাগতো, হজ্বে যাওয়ার সময় অনেকেই লেংটাকে বদরপুর দেখে গেছে, কিন্তু হজ্ব পালন করার সময় অনেকেই তাকে কাবা শরীফে দেখেছেন নামাজ আদায় করতে। এমন অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত।
সোলেমান লেংটার বোনের বাড়ি বদরপুরে মাজারটি অবস্থিত। ১৩২৫ বাংলা সনের ১৭ চৈত্র শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটা তার বোনের বাড়ি বদরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করলে সেখানে কবর দিয়ে মাজার স্থাপন করা হয়। প্রতি বছর চৈত্র মাসের ১৭ তারিখে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী ওরস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং মেলা বসে। ওরস শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে ও পর পর্যন্ত মেলা স্থায়ী হয়। এছাড়া প্রতিবছর ভাদ্র মাসে ও প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মাজারে ভক্তদের আগমন ঘটে। মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক ভক্ত, আশেকান ও সাধারণ জনগণ আসা যাওয়া করেন। ওরসকে কেন্দ্র করে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে মেলায় বসে রকমারি দোকান ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ভক্তদের আস্তানা। মেলায় চলে বিভিন্ন প্রকার পণ্য ক্রয়-বিক্রয়। মাজারে মানত মানতে দেয়া হয় গরু, ছাগল, নগদ অর্থ, আগরবাতি ও মোমবাতি।(লেখাটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
(লেংটার মেলায় আগত বিভিন্ন পাগলদের ছবি নিচে ক্লিক করুন -- - -)
ঘুরে এলাম লেংটার মেলা (পাগলদের ছবি পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৯