শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
আমার রান্না করার অভ্যাস নেই। তারপরেও মাঝে মাঝে বাঁচার তাগিদে রান্না করে খেতে হয়। সেদিন হঠাৎ দুলাভাই এসে হাজির। ঢাকায় তার অফিসিয়াল কিছু কাজ আছে। বাসায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। গিন্নি বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। রান্নার ভয়ে হোটেলে খেয়ে দিন কাটাই। কিন্তু দুলাভাইকে হোটেলে নিলে সমস্যা। খাওয়ার পরে হয়তো খাওয়ার টাকা আমাকে আর দিতে দিবে না। তিনিই দিয়ে দিবেন। তখন উল্টো আমার বদনাম হবে। কেউ শুনলে বলবে, শ্যালকের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে উল্টো শ্যালককে খাইয়ে এসেছে। বিষয়টি শুনতে ভাল লাগবে না। কাজেই রান্না যেমনই হোক, দুলাভাইকে দু’মুঠো ডাল ভাত রান্না করেই খাওয়ানো দরকার।
কি রান্না করবো ভেবে পাচ্ছি না। মাছ রান্না করা ঝামেলা। কাজেই মাংস রান্না করাই সহজ হবে। বাজারে গিয়ে দেখি ফার্মের মুরগীর সংখ্যাটাই বেশি। দুলাভাই আবার ফার্মের মুরগী খান না। তার জন্যে দেশী মুরগীর দরকার। আস্ত দেশী মুরগী নিলে আবার কাটাকাটি করা একটা ঝামেলা। অবশেষে ডিপার্ট মেন্টাল স্টোরে গিয়ে চামড়া ছাড়ানো আধকেজি সাইজের একটা সোনালিকা মুরগী নিযে নিলাম। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্মচারীকে অনুরোধ করায় ওরাই মুরগীটা কেটেকুটে ছোট ছোট টুকরো করে দিল। তাতে আমার আর কাটাকাটির ঝামেলা থাকল না। দাম দেয়ার সময় সাথে একটা গুঁড়ো মসলাও দিয়ে দিল। গুড়ো মসলা ধরিয়ে দেয়ায় মসলা বাটাবাটির ঝামেলা থেকে রেহাই পেলাম।
বাসায় এসে মাংস ভাল করে ধুয়ে নুন, তেল, পিয়াজ, মরিচ, গুড়ো মসলা মাখিয়ে ১৫মিনিট রেখে দিলাম। কারণ এই নিয়মটি মসলার প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে। রান্না করার নিয়ম কানুন সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞান নেই। কাজেই প্যাকেটের গায়ে লেখা পড়েই আমাকে রান্না করতে হচ্ছে। ১৫মিনিট পরে চুলা জ্বালিয়ে মাংসসহ কড়াই চুলার উপর দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিলাম। কিছুক্ষণ পর ঢাকনা খুলে দেখি মাংস পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। তাড়াতাড়ি একটু পানি দিয়ে নেড়েচেড়ে দিতে দিতে পুড়ে যাওয়া মাংস অনেকটা ঠিক হয়ে এলো। উনুনের জ্বাল কমিয়ে মাংসগুলো আরেকটু নেড়েচেড়ে দিয়ে নাকটা কড়াইয়ের উপর নিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে দেখি সুন্দর মসলাদার ঘ্রাণ বের হচ্ছে। জ্বাল দেওয়া অবস্থায় মাংসের ঘ্রাণ নিয়ে মনে হলো রান্নাটা ভালই হবে।
প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে ভাল করে কষিয়ে নিয়ে পরিমাণ মত পানি দিতে হবে। মাংস কষাতে গিয়ে দেখি, যে টুকু ঝোল দেয়া ছিল তা শুকিয়ে পোড়া পোড়া ভাব ধরেছে। পানির জগ হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঝোল দিতে যাবো এমন সময় আমার অফিস কলিগ জব্বার মোবাইলে ফোন করে বসলো। একহাতে পানি ঢালছি অন্য হাতে মোবাইল ধরতে যাবো অমনি মোবাইল পিছলে চুলার মধ্যে পড়ে যাওয়ার অবস্থা, থাপা দিয়ে মোবাইল ধরতেই হাতের জগের পানি ঝপাৎ করে মাংসের হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গেল। আধাকেজি মাংসে এক হাঁড়ি পানি। মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। মনে মনে জব্বারকেও খানিক বকাবকি করলাম, হারাম জাদা জব্বার মোবাইল করার আর সময় পেলো না, আরেকটু পরে টেলিফোন করলে কি হতো, মাংসের এতো পানি এখন কি করবো? মাংসের এক হাঁড়ি পানি নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পরে গেলাম। পনিগুলো কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। পানি ফেলে দেওয়াও তো সম্ভব নয়, কারণ পানির সাথে সব মসলা চলে যাবে। তখন স্বাদবাদ কিছুই থাকবে না।
এদিকে অফিসের সময় হয়ে এসেছে। পানি কমানোর জন্য চুলা জ্বালিয়ে দুই তিন ঘন্টা বসে থাকাও সম্ভব নয়। ঝোল কমানো সহজ কোন বুদ্ধিও খুজে পাচ্ছি না। অগত্যা মাথায় একটা নুতন বুদ্ধি এলো। হাতের কাছে এক পোয়া আধা ফাটা মাস কালাইয়ের ডাল ছিল। ডাল গুলো ভাল করে ধুয়ে মুরগীর মধ্যে দিলাম ঢেলে। চুলা বাড়িয়ে দিয়ে ঘন ঘন নাড়তে লাগলাম। কিছুুক্ষণ পর দেখি ঝোল ঘন হয়ে এসেছে। আরো কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে ঝোল চেখে দেখি খুব স্বাদ হয়েছে। আরো কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে চুলা থেকে কড়াই নামিয়েছি এমন সময় দুলাভাই এসে হাজির। দুইজন খেতে বসবো, ওই সময় হারামজাদা জব্বারও এসে হাজির। ওকেও খেতে বসালাম। তবে জব্বারের পাতে ঝোল না দিয়ে শুধু মাংস তুলে দিলাম। কারণ লজ্জার ব্যাপার, ডাল দিয়ে মুরগী রান্না করেছি, এটা যদি সে অফিসে ছড়িয়ে দেয় তাহলে মুখ দেখানো যাবে না। জব্বার ঝোল ছাড়া মাংস দিয়ে শুকনা ভাত খেতে পারছিল না। ঝোলের জন্য বার বার তাগাদা দিচ্ছিল। কিন্তু আমি ওর ঝোলের কথা শুনেও না শোনার ভান করে চুপচাপ খাওয়ায় ব্যস্ত হলাম। আমি জব্বারের প্লেটে ঝোল তুলে না দেয়ায় সে নিজের হাতেই চামুচ দিয়ে ঝোল পাতে নিয়ে খেতে লাগল। জব্বার ঝোল খায় আর বলে, ঝোল তো ভালই লাগছে কিন্তু ঝোলের মধ্যে এগুলো কি? যেটার ভয়ে তাকে ডাল দিলাম না সেটাই সে বারবার হাতে নিয়ে টিপতে লাগল। আমি ঘটনাটি বলতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু জব্বার ঝোলের ভিতর ডালগুলো হাতে নিয়ে বার বার টেপাটেপি করায় ঘটনা বলতে বাধ্য হলাম। ঘটনা শুনে দুলাভাই আর জব্বার হাসতে হাসতে মরে। তবে তারা হাসির মাঝেই ঝোলের প্রশংসা শুরু করে দিল। দু’জনেই মাংস রেখে ঝোল দিয়েই পেট পুরে ভাত খেলো।
বাসায় গিয়ে জব্বার এ কথা পেটে রাখতে পারেনি। বউয়ের কাছে ডাল দিয়ে মুরগীর মাংস রান্না করার কাহিনী বলে দুইজনেই খানিক হাসাহাসি করেছে। হাসাহাসির একপর্যায়ে জব্বারের বউ বলেছে, ডাল দিয়ে মুরগী রান্না তো জীবনে শুনিনি। জব্বার তখন বউকে বলেছে, তুমি এমন রান্নার কথা জীবনে শোন আর না শোন, ওই রান্নার ঝোল কিন্তু আমার কাছে খুব মজাই লেগেছে, কাজেই ডাল দিয়ে মুরগীর ঝোল রান্না আগামী কালকের মধ্যেই চাই । জব্বারের চাপাচাপিতে বউ অবশেষে ডাল দিয়ে মুরগীর ঝোল রান্না করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আমার রান্নার মত নাকি এমন স্বাদ হয় নাই।
পরদিন জব্বার অফিসে এসে ঘটনাটি পুরো অফিস ছড়িয়ে দিল। তাতে আমার রান্নার যতনা বদনাম হয়েছিল তার চেয়ে ঝোলের প্রশংসাই বেশি হয়েছিল। দুর্ঘটনা বশতঃ ডাল দিয়ে মুরগীর ঝোল রান্নার ঘটনাটি এখনও জব্বার ভুলে যায়নি। মনে হলেই আমার রান্নার প্রশংসা করে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:১৯