নৌকায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ (প্রথম পর্ব)
নৌকায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ (দ্বিতীয় পর্ব)
(দুই শত এক তম পোষ্ট)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই পশ্চিমের সৈকতে গেলাম। যাওয়ার পথে পাকা রাস্তার পাশেই মসজিদ মাদ্রাসা চোখে পড়ল। ছোট ছোট বাচ্চারা আরবী শিক্ষা করছে। একজন হুজুর মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড়বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকিায়ে আছে। তার চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। তার কারণও আছে। মুকুল বিদেশী ট্যুরিস্টদের মত শর্ট প্যান্ট পড়েছে। সেই সময়ে বাংলাদেশে বড়দের মধ্যে শর্ট প্যান্ট পরার প্রচলন খুব একটা ছিল না। পঁচিশ ত্রিশ বছর বয়সের যুবক হাফ প্যান্ট পরে মুসলিম পর্দা পুশিদা সম্পন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপের গ্রামের ভিতর দিয়ে গটগট করে হেঁটে যাওয়াটা অনেকে মেনে নিলেও হুজুর যেন মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে চোখে অগ্নি বর্ষিত হলেও মুখে কিছু বললেন না। এমন বেশরীয়তি কারবার দেখে রাগে দুখে গজগজ করতে করতে মসজিদের ভিতরে ঢুকে গেলেন।
আমি বিষয়টি লক্ষ্য করে মুকুলকে বললাম, আপনি তাড়াতাড়ি হাফপ্যান্টের উপরে লুঙ্গি পরেন, নইলে কিন্তু হুজুরদের হাতে মাইর খেতে হবে। এই দ্বীপের মানুষ কিন্তু খুবই ইসলাম ভক্ত। দেখলেন না, রাতেও মহিলারা বোরখা পরে ছাতা মাথায় দেয়।
মুকুল আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, ঐ হুজুর এখন তো কিছুই দেখে নাই। যদি কোনোদিন এই সেন্টমার্টিন দ্বীপে লঞ্চ স্টীমার চালু হয়, তখন হাফপ্যান্ট তো দূরের কথা, আধা ন্যাংটা মহিলার জ্বালায় হুজুরদের দ্বীপ ছেড়ে পালাতে হবে।
মুকুলের সেই কথা সেইদিন তুচ্ছ মনে হলেও এই ভ্রমণ কাহিনী যখন লিখছি তখন হয়তো সেই পরিবেশ কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে। কারণ এখন স্টীমার সার্ভীস চালু হয়েছে। পর্যটক মৌসুমে দেশি বিদেশী প্রচুর লোকের আগমন ঘটে। তাদের মধ্যে এরকম মানুষ থাকতেও পারে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভবিষ্যত নিয়ে দুইজনে গল্প করতে করতে পশ্চিম সৈকতে চলে গেলাম। সমুদ্র সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু দক্ষিণে চলে গেলাম। সমুদ্রের পাড়ে একটি সাইন বোর্ড চোখে পড়ল। সমুদ্রের কচ্ছপ সংরক্ষণের সাইনবোর্ড। সাইন বোর্ডের পূর্ব পার্শ্বে একটি ঘর। ঘরের কাছে যেতেই ঘরের ভিতর থেকে ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবক বেরিয়ে এলো। কথা হলো তার সাথে। ভদ্রলোক কচ্ছপ সংরক্ষণ এনজিওতে চাকরী করেন। বাড়ি কুমিল্লায়। ঘরের সামনে একটি বালতিতে কতগুলো কচ্ছপের বাচ্চা রাখা আছে। কচ্ছপের বাচ্চাগুলো পানির উপর ভেসে আছে। দেখতে খুব ভাল লাগল। মুকুল কচ্ছপের বাচ্চাগুলো হাতদিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। ভদ্রলোকের সাথে অনেক কথা হলো। একপর্যায়ে ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সোজা দক্ষিণে চলে গেলাম। দক্ষিণে গিয়ে সমুদ্রের সৈকত ছেড়ে উপরে উঠে এলাম। দক্ষিণের সৈকতের পূর্ব পার্শে¦ই একটি খরের ঘর। ঘরের সামনে সবজি বাগানের মত মনে হলো। একজন পুরুষ ও একজন মহিলা কুয়া থেকে পানি তুলে কলসি ভরে গাছে গাছে ঢেলে দিচ্ছে। আমরা ক্ষেতের কাছে যেতেই বউটি মুখ আঁচলে ঢেকে দৌড়ে ঘরে গিয়ে ঢুকল। পুরো সেন্টমার্টিন দ্বীপ জুড়েই নারীর পর্দার উপর খুব কড়াকড়ি। সব বাড়িতেই এই নিয়ম মানা হয়। যারা এখানে হিন্দু আছেন তাদের বাড়িতেও মনে হয় একই অবস্থা। ইসলামী নিয়মে পর্দা প্রথা পালন করায় মহিলার মুখমন্ডল দেখা সম্ভব হলো না, তবে অনুমানে মহিলাকে মধ্যবয়স্ক মনে হলো। আমরা হঠাৎ করে উপস্থিত হওয়ায় তাদের কাজের বিঘœ হলো। মহিলা ঘরে চলে যাওয়ায় মধ্য বয়স্ক লোকটি পানি যোগানের অভাবে দাঁড়িয়ে রইল। মুখে বিরক্তির ভাব। নিষেধও করতে পারছে না আবার কাজের সময় আমাদের গ্রহণও করতে পারছে না।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, চাচা, এগুলো কিসের গাছ?
লোকটি বলল, তরমুজ।
কিন্তু ক্ষেতের কোথাও কোন তরমুজ দেখতে পেলাম না। শুধু বালুর উপর লম্বা লতানো গাছ দেখা যায়।
বললাম, তরমুজ ধরেছে?
বলল, ধরেছে।
বললাম, কই আমরা তো দেখতে পাচ্ছি না।
লোকটি বলল, শিয়ালে খায়, মানুষে চুরি করে এইজন্য বালুর নিচে পুঁতে রাখা আছে।
বললাম, পাকে নাই?
বলল, দুই একটা পেকেছে।
বললাম, কত করে বিক্রি করেন?
বলল, আট টাকা, দশ টাকা বিভিন্ন দামে বেচি।
বললাম, পাকা তরমুজ থাকলে আমাদের একটা দেন।
লোকটি বালু খুঁড়ে খুঁড়ে কয়েকটি তরমুজ পরীক্ষা করে তার ভিতর থেকে একটি তরমুজ এনে মুকুলের হাতে দিল। মুকল বলল, আমরা এটা এখানেই খাব, আপনি একটা চাকু এনে কেটে দেন।
আমরা তরমুজ এখানেই কেটে খাবো বলায় ঘর থেকে ছুরি এনে নিজ হাতে কেটে দিল। খেয়ে মজা পেলাম। তরমুজ ছোট হলেও মিস্টি আছে। খেতেও সুস্বাদু। তৃপ্তিসহকারে পুরো তরমুজ দুইজনে খেলাম। তরমুজ খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা, কত দিব?
লোকটি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, দেন, আপনারা বিদেশি মানুষ আপনাদের আর কি বলবো।
তার কাচুমাচু ভাব দেখে আমি দশটাকার একটি নোট তার হাতে দিলাম। উনি দুই টাকা ফেরত দেয়ার জন্য ঘরে যেতে চাইলে নিষেধ করলাম। দশ টাকা পেয়ে লোকটি খুব খুশি হলো। একটু আগে যে আমাদের প্রতি কাজের ক্ষতি হওয়ায় বিরক্তির ভাব ছিল সেটা আর নেই। খুশি হয়ে আমাদের সাথে অনেক গল্প করলেন।
তার কাছ থেকেই জানলাম, সেন্টমার্টিন দ্বীপে পাঁচ হাজার লোক বাস করে, তার মধ্যে একজন বিয়ে পাশ এবং ছয়জন এসএসপি পাস। সবাই প্রায় মুসলমান মাত্র দুই ঘর হিন্দু আছে, তারাও মাছ ধরে।
এখনে এসে যার সাথেই কথা বলেছি তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই চটপট উত্তর দিয়ে দেয়, ফিসিং করি।
বাংলায় মাছ মারা বা মাছ ধরা বা জেলে এই কথা কেউ বলে না। তাদের পেশা ফিসিং এই কথাটি কে শিখিয়েছে জানি না, তবে তাদের ইংরেজি ফিসিং কথাটাই বেশি প্রচলিত।
তরমুজের ক্ষেত থেকে বের হয়ে দ্বীপের মাঝখান দিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রের কাছে এলাম। ৯১-এর ঘুর্ণি ঝড়ে উত্তর পাড়ার কিছু অংশ ভেঙে সমুদ্রের ভিতর গেলে কিছু লোক গৃহহারা হয়ে পড়ে। তাদের জন্য সরকারী খরচে দ্বীপের মাঝখানে এই আশ্রয় কেন্দ্রটি সরকার করে দিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রের পাশেই এক ছেলে পিয়াজ ক্ষেতে পানি দিচ্ছে। পিয়াজ জানা সত্বেও ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কি?
সে ঐখানকার ভাষায় কি যে জবাব দিল কিছুই বুঝতে পেলাম না। হা করে ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে এলাম। গ্রামের ভিতর দিয়ে পূর্ব পাশের সৈকতে চলে গেলাম। পূর্ব পাশের সৈকত ধরে একটু উত্তরে গিয়ে রাতের সেই খাবারের দোকানে হাজির হলাম। সকাল বেলা পিঠা ভাজতেছে। প্রতি পিস তিন টাকা। আমি আর মুকুল একেক জন চারটা করে পিঠা খেয়ে পূর্ব সৈকত ধরে আবার দক্ষিণে যেতে লাগলাম। দক্ষিণে দ্বীপের শেষ প্রান্তে গিয়ে দুইজনে আবার উত্তর মুখী হলাম। ফেরার সময় সৈকত ছেড়ে পূর্ব পাড়ার বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। প্রত্যেক বাড়ির চার পাশে অনেক নারকেল গাছ। দুর থেকে শুধু এই নারকেল গাছগুলোই চোখে পড়ে বাড়িগুলো চোখে পড়ে না। কারণ বাড়িগুলো নারকেল গাছের ঝোপের ভিতর। ঘুর্ণিঝড় জলোচ্ছাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যেক বাড়িতেই প্রচুর নারকেল গাছ লাগানো আছে। অন্য গাছ খুব একটা চোখে পড়ল না। পুরো দ্বীপে কেওড়া গাছের আধিক্যই বেশি। তবে কয়েকটি আম গাছও দেখেছি। গাছগুলি উত্তর পাড়ায়।
পশু প্রাণীর মধ্যে গরু, ছাগল, মুরগীর পরে বেওয়ারিশ হিসাবে কুকুরের পরিমাণ বেশি। উত্তর পাড়ায় বেশ কিছু কুকুর চোখে পড়েছে। শিয়ালও আছে। রাতে শিয়ালের ডাক শুনেছি। টেকনাফ থেকে ৩৪ কিলোমিটার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কিভাবে যে শিয়াল এসে এখানে বাসা বেঁধেছে এটা ভাবলে মাথায় ধরে না। কুকুর পালন করার জন্য শখের বশে কেউ নৌকায় করে দ্বীপে আনতে পারে, পালিত কুকুর থেকে প্রজননের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু শিয়াল তো কেউ শখ করে পালন করার জন্য নিযে আসবে না। তবে এরা এলো কিভাবে? পুরো দ্বীপে দু’একটি নয় অনেক শিয়ালের বাস। কিছু চুড়–ই, শালিক এবং কাক জাতীয় পাখিও চোখে পড়েছে। তবে সমুদ্রে নৌকা চলার সময় প্রচুর সামদ্রিক চিল চোখে পড়েছে।
পুরো সেন্ট মার্টিন ঘোরার পর আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না। চলে আসার প্রস্তাব দিতেই মুকুল রাজি হয়ে গেল। ব্যাগ নিয়ে চেয়ারম্যানের ছেলের কাছে চাবি এবং রুম বুঝিয়ে দিয়ে ঘাটে ্চলে এলাম। ট্রলারে উঠার আগে ইচ্ছা হলো সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কিছু জিনিস কিনে নেব। মুদির দোকানে শুকনো পাতাসহ ছোট ছোট পিয়াজ বেনি গেঁথে ঝুলিয়ে রেখেছে। দোকানদারের কাছে পিয়াজ চাইতেই মুকুল বাধা দিয়ে বসল। সে তাচ্ছিল্য ভাবে বলল, এইটা একটা নেয়ার জিনিস হলো। সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে পিয়াজ এনেছে, এটা শুনলে মানুষে কি বলবে?
মানুষ যাই বলুক, সেন্টমার্টিন দ্বীপের পিয়াজ যে সাধারণ পিয়াজ নয়, এর চেহারা ভিন্ন এবং দেখতে সুন্দর। এরকম চেহারার পিয়াজ বাংলাদেশের আর কোথাও চোখে পড়ে না। দোকানদার বলল, এখানকার পিয়াজ আকারে ছোট হলেও ঝাঁজ বেশি এবং খেতে সুস্বাদু। এত কিছু বলার পরেও মুকুল কিছুতেই পিয়াজ নিতে দিল না। পরে বাধ্য হয়ে কিছু বার্মিজ আচার কিনে নিয়ে এলাম।
ঘাটে এসেই বড় একটি ট্রলার পেয়ে গেলাম। দেরি না করে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। এবার আর মাঝখানে নয় পিছনে গিয়ে মাঝির কাছে বসলাম। জোয়ার আসার অনেক আগেই ট্রলার ছেড়ে দিল। এবার সমুদ্রের ঢেউয়ের তান্ডব লীলায় নাস্তানাবুদ হতে হলো না। খুব আরামেই ট্রলারে টেকনাফ চলে এলাম। আসার সময় অনেক সীগাল আমাদের সাথে সাথে উড়তে ছিল। মাঝে মাঝে ট্রলারের পিছনে টুপ করে নেমে মাছ ধরে আবার উপরে উঠে আমাদের মাথার উপরে উপরে উড়তে ছিল। মুকুলকে সীগালের এই দৃশ্যের ছবি উঠাতে বললে ও কয়েকটি ছবি তুলে নিল।
আসার সময় ট্রলারে ষোল সতেরো বছর বয়সি এক ছেলের সাথে আলাপ হলো। সে জানালো স্কুলে ছয়জন মাস্টার আছে একজনের বাড়ি উত্তর বঙ্গে।
বললাম, উত্তর বঙ্গ কোথায় বাড়ি?
বলল, গাইবান্ধায়।
তার কথা শুনে থ মেরে গেলাম। সে এখানে বেড়াতে এসেছিল। সেন্ট মর্টিন দ্বীপ তার ভাল লাগে এবং দ্বীপে থেকে যায়। তখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের স্কুলে মাস্টারের সংকট ছিল। এক পর্যায়ে মাস্টারীতে ঢুকে যায়। এর পরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপেই বিয়ে করে। সেই অবধি এখনও দ্বীপেই আছে। নাম সামছু মাস্টার। ছেলেটির কাছে মাস্টারের বর্ননা শুনে আফসোস হলো। এই কথাটা যদি আগে জানতাম তাহলে সামছু মাস্টারের সাথে পরিচয় হয়ে আসতাম। কারণ আমার বাড়িও গাইবান্ধায়।
এই ভ্রমণ কাহিনী ২০১৫ সালে যখন লিখছি তখন পর্যন্ত আর সেন্টমর্টিন যাওয়া হয়নি এবং সেই মাস্টারের সাথে আর পরিচয়ও হয়নি। ভ্রমণের প্রায় দেড় যুগ হয়ে এলো। জানিনা ভবিষ্যতে সেন্টমর্টিন যাওয়ার ভাগ্য আবার হবে কিনা।
(বিঃদ্রঃ সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনেক ছবি ছিল ছবিগুলো আমার ছোট ছেলে নষ্ট করায় দেয়া সম্ভব হলো না।)
(সমাপ্ত--)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪২