ইমরান আহমদ ইমু
দীপুর সাথে পরিচয়টা হয় বটতলার একটি আড্ডায়, ক্লাসের সাতবন্ধুর এই আড্ডা মিলত কখনো বটতলায় কখনো টিএসসিতে কখনো বা ভিসি চত্ত্বরে, উদ্দেশ্য নিজেদের ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি, নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া। এটা আরো জমে উঠে যখন আমাদের মধ্যে একটি নতুন যুগলের প্রকাশ ঘটে।
তারও একটি প্রসঙ্গ আছে, এমন একটি খবরে ভ্রু কুঁচকে সত্যতা যাচাই করেনি এরকম কোন ছেলেমেয়ে ক্লাসে বাকি ছিলনা। বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার পরিণাম অনেকে বলে থাকেন, কিন্তু চাঁদ যদি স্বয়ং বামনের জন্য ভূপাতিত হয় এর ফয়সালা কে করবে? একসময় এটা দেখিয়ে দিয়েছে সিমু নিজেই। অনেক সুক্ষ্মভাবেই দেখিয়েছে। সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝে নিয়েছে দীপু। আর আমরা? আমরা ছিলাম নীরব দর্শক।
সিমুর টিজ সংক্রান্ত কেসে বিচারক হয়েছি অনেকবার। দু’চারটে মজলিশ ভাঙতে হয়নি এমন সপ্তাহের কথা মনে পড়ে না, ক্লাসের কোন ছেলেটা ওর পাশে বসার জন্য কি বুদ্ধি খাটাল, কোন বড় ভাই নোট দেয়ার অজুহাতে কতবার অফার করল, সিমু আমাকে প্রায়ই শোনাত। একবার তো ইতিহাস স্যারকে নিয়ে তুলকালাম ঘটে গেল। স্যার নাকি ওকে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার জন্য বাসায় যেতে বলেছিল, এটাকে টেনে হিচড়ে যে পর্যন্ত গড়িয়েছিলাম তাতে স্যার আমাদের ক্লাস নেয়া সেখানেই ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এত আকাক্সিক্ষত মুখ যদি কাউকে স্বেচ্ছায় কাছে ডাকে, যে হাতে হাত রাখার জন্য বহু ছেলে-ছোকরা বহুক্ষণ কাটিয়েছে সে হাত যদি ভালবাসার দাবিতে কারো দিকে এগিয়ে দেয় তাকে চাঁদ কপাল ছাড়া আর কি বলা চলে। সে দিন দীপুর এ সৌভাগ্যের কথা ক্ষণিকের মধ্যে ক্লাসময় হয়ে পড়ল। দু’একদিনের মধ্যে ছেলেদের মঝে ওর অবস্থার বিশেষ উন্নতি ঘটে গেল। দীপুর এক বন্ধু ক্লাসের কোণে ডেকে নিয়ে মহামূল্যবান কিছু লুকানোর ভঙ্গিতে ফুসফুসিয়ে বলল, একজন পুরুষতো জীবনে কতকিছুই অর্জন করে, কিন্তু কতজনে তোর মত ভাগ্যবান হয়।
সে দিন দীপুর মনেও আনন্দের শেষ ছিলনা। প্রতিটি ক্ষণেই ওর মুখে উচ্ছাসের মুক্তাকণাগুলো ঝরে পড়ছিল। চৈতালির খরা রোদে জমির ফাটলগুলো বৃষ্টির পরশে যেমন সরস হয়ে উঠে, বহুদিনের রিক্ততাকে কাটিয়ে যেমন সবুজ শ্যামল শষ্যে ভরে তুলে, তার পূর্ণ চিত্রগুলো দীপুর চোখে মুখে নব নব স্বপ্নের মাসে চিত্রায়িত হত। সেই আবেশের স্রোতে সাজানো স্বপ্নে বিভোর হয়ে একাকীত্বকে বিন্দুমাত্র মুহুর্তের জন্যও মেনে নিতে পারেনি। ফলে থার্ড ইয়ার শেষ হওয়া মাত্র কোন রকমে ছোটখাট একটা কাজ জুটিয়ে সীমুকে ঘরে তুলে নিতে কাল ক্ষেপন করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর আমাদের মিলন হত নিয়মিত আড্ডায়। সেখানে আমাদের সাংসারিক নানা বিষয় নিয়ে যত ধরনের আলোচনা হত তাতে ওদের সংসারটা যে সবার অপেক্ষা ভালভাবেই চলত তা সকলেই এক বাক্যে মেনে নিত। এতে যে কারো হিংসে হতনা তা কিন্তু নয়। কোন এক আড্ডায় একজনতো বলেই ফেলেছিল এখানে সাংসারিক বিষয়টা না আসলে চলে না? বন্ধুর জন্য বন্ধুর এ ঈর্ষাটাই একদিন কাল হয় দাড়িয়েছিল কিনা জানিনা কিন্তু ওদের যে এটাই শেষ আড্ডা তা আমি নিশ্চিত হয়েছি তখনই যখন ওদের সম্পর্কে ফাটলের খবরটা আমার কানে পৌঁছে।
সংসারে ভাঙ্গন ধরার পর থেকে দুটি মুখ আর আড্ডায় পেলাম না। ওদের বিয়োগ আমাদের কেমন যেন নিরস করে দিল। এই শূন্যতার রেশ কাটাতে এতটাই বেগ পেতে হয়েছিল যে, একে একে সবার মুখগুলো আড্ডা থেকে বিস্তৃত হয়ে যায়।
বছর পাঁচেক পর দীপুর অসুস্থতার খবর পেয়ে ওর গ্রামের বাড়িতে যাই। আগের দীপুর সাথে তেমন মিল নেই। শুকিয়ে অনেকটা কালো হয়ে গেছে। শরীরের হাড়গুলোর হিসাব মেলাতে বোধহয় কোন গরমিল হবে না। পরিবার থেকে যতটুকু জানতে পারি বছর দুই থেকে ও অসুস্থ চাকুরি ছেড়ে বাড়িতেই থাকে। রক্তে কি যেন এক জীবাণু মিলেছে। ডাক্তার জানিয়েছে ওর শরীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়েছে।
তবুও উন্নত সেবার কথা ভেবে দেশের বাইরে নেয়ার কথা জানাই। একটা কৃত্রিম হাসি এঁকে দীপু বলল, “তাঁর আর প্রয়োজন হবেনা, আমি এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায়”। আমি সাহস জুগিয়ে বলি ‘তুই এত ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? একটু কাছে বসে আমার হাত দু’খানা চেপে ধরে বলল, না রে, এটাই সত্য, সীমুর প্রতি আমার চাহিদা বোধহয় অনেক বেশি ছিল। একেবারে পাইনি তা বলব না। যতটুকু দিয়েছে তা ভালবাসা বলা চলে না ভালবাসার আবরণে বিষাক্ত থাবা। ওর সৌন্দর্যের প্রতি নোংরা দৃষ্টিগুলো সহ্য করেছি, বন্ধুরুপী সুবিধাবাদীদের অজানা ইতিহাসকেও চোখ বুজে মেনে নিয়েছি।
শুধু নিতে পারিনি ওর বন্ধুদের দেয়া অভিশাপ্ত জীবাণুগুলোকে, যা আমার রক্তে মেশা মাত্রই দুনিয়াতে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে কেড়ে নিয়েছে। আমার বুঝতে বাকি রয়নি যে, দীপুর জীবন এখন মরণ ব্যাধিতে ঝুলন্ত।
আমার ঢাকায় আসতে ঘন্টা তিনেক সময় কাটে। দীপুর এতটুকু সময়ও সহ্য হয়নি। পৃথিবীর একটি নিঃশ্বাসও নিরাপদ মনে করেনি। ইচ্ছে করলে হয়ত আরো কিছুদিন সময় পেত। কিন্তু না, বিদ্যুতকেই মৃত্যুর সঙ্গী করে নিল। যাতে দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে। এর মাসখানেক পর একদিন হাইকোর্ট মাজার গেট দিয়ে হাঁটছি। পিছু থেকে কাঁপো কাঁপো স্বরে ডাক এল স্যার, আমি সিমু, দীপু কেমন আছে? গতি থামিয়ে একটু পিছনে তাকাই। নোংরা মাদুরের উপর পড়ে আছে জীর্ণ দেহটা। পাঁচ ফুট লম্বা একটা মানুষ, মাথার চুলগুলো নেই। মনে পড়ে গেল দীপুর পরিণতির কথা। কোন জবাব দিতে না পেরে সামনে হেঁটে চললাম।