র্যামন পাবলিশার্স এর সেলসপার্সন হিসেবে কাজ করেছিলাম এক বইমেলায়। একুশের বইমেলা ছিলো ওটা। একদিন বিকেলে আমি একাই ছিলাম স্টলে। হঠাৎ দেখি রাগী চেহারার এক ভদ্রলোক হন হন করে স্টলের দিকে আসছেন। স্টলের সামনে এসে কি একটা বইয়ের পুণঃমুদ্রণ বিষয়ে খুব বকাঝকা করলেন র্যামনের মালিকপক্ষকে। পরে জেনেছিলাম, উনি মেজর অব. কামরুল হাসান ভূইঁয়া। ২ নম্বর সেক্টরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এর আগে আমি উনার নাম শুনিনি।
ভদ্রলোক চলে গেলে যে বইটা নিয়ে উনি কথা বলছিলেন, আমি তার একটা কপি তুলে নিলাম। জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা নামের এই বইটা আমার পড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলাদা। একেবারে অন্যরকম। এই বইটাতে উনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কিভাবে একদম সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অংশগ্রহণ করেছে তার কিছু সাবলীল বর্ণনা দিয়েছেন।
আমি রীতিমত মুগ্ধ এই বই পড়ে। পরবর্তীতে অসংখ্য যায়গায় আমি এই বইয়ের উদাহরণ দিয়েছি। আজকের দিনে মতলববাজ একটা শ্রেনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে শুধুমাত্র নিজেদের অর্জন বলে কুক্ষিগত করতে চাইছে। কিন্তু মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথাগত যুদ্ধে এমন অনেক সৈনিক ছিলেন, যারা শুধুমাত্র দেশের ডাকে, মাতৃভূমির টানে যুদ্ধে এসেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে ন্যূনতম প্রতিদানের আশা ছাড়াই নিজ নিজ পেশায় ফিরে গিয়েছিলেন। এমন সব পেশা থেকে এসে তাঁরা এসেছিলেন, যে পেশাগুলোকে সভ্য সমাজে বর্বর হিসেবে গণ্য করা হয়, অচ্ছুৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ তখন নিয়মিত সৈনিক, মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তের পাশাপাশি তাঁরাও দেশের জন্য প্রাণ দিতে পিছপা হননি।
তাই উনার বর্ণনায় আখাউড়া স্টেশনের একজন পকেটমার পেশাজীবির মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার গল্প এসেছে, যে এখনও ওই একই স্টেশনে পকেটমার পেশাতেই আছে। কুড়িগ্রামের একজন অতি সাধারণ বৃদ্ধ মা’র কথা আছে, যিনি শত্রুপক্ষের ট্যাংকের আওয়াজকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গরম ভাত নিয়ে এসেছিলেন। আছে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর পাশের সেই লুঙ্গি কাঁছা মারা যুবকের কথা, যে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তার দ্বিগুণ আকৃতির এক পাঠানের সাথে মল্লযুদ্ধে চলে গিয়েছিল শুধুমাত্র বাঙালির শৌর্যবীর্যকে কটাক্ষ করার বদলা নিতে!
এ রকম আরো আরো ঘটনা কামরুল হাসান সাহেব খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। হৃদয়ছোঁয়া। আমি পরবর্তীতে উনার বিজয়ী হয়ে ফিরব নইলে ফিরবই না, একাত্তরের কন্যা-জায়া-জননীরা, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান ইত্যাদি বইগুলো পড়েছি এবং একইভাবে মুগ্ধ হয়েছি। লেখক হিসেবে উনি ভালো ছিলেন নিশ্চয়, ২০১৮ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
এই বইগুলোই ভদ্রলোকের সাথে আমার সম্পর্কের সেতু। এ ছাড়া এই মুগ্ধ পাঠকের সাথে উনার কোনো সম্পর্ক তৈরী হয়নি কোনোদিন। গত সপ্তাহে অফিসের এক সহকর্মী জানালো যে মেজর অব. কামরুল হাসান অসুস্থ, সিএমএইচ-এ আছেন। তাঁকে রক্ত দিতে যাবে। আমার আবার মনে পড়লো সেই বইমেলার রাগীরাগী লোকটাকে।
আজ দুপুরে হান্নান বললো, মেজর কামরুল হাসান মারা গেছেন। যদিও কোনোদিন কথা হয়নি, খুব যে পরিচিত লেখক উনি, তাও না। তবুও আমার প্রিয় লেখক ছিলেন। তাঁর বিদায়ে হঠাৎ করেই বুকটা কেমন খালি খালি হয়ে উঠলো। প্রার্থনা করি, আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করুন। আমিন।
ছবি কৃতজ্ঞতা: আশরাফুল আলম হান্নান