ব্লগে চাইলেই লেখা প্রকাশ করে দেয়া যায়। যখন যেমন ইচ্ছে। কর্তৃপক্ষের তরফে কোন দেখভাল নেই এখানে। দখিন দুয়ার খোলা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গত একযুগে ব্লগের ভার্চুয়াল জগৎ থেকে অসংখ্য লেখক, কবি বাস্তবের জগতে হাটতে শুরু করেছেন। ব্লগের একটা সাফল্যই বলতে হবে এটাকে। ছাঁপার আধিপত্যের আমলে এত সহজে লেখক পরিচিতি পাওয়া মোটামুটিভাবে অসম্ভব ছিল। বিভাগীয় সম্পাদকদের আনুকূল্য না পাওয়ায় অসংখ্য মেধাবী লেখককে সে সময় হারিয়ে যেতে হয়েছে।
কিন্তু লেখা প্রকাশের এই অবারিত সুযোগটাই অনেক ক্ষেত্রেই লেখককে হারিয়ে যেতে সাহায্য করছে। ঠিক এই যায়গাতেই মানসম্মত লেখা প্রয়োজন। যেহেতু ব্লগে আপনার লেখা কেউ সম্পাদনা করছে না, তাই আপনিই আপনার লেখার সম্পাদক। আপনার সম্পাদনাই আপনার সেরা লেখাকে বের করে আনবে। প্রশ্ন হলো, আপনি কি যথাযথ সম্পাদনা করছেন?
আমার উত্তর হলো, না।
আর এই 'না' এর কারণেই জনপ্রিয়তার তীব্র আকাঙ্খায় অপরিপক্ক, মানহীন লেখাগুলো ব্লগে চলে আসছে। ব্লগে নতুন হিসেবে লেখার মান ভালো না হতেই পারে, কোন সমস্যা না। প্রথম হিসেবে আপনাকে সবাই স্বাগত জানাবে। কিন্ত ক্রমাগতভাবে আসতে থাকলে এই লেখাগুলো দু'ধারি ফলার মত হয়ে যায়। এদিকও কাটে, ওদিকও কাটে। একদিকে যেমন ব্লগের মানকে নিম্নমূখী করে, অন্যদিকে প্রাথমিক জৌলুস হারিয়ে এই লেখক ক্রমেই অপাংক্তেয় হতে হতে হারিয়ে যায়। ওই পর্যায় আসার আগেই তাই লেখার স্ব-সম্পাদনা শুরু করুন।
ব্লগে ‘জনপ্রিয় ধারার লেখা’র চল আছে। সেখানেও ওই ‘লাইক, কমেন্ট’ পেয়ে জনপ্রিয়তার আকাঙ্খাই কাজ করে। কিন্তু এক সময় না এক সময় এই জনপ্রিয় ধারার শেষ হয়, দিনশেষে তখন আপনার ‘পাওয়া’ বলতে কিছুই থাকে না। এই না থাকাটা লেখকের মধ্যে যে অবসাদ সৃষ্টি করে, তার শেষ হয় ওই লেখকসত্তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এই যে আমরা প্রায়ই হাহাকার শুনি যে, ব্লগের জৌলুস আগের মত নেই, ভালো ভালো ব্লগাররা এখন আর নেই, তার পেছনে এই ‘জনপ্রিয়’ ধারার লেখা অনেকাংশেই দায়ী বলে আমার মনে হয়।
এখন, ভালো লেখা’র মানদণ্ড কি? সেটা কিন্তু একদমই আপেক্ষিক না। যেই লেখাটা আমার কাছে অসাধারণ সেটা আপনার কাছে পাতে না দেওয়ার মত হতেই পারে। সম্ভব। এর কারণ হলো জানা ও পড়ার সীমানা। আমার চেয়ে যদি আপনার পড়া-জানার সীমানা বিস্তৃত হয়, আপনার কাছে লেখার মানদণ্ডটা স্বভাবিকভাবেই আমার চেয়ে উন্নত হবে। আবার যখন আমি আপনার সীমানা ছুঁয়ে ফেলব, তখন এই সময়ে যেটা আমার কাছে ভালো লেখা মনে হচ্ছে, সেটা খুবই দুর্বল ও অপরিণত লেখা মনে হবে।
খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই, ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা ছেলে মেয়েই ‘তিন গোয়েন্দা’তে মজে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে সেই একই ছেলে বা মেয়ে যখন মাসুদ রানা ধরছে, তখন তার কাছে তিন গোয়েন্দা পানসে হয়ে যাচ্ছে। আবার তিন গোয়েন্দার ওই বয়সেই অনেক ছেলে মেয়ে শুধু মাসুদ রানা নয়, ওয়েস্টার্ন, বা ধরে নিলাম আরো কঠিন কিছু পড়ে থাকে। যে এগুলো পড়ে, বয়স কম হলেও সে আসলে তার সমসাময়িকদের চেয়ে জানা ও পড়ায় এগিয়ে গিয়েছে, ফলে তার রুচিও উন্নততর হয়েছে।
খেয়াল করে দেখবেন, আপনার অনেক লেখাই পরবর্তীতে আপনি নিজেই ডিলিট করে দিয়েছেন। এর কারণ আপনার লেখার বোধ উন্নত হয়েছে, হাত আরো শানিত হয়েছে।
তবে আপনি যাই লিখুন না কেন, কৌতুক লিখুন বা রাজনৈতিক ক্যাচাল পোস্ট অথবা সাহিত্য, সেটা যখন মান উর্ত্তীর্ণ হবে, তখনই সেটা সময়ের পাতায় স্থায়ী হবে। তা সেই পোস্টে কেউ কমেন্ট দিক বা না দিক। কেউ সেটা প্রিয় লেখার তালিকায় রাখুক বা না রাখুক, কিচ্ছু যায় আসে না।
বর্তমান অস্থির সময়ে ভালো লেখার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ফেসবুক। দাত কেলিয়ে একটা ছবির সাথে ‘গুড মর্নিং এভরি ওয়ান’ লেখার সাথে সাথেই শ’ দু’য়েক লাইক আর আশিটা কমেন্ট চলে আসে, যার মধ্যে পঞ্চান্নটা হলো ‘নাইস’। এই ‘লাইক আর নাইসে’র স্রোতে পড়ে পড়া এবং লেখা, দুটোই অনন্ত নক্ষত্রবিথীতে পাড়ি জমিয়েছে। বাধ্য হয়ে একই পথ ধরেছে সৃষ্টিশীলতাও। তার বিপরীতে এসেছে ‘হাই ভন্দরা, ক্যামন লাগছে আমাকে’র দাপট। এই দাপটের কাছে হেরে গিয়ে আমরা যারা কিছুটা ব্যতিক্রমী, যারা ব্লগে লিখি টিখি, তারাও দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার দৌড়ে শামিল হয়ে গেছি।
নিজের স্থায়ীত্বের জন্যে, নিজের মনের খোরাক নিশ্চিত করতেই এই দৌড় বন্ধ করুন। অতীতে অনেক বড় বড় নাম এই দৌড়ে বিপুল বিক্রমে প্রথম হয়েও এখন অকালে অবসর নিয়ে তামাক টেনে দিন গুজরান করছেন। সে মহামারী থেকে বাচতেই ভালো লেখা, মানসম্মত লেখা প্রয়োজন।
তার চেয়ে বড় কথা, একটা ভালো লেখা আপনার মনে যে আনন্দ দেবে, তার কাছে লাইক, কমেন্ট নিতান্তই নস্যি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৩