নানু দাদুদের মুখে কোটালপুত্রদের গল্প শুনে শুনে আমরা একদা আমাদের শৈশব পার করেছি। এই কোটালপুত্ররা রাজপ্রাসাদের আশেপাশেই থাকতো। রাজা-রাণী আর রাজপুত্র-রাজকন্যাদের গল্পে সেকালের কোটালপুত্রদেরও স্থান হতো।
সেকালের কোটালপুত্ররা বড় হয়ে সচারচর কোটালই হতো; তবুও তারা খুব সৎ থাকতো। কোন অন্যায় সুযোগ সুবিধা তারা পেতো না, নেয়ার চিন্তা করতেও পারতো না, তবে তারা খুবই পরিশ্রমী ছিলো। তাদের এই সততা, বুদ্ধিমত্তা আর পরিশ্রম দেখে রাজামশায় কখনো কখনো তাদেরকে মন্ত্রী পরিষদ সচিব বা পুলিশ প্রধান করে দিতেন। এ রকম পদ পেয়ে তারা আরো দায়িত্বশীল হতো। আরো মহান হতো।
এরকম কোটালপুত্ররাই যুগ যুগ ধরে আমাদের গল্পের অংশ হয়ে রয়েছে। কিন্তু আজকের কোটা’লপুত্ররা সেকালের কোটালপুত্রদের মত সৎও নয়, পরিশ্রমীতো নয়ই। এরা একেকজন প্রতিবন্ধী কিন্তু নবাবজাদা। তারা শুধু কোন না কোনভাবে পাওয়া মহামূল্যবান সনদটি ফটোকপির পর ফটোকপি করতে থাকে, প্রত্যেকদিন সকালে ধুপ-পুষ্প দিয়ে পুঁজো করে আর সরকার বাহাদুরের কৃপাদৃষ্টির দিকে ভিখিরির মত তাকিয়ে থাকে। তারা একেকজন ভিখিরি।
এই কোটা’লপুত্ররা সিঁধেল চোরের মত বাঁকা রাস্তায় পেছন দিক দিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার পর, যখন আমজনতার ন্যায্য আন্দোলন শুরু হয়, তখন ঠোটে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে মস্করা করে। কোটা রক্ষার আন্দোলনে নব্য কিছু কোটা’লপুত্রকে মাঠে নামিয়ে দেয়।
আগের দিনের কোটালপুত্ররা মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজতন্ত্রের ফ্যাড়ায় পড়ে কোটালই হতো, কিন্তু এখনকার গণতন্ত্রের দিনে কোটা’লপুত্ররা চৌকিদার হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে হয়ে বসে প্রধান সচিব!
সে সময়কার কোটালপুত্ররা পরিশ্রম করে নিজের যোগ্যতাবলে রাজপ্রাসাদের উচুঁ পদে যাওয়ার চেষ্টা করতো, আর আজকের কোটা’লপুত্ররা কেবলি রেয়াত নিয়ে বড় পদে যেতে উদগ্রীব থাকে। শুধু উদগ্রীব কেন, এটা তাদের অধিকার মনে করে।
আগেকার কোটালপুত্রদের কদাচিৎ রাজকন্যার সাথে প্রেম হয়ে যেতো। তারপর তারা ব্যাপক সংগ্রাম করে জীবনপণ রেখে রাজকন্যাকে জয় করতো, আর এখনকার দিনে রাজারাণীরাই কোটা’লপুত্রদেরকে তোঁয়াজ-তাজিম করে নিজেদের আখের ঠিক রাখতে চেষ্টা করে। কলিকাল আর কি!
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই যেখানে ছিলো শোষণমুক্ত সমাজ গঠন, সেখানে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরেরাই মুক্তিযুদ্ধের প্রায় অর্ধশত বছর পরে এসেও সুবিধার নামে নাকি কান্না করে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। আর মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই বৈষম্যের আগুনে বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। বাহ, কি সুন্দর দেখা গেল।
একটা জাতির পতনের আওয়াজ তখনই জোরালো হয়, যখন ন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায় প্রকট হয়ে ওঠে। আজ বাংলাদেশে সেটাই হচ্ছে। একটা যৌক্তিক ন্যায্য আন্দোলনকে কোটা’লপুত্ররা গায়ের জোরে, বন্দুকের নল দিয়ে দাবিয়ে রাখতে চাচ্ছে। সেটা নিয়ে যাদের উচ্চকিত হওয়ার কথা, তারা কেউ কোন কথাও বলছে না।
সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘কোন পরাশক্তিই দাবায়ে রাখতে পারবে না.. .. ..’। কিন্তু এতদিন পর এসে আমরা দেখছি, কোন পরাশক্তি নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারিরাই আমাদেরকে দাবায়ে রাখার সব আয়োজন পাকা করে ফেলেছে। আগেকার দিনের কোটালপুত্ররা তাই মাঝেমধ্যে নায়কের আসন পেলেও আজকের কোটা'লপুত্ররা ভবিষ্যতের গল্পে কেবলই বিভিষণ হয়ে থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:১৬