একটা সময় গেছে যখন ডব্লিউ ডব্লিউ এফ (WWF) এর কুস্তি বা রেসলিং গুলো রুদ্ধশ্বাসে দেখতাম বিটিভিতে। কেউ পাতানো খেলা বললে একটা অস্বস্তিও বোধহয় হত ভেতরে ভেতরে। মিল মাস্কারাস, আর্জেন্টিনা এপোলো, রিপ হক, এরিক দ্য রেড, বুলডগ ব্রাওয়ার, এক নিঃশ্বাসে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নামগুলা আউড়ে যেতেন। আউড়াতে আউড়াতেই দেখতাম সঞ্চালক মাটিতে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বাকিটুকু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ক্যামেরা ফোকাস হতো এক দশাসই আকৃতির অপশক্তির দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখা যেতো সে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে স্টেজের আশেপাশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে দিয়েছে, অপেক্ষাকৃত দূর্বল আকৃতির রেসলারদের অচেতন শরীরগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে। রিং এর আশেপাশে মানবতা, সততা, বিচারের বানী সব নিভৃতে কান্নাকাটি শুরু করে দিতো , দর্শক সব রুদ্ধশ্বাস। কমেন্টেটরের মাইক ভিলেনের হাতে, উদ্ধত বাচনভঙ্গি, বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেই পদ চিহ্ন। ঠিক এই সময়ে আবির্ভাব ঘটতো মেদহীন ২৪০ পাউন্ডের মিল মাস্কারাস বা এই জাতীয় কোন বিশ্বজয়ীর। সে আর তার সহোদরেরা রিং দুনিয়ায় শান্তি রক্ষার্থে জীবন বাজি রেখে নেমে পড়তেন। অতি অত্যাশ্চর্যের ব্যাপার এইযে এতক্ষন পড়ে থাকা নট-নড়নচড়ন শরীরগুলো এই লড়ায়ের পূরোভাগে থাকতো তখন। লড়াই শেষে দেখা যেতো অপশক্তিবর্গের অচেতন দেহগুলো আগের কায়দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কমেন্টেটর তার মাইক ফিরে পেয়ে অবিরাম বকে চলেছেন, দর্শক হাঁফ ছেড়ে নড়ে চড়ে বসছে, এরই মাঝে ক্যামেরা ভিলেনের উদ্ধত বান্ধবি কিংবা নায়কের সপ্রতিভ স্ত্রীর উপর একচক্কর ঘুরে রিং এর মাঝে এসে থিতু হতো। এখনও ২০১০ এ একই তামাশা চলছে। আসলে হাজার হলেও শো বিজনেস। গ্লামারস, ফান, নাটকিয়তা, রুদ্ধশ্বাস, হিরো, এন্টিহিরো সব উপাদানের সমন্বয় এখানে ঘটবে, বা ঘটাতে হবে।
বলছিলাম সেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। এরই মাঝে কানে আসলো বিশ্বখ্যাত রেসলার নাসির ভুলু এখন ঢাকায়। নাসির ভুলু পাকিস্তানের ভুলু পরিবারের সন্তান। কুস্তি ভুলু পরিবারের পারিবারিক ঐতিহ্য। যারা তার নাম শুনেননি তারা পরে উইকিপিডিয়া থেকে ঘুরে আসতে পারেন। বাংলাদেশের কুস্তিগীর জলীল সহ ভারতের কয়েকজন ছিলেন। ঢাকা ছাড়াও শো টা বাংলাদেশের বেশ কয়েক জায়গায় হয়েছিল। আলোড়নও তুলেছিল। সব খেলার ফলাফল মনে নাই, তবে নাসির ভুলু কে একপলক দেখতে পুরো বাংলাদেশ ভেঙ্গে পড়েছিল মনে আছে। মাসকিউলার ছিমছাম কাঠামো। ভালই লেগেছিল তার খেলা। আসলে সময়টা তখন যেন অন্যরকম ছিল। উঠতি কিশোর কিংবা তরুন সকলের স্বপ্ন ছিল পেশীবহুল একহারা কাঠামো। তার উপর হপ্তায় হপ্তায় টিভিতে রেসলিং হিরোদের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স আর স্বচক্ষে নাসির ভুলুর ফ্লাইং কিক দর্শন যোগ হলে তো কথায় নাই।
জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর পরিচিতের মধ্যে অনেককে জিমে আসা যাওয়া করতে দেখতাম। বেশীরভাগই ছিল অস্থির প্রকৃতির। একমাসেই তার সিলভেস্টার স্ট্যালোন হওয়া চাই। মাসখানেক রাত দিন ধরে সারা জীবনের কসরতের কোটা শেষ করে হাল ছেড়ে দিত। কেউ কেউ যে লেগে থাকতোনা তা নয় ,মাস তিনেকের মধ্যে ছোটো হাতের শার্ট কিনতে দেখতাম, তবে বছরখানেক পরে আশানুরূপ ফল না পেয়ে ছেড়ে দিত। একসময়ে নিজে যাইনি একথা বলবনা, গেছি। তবে এটুকু বুঝেছিলাম কঠোর এক্সারসাইজ, আর সকাল বেলা লম্বা দৌড়ের সঙ্গে স্ফীত পেশীর সম্পর্ক ঠিক সমানুপাতিক নয়, এর সঙ্গে আরোও কিছুর এস্তেমাল না হলে শরীরের বাইশেপস, ট্রাইসেপ্স, আর সিক্স প্যাক ফুলে ফেঁপে ভিজিবল হয়ে উঠেনা। আগ্রহ থাকায় যারা মতামত দেবার জ্ঞান রাখেন তাদের সঙ্গে আলোচনা যে করিনি তা নয়, তবে ব্যাখ্যা যতনা প্রাক্টিক্যাল তার চেয়ে বেশী তাত্ত্বিক ও জেনারালাইজ মনে হোতো। মানে এই লাইনে পারফেকশনে বলতে যা বুঝায় সেখানে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট মনে হয়নি। যাহোক সেই রহস্য নিয়ে পরে আর আগানো হয়ে উঠেনি। ততদিনে সকলের মত এই ফ্যানন্টাসিজম ছেড়ে জীবনের আসল যে কাজ, মানে পড়াশোনা আর পরবর্তীতে রুজি আর রুটির যোগান, সেই কাজে নেমে পড়তে হয়েছে।
এর অনেক অনেকদিন পরের কথা বলি, তখন দেশের বাইরে। যে বাসায় থাকতাম তার ২০০ মিটার এর মধ্যে একটা জিমনেসিয়াম ছিল। হাতের কাছে জিম পেয়ে আবার সেই পুরানো শখ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠল, ভাবলাম দেখি এরা কি কি সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। সারা মাসের জন্য কার্ড করে নিলে এমন কোন বেশীখরচ পড়তোনা। একটা কার্ড করে আসা যাওয়া শুরু করলাম। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বয়স ৪০ থেকে ৪৫ হবে, পরিচয় হয়েছিল না বলে পরিচয় করেছিলাম বললে ঠিক হবে। খালি গায়ে যখন বেঞ্চপ্রেস করতো আর ইনক্রেডিবল হাল্কের মত মাসল গুলা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তে চাইতো, তখন আমরা নিজের কাজ বাদ দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতাম। একসেট ওয়ার্কাউট করার পর ১০/১৫ মিনিট পায়চারি করতেন। সেই ফাঁকে হাই হ্যালো বলে টুকটাক কথা শুরু করতাম। হপ্তায় দুদিন আসতেন। সরকারী টিভিতে অডিও সেকশনে এডিটিং এর কাজ করতেন। যৌবনে প্যাশন ছিলো বডি বিল্ডিং। হালি খানেক আন্তর্জাতিক এওয়ার্ড তার কারয়াত্ত। এখনো চর্চা অব্যাহত আছে, সপ্তাহে দুইদিন! পরে একথা সেকথা অনেক কথায় হোত। দুই মেয়ে উনার। ছোট মেয়েটা সামনে বছর স্কুলে ভর্তি হবে। বড় মেয়েটাকে এই সামারে একখানা সাইকেল কিনে দিবেন বলে ভাবছেন এটাও জানা হলো। সহজ সরল লোক। যাহোক সারা জীবনের যে অধরা রহস্য তা পেশ করতে বেশী দেরী করিনি। আমি বিদেশী বলে কিনা জানিনা বেশ আগ্রহ সহকারে শরীর গঠনের খুঁটিনাটি প্রশ্নের উত্তর উনি দিয়ে যেতেন এবং এ সম্পর্কে কিছু বইপত্র আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। সে সকল আলোচনা, মানে শরীর গঠন সংক্রান্ত বিভিন্ন মিথ ,সাবধানতা ও নিয়মকানুন নিজের মতকরে সাজিয়ে পরের পর্বে এ বিষয়ে আগ্রহী পাঠকের জন্য পেশ করার ইচ্ছে থাকলো। স্বাস্থ্যই সম্পদ, অতি ব্যবহারে মলিন ছোট একটা কথা, কিন্ত কি ভয়ানক রকম সত্য। একটু সময় নেবো, আশা করি সঙ্গে থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১২ রাত ২:৩৩