ড্রাইভার হেলপার ছাড়া পুরো বাসে বোধহয় আমিই জেগে আছি। আদরের অতিশয্যের কারনে মাঝে মাঝেই ফোনে মামাকে জানাতে হচ্ছে আমার লোকেশন, অতিশয় সচেতন তিনি, রাত জেগে ভ্রমণ শুধু আমি একা করছিনা উনিও আছেন ঢাকাতে বসে এই ভ্রমণে আমার সাথে। হঠাৎ লেগে আসা চোখটা খুলে গেলো মোবাইল রিংটোনে, ঠিক কোথায় আছি জানাতে লেগে গেলো কিছুক্ষণ ততক্ষণে ঘুম বাবাজী ছুটে পালিয়ছে। জানালা দিয়ে খোলা মাঠের উপরে হাস্বোজ্জ্যল চাঁদ মামা যেনো বলছে আমায়- ভাগ্নে এই মামাতো উপর থেকে সেই প্রথম থেকেই দেখে আসছে তোমায়, ঘরের মামাতো পারেনা তাই এত হুশিয়ারি। মৃদু ঠান্ডা বাতাস যেনো এই ফাঁকে ফিসফিস বলে গেলো- আজ রাত নাহয় এই মামা ভাগ্নে গল্প করেই কাটিয়ে দাও আমি শীতল স্পর্শে জাগিয়ে রাখি মুহূর্ত। দু একটা পাখি যেনো কিচির মিচির করে উঠলো.....
বাতাসে ভেসে থাকা সীসা নির্ঘুম রাত বয়ে মিশে গেলো শিশির ভেজা সবুজ চায়ের পাতায়, নিমগ্ন স্বপ্নগুলো সহযাত্রী বন্ধুর চোখে এনে দিলো মৃদু ঘুম। এদিকে না ঘুমানো খচখচে এই চোখ লুকিয়ে ঠিকই দেখে নিলো কোমল আলোর স্নিগ্ধ সকাল। আবছা আলোয় সেই চলমান ব্যস্ততা নিয়ে নতুন করে জেগে রইলো পুরনো অস্তিত্ব।
শুরুতেই বৃষ্টিভেজা অভিবাদন। বৃষ্টি শেষে রোদেলা সকালে সিলেট শহরে।
মেঘের সাথে আকাশের বন্ধুত্ব যেদিন সারাক্ষণ হাত ধরাধরি করে থাকে মন নামে আমার নিজস্ব রাজ্যপাটে কি এক তোলপাড় খেলা করে। ঠুনকো হোক অথবা দৃশ্যতো, অস্থিরতা থেমে যেতে সময় নেয় অনেক্ষন। হঠাৎই সবকিছু অহেতক মনে হয়। বেঁচে থাকা, ভালবাসা, সমাজ অথবা সংসার।
রাতারকুল যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছি, ব্লগের সাহায্য নিয়ে আম্বরখানা হয়ে মোটরঘাট দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, কি জানি কি হয়, বেশীরভাগ মানুষই তেমন বেশী কিছু জানেনা এখানে তাই ভ্রমণপিয়াসী হয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে আমাদের।আলো আঁধারির মাঝে চলে রাতারকুল যেখানে থামলাম সেখানে অপেক্ষা করছিলো গাছে গাছে বানরের ঝাঁক, নাম না জানা পাখির কিচির মিচির, প্রজাপতির ওড়াওড়ি। মাঝি ইব্রাহীম আমাদের দেখিয়ে দিল সিফাত উল্লাহ কে। এখানে আসা মানুষদের সে গান শোনায়। তার কন্ঠে আব্দুল করিমের গান শুনে নির্জন প্রকৃতিতে মোহনীয় আবেশে মাতলাম কিছুক্ষণ...এরপর গন্তব্য লালাখাল/ বিছানাকান্দি/ পান্থময়/জাফলং।
লালাখাল, জাফলং কোথাও আর যাওয়া হলোনা, কারন একটায়, রাতারকুলের মুগ্ধতায় জড়িয়ে ছিলাম একটু বেশীক্ষন। ফিরে এলাম মোটরঘাট, পাঁচভাই রেষ্টুরেন্ট থেকে কবুতরের মাংস দিয়ে ভরপেট খেয়ে রওনা হলাম শাহজালাল (রাঃ) মাজারে তারপর ওখান থেকে সুরমা ব্রীজ, আলী আমজাদের ঘড়ি।
তখনো বুঝিনি কি অ্যাডভেন্চার অপেক্ষা করছে আমার জন্য। গতবার সিলেট এসে আনপ্ল্যান ছিলো লালাখাল ভ্রমন আর এবার জৈন্তাপুর জ্বলা ফিল্ড। জায়গার নাম উৎলার পাড়। যতক্ষনে সেখানে এসে পৌছালাম সূর্যিমামা ডুবে গেছে। বন্ধু তুহিনের দেখানো পথ ধরে এগোলাম আমরা আগুনজ্বলা পাহাড় দেখতে, সাথে নিয়েছি দেশলাই। ১০ মিনিট মতো গা ছমছম অন্ধকারে হাটার পর চোখের সামনে আলো এনে দিলো টিমটিম অাগুন জ্বলা পাহাড়, কিসের দেশলাই! রূপকথার দৈত্যের পাহাড়ের মাঝে মাঝেই জ্বলছে আগুন, রাস্তা থেকে একটু নেমে তাকিয়ে দেখি আগুনের টিমটিমে আভা গোল হয়ে সাজিয়ে রেখেছে জ্বলন্ত ফুলের মালা, যেখানেই দেশলাই জ্বালায় পাহাড়ের গায়ে দপ করে জ্বলে ওঠে আগুন। গা ছমছম দুই পাহাড়ের পথ ধরে আরো এগুলাম আমরা গন্তব্য আগুনজ্বলা পুকুর। জ্বলন্ত নক্ষত্রের বাগান হয়ে চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে হাজার জোনাকী। এই শরীরের লোম কাঁটা দেয়া জনমানবহীন পথ ধরে আরো মিনিট পাঁচেক হাটার পর কেমন একটা ফিসফিস আওয়াজ, পুকুরটা পেলাম, আওয়াজটা তখন ফোটানো পানির মতো। বুঝলাম পুকুর ভরা গ্যাস, সাহস হলোনা দেশলাই জ্বালাতে আর। নির্জন পাহাড় পেরিয়ে ফিরে এলাম প্রধান সড়কে।
কাল হয়তো সিলেট থাকলে লালাখাল/ বিছানাকান্দি/পান্থময় আর শ্রীমঙ্গল গেলে মাধবপুর লেক/ মাধবকুন্ডু/ লাউয়াছড়া।
অপেক্ষাগুলো অন্যরকম কষ্টের, যখন মাধবপুর লেক থেকে ভানুগাছ ফিরে ২ ঘন্টা সময় দিনের আলো হাতে নিয়ে মাধবকুন্ডু যাবার জন্য মনস্থির করেও ১২০০ টাকা সিএনজি ভাড়া কোনরকমই কম করা গেলোনা তখন নিস্কর্ম অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার ছিলোনা আর। তবে এই অপেক্ষা কিছু অংশে লাঘব হলো গ্রামের বাড়ি রেস্তোরার হরেক রকম স্বাদে, ৫টায় দুপুরের ভোজ খারাপ না। আরো কিছুক্ষনের অপেক্ষা চললো ছবি শেয়ারের মাধ্যমে। তারপর আঁকাবাঁকা পথ ধরে সন্ধ্যার টিপটিপ বৃষ্টিতে শ্রীমঙ্গল এসে শেষবারের মতো চায়ের কাপে চুমুক। ঢাকার গাড়ি চলে এলো তখনই, আসতে হবে তখনই নতুবা ১২টা।
কোথাও যাওয়া হয়নি আর বৃষ্টিভেজা শ্রীমঙ্গলের মাধবপুর লেক আর লাওয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ছাড়া।
ওয়াহিদকে অপেক্ষায় রেখে এলাম শ্রীমঙ্গলে, ওর চট্টগ্রামের ট্রেন রাত ১১.৩০ টায়। অপেক্ষা করো বন্ধু, নিষ্ঠুর অপেক্ষা। বিদায় চায়ের দেশ এবারের মতো।