রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হেইট ক্যাম্পেইন থামছে না । তা চলুক। কিন্তু সমস্যা হল কোন মতেই তাকে বিদেয়ও করা যাচ্ছে না। রবীন্দ্র প্রেমান্ধ আর রবীন্দ্র ঘৃণান্ধ র মাঝখানে বহাল তবিয়তে আছেন রবীন্দ্রনাথ । বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র যদি কোনদিন তার লেখা জাতীয় সঙ্গীত খারিজ করেও দেয়, তারপর তার বিদেয় ঘটবে কিনা সেই দুস্বপ্ন জড়িত জলাতংক রোগের মত রবীন্দ্রাতংক গ্রস্ত রোগীরা সতত পীড়িত।
রবীন্দ্র বিদ্ধেষ নতুন কিছু নয়। সেটা পাকিস্থানী মননের ধারাবাহিকতা। জাতীয় সঙ্গীত টা কেন যে তার কাছ থেকে নেয়া হয়েছে, পাকিস্থানী ভাবধারার বাহকদের আত্মমর্যাদায় লেগে আছে । যা অমোচনীয়, যার ক্ষত নিরাময় হবে না কোন মতেই। যে বা যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরুধিতাই করবে, ঘৃণাই যেখানে অবলম্বন - কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষন যুক্তি, ওঝা বৈদ্যের ঝাড় ফুঁক বা ইতিহাসের অলংঘ্য প্রমানাদি দিলেও , তাদের বিদ্ধেষের ভুত সে অবস্থান থেকে সরবে না। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টার বিরুধীতা কখনো করেন নি - শত প্রমানাদি তার রয়েছে। যেদিন এর বিরুদ্ধে মিটিং হয় সেদিন তিনি কলকাতায় ছিলেনই না।এমন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টার বিরুধিতার মুলে সাম্প্রদায়িকতার ছিটেফোঁটা ছিল না।এমন কি সে সময় মুসলমানদের একাংশও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ছিল না - তার পেছনে যথার্থ কারনও ছিল । জ্ঞান পাপীরা সে সব জানে, কিন্তু ভেতরে বিষ রেখে কিভাবে ছোবল না মেরে থাকা যায়? কবির বরাত দিয়ে জীবনীকার স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে লিখতে সংশয় বোধ করতেন ,যদি তার লেখা কারও পছন্দ না হয়, যদি অসাবধানতা বশত করা আপন কোন মন্তব্য সাধারনের সাথে না মেলে, যদি কেউ আঘাত পান। ভারতের বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতার প্রতি আজীবন সতর্ক তিনি হিন্দুদের সম্পর্কে লিখতে যতটকু দ্বিধাহীন ছিলেন, ঠিক বিপরীত দ্বিধাচ্ছন্নতা তার ছিল অপর সম্প্রদায়কে নিয়ে লিখতে। সংশয় ছিল কে কিভাবে সেটাকে নিয়ে আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় । কারন তাঁর সৃষ্টিশীলতা যখন থেকে অবমুক্ত হতে শুরু করেছে তখন থেকেই বাড়তে থাকে নিন্দুক আর প্রতিহিংসুকের দল। তাই নিজের জন্মদিন নিয়ে লেখা কবিতায় লিখেছিলেন, 'নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ/আমার নৌকার ডাইনে বায়ে/জীবনের পন্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে /নিন্দার তলায় পঙ্কের মধ্যে। মুসলিম দের নিয়ে কম লিখার কথা তিনি অকুন্ঠ চিত্তে স্বীকারও করেছেন। তারপরও মিলাদুন্নবী উপলক্ষে তিনি বানী পাঠিয়েছিলেন । সান্তনাহীন দের কাছে সে সব বাহ্য । একবার বলে ইংরেজ দের গুনগ্রাহী ছিলেন, নাইট উপাধি ফিরিয়ে দেয়া নিছক লোক দেখানো । আবার বলে ইংরেজদের তৈরী বঙ্গ ভঙ্গের বিরুধিতা করে দুই সম্প্রদায়ের মিলন রক্ষার প্রানান্ত চেষ্টাও ক্ষমাহীন অপরাধ । এই মন মানস সাম্প্রদায়িক বিষ্টা পরিপূর্ণ। কোন উপন্যাসের কোন চরিত্র কাহিনীর খাতিরে কি বলছে তার ব্যবচ্ছেদ ও প্রয়োজন। তার মানে আপনার ক্ষমা নেই রবি বাবু । তিনি নাকি সুদের কারবার করতেন। তারপরও শান্তিনিকেতন প্রতিষ্টার জন্য বউ এর গয়না বিক্রি করেন।সুদের টাকা কি ক্লিন্টন ফাউন্ডেশন এ গেছে কিনা ভবিতব্য জানে। পরিশেষে রবীন্দ্রাতঙ্ক রোগীদের এখন নতুন একটি উপসর্গ দেখা দিয়েছে। সেটা হল তার বাল্য বিবাহ । তাতে হাত মিলিয়েছে , নাছোড় যুক্তিবাদী কাপালিক স্বভাবের কিছু তথাকথিত 'মুক্তমনা' । এরা বলতে চায়, ১১/১২ বছরের মেয়েকে বিয়ে করে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে পিডোফাইল প্রমান করেছেন বা সে কারনে তাকে পিডোফাইল বলা যেতে পারে। তার মানে শিশুদের প্রতি তিনি কামভাব লালন করতেন। মনস্তত্বের বিশ্লেষন অনুযায়ী নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব পিডোফাইল রা একটি শিশুতে শুধু আবিষ্ট থাকে না। এ রকম একজন শিশু কামীকে সুইডিশ একাডেমি বেছে নেয় দুনিয়ার প্রথম নন ইউরোপিয়ান নোবেলজয়ী হিসাবে। আর তাঁর মাথা থেকেই বেরিয়েছে অযুত লক্ষ লেখা,সেটা তো ঐশী কিছু নয়, যার আবেদন খারিজ করার শক্তি প্রতিপক্ষেরও নেই ? অভিধানে বলছে a person who is sexually attracted to children। একটা শিশু নয় । পিডোফাইল রা একটা শিশুতে সন্তুষ্ট থাকার নয়। অন্তত আধুনিক মনস্তত্ব বিজ্ঞান সেটা বলে । ১৯৬৮ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসসিয়েশন এটাকে মেন্টাল ডিসঅর্ডার বা মানসিক বৈকল্য হিসেবে ড্যায়াগনসিস করে। তার মানে যারা শিশু কামী তারা পর্যায়ক্রমে শিশু দের প্রতিই আকৃষ্ট হবেন। এক্ষেত্রে খুঁজে বার করতে হবে আর কয়জন শিশু রবীন্দ্রনাথের এই মেন্টাল ডিসঅর্ডার এর শিকার হয়েছিল। 'মুক্তমনা' কিছু 'গবেষক' এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারেন। অবশ্য এদের গবেষনা আর ওদের গবেষনা পাশাপাশি পাখা মেলেছে। যেমন ঠাকুরপো'র বিয়ের কারনে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। তাদের মাঝে প্রেম হলে ত ভাল কথা। প্রেমিক আবার সানন্দে বিয়ের পিরিতে বসেন কীভাবে ? প্রেমিকাই বা প্রেমিকের জন্যে বউ দেখতে যা্ন কি করে? দেবেন ঠাকুরের মহল্লা থেকে পালানো র উপায় নেই বুঝলাম। হিসেবে পরকীয়া ত চলতে পারত। কাদম্বরীও সেটা খতিয়ে দেখলেন না ? ভাইজি ইন্দিরা দেবী র প্রতি রবির অবচেতনে প্রেমাকাঙ্খা ছিল। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো র চাতুর্য তো আছেই। কবিতা চিঠি এসব ঘাটলে স্থুল সন্দর্ভ বানাতে বেগ পেতে হয় না। বৌদি জ্ঞাননন্দিনীর সাথে জোতিরিন্দ্রনাথের মধুর সম্পরক ছিল। জ্ঞাননন্দিনী কাদম্বরী কে অপছন্দ করতেন, তাই তাকে আহত করার জন্যে রবির বউ দেখতে যশোরে নিজ গ্রাম নরেন্দ্র পুরে নিয়ে এসেছিলেন।এই প্রসঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরা দেবী ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পূর্ব প্রথানুসারে রবিকাকার কনে খুঁজতেও তাঁর বউঠাকুরানীরা মানে মা আর নতুন কাকিমা (কাদম্বরী দেবী), জ্যোতি কাকা মহাশয় আর রবি কাকাকে সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যশোর যাত্রা করলেন। বলাবাহুল্য আমরা দুই ভাই-বোনেও সে যাত্রায় বাদ পড়িনি। যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে ছিল আমার মামার বাড়ি। সেখানেই আমরা সদলবলে আশ্রয় নিলুম। যদিও এই বউ পরিচয়ের দলে আমরা দুভাই-বোন থাকতুম না। তাহলেও শুনেছি যে তাঁরা দক্ষিণডিহি চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি আশপাশের গ্রামে যেখানে একটু বিবাহযোগ্যা মেয়ের খোঁজ পেতেন সেখানেই সন্ধান করতে যেতেন। কিন্তু বোধ হয় তখন যশোরে সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছিল। কারণ এত খোঁজ করেও বউঠাকুরানীরা মনের মতো কনে খুঁজে পেলেন না। আবার নিতান্ত বালিকা হলেও তো চলবে না। তাই সবশেষে তাঁরা জোড়াসাঁকোর কাছারির একজন কর্মচারী বেণী রায় মশায়ের অপেক্ষাকৃত বয়স্কা কন্যাকেই মনোনীত করলেন।’ আনিসুজ্জামান বা সঞ্জিদা খাতুন প্রমুখ দের জ্যোতিরিন্দ্র নাথের পকেটে নটির চিঠির প্রসংগ তে বৈপ্লবিকতা নেই। বৈপ্লবিকতা আছে, নীরদ সি চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক বা রঞ্জন বন্ধ্যপাধ্যায় এ । বিষয় বস্তুতে রগড় না থাকলে লেখায় বৈপ্লবিকতা থাকে না। ভক্তরাও খায় না । এসব প্রমানের জন্যে গান কবিতা চিঠি এসব ত আছেই। খাপে খাপ লাগিয়ে দিতে পারলেই কিস্তি মাত। ভাল লাগার ব্যাপার তো তার অনেকের সাথে হয়েছে , হয়ত এক তরফা বা উভয় দিকে। তা বলে সেটা কি ধর মার কাট গোছের কিছু ? তাতে আত্ম নিয়ন্ত্রন না থাকলে হয়তো তার ডজন খানেক পত্নী উপপত্নী থাকত । তাঁকে যারা পবিত্র বানাতে চায় তারা যেমন উদ্ভট আর যারা রগড় তৈরি করতে চায় তারাও বদ্ধ উদ্ভট।
তো রবীন্দ্রনাথ একা পিডোফাইল ছিলেন না। সে তালিকাটাও নেহাত ছোট না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) বিয়ে করেছিলেন ১৪/১৫ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রী সারদা দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর, শিবনাথ শাস্ত্রী বিয়ে করেছিলেন ১২/১৩ বছর বয়সে, তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১০ বছর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিয়ে করেছিলেন ১৪ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ৮ বছর। বঙ্কিমচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন ১১ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। রাজনারায়ণ বসু বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১১ বছর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৯ বছর বয়সে, তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১৭ বছর বসে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ২২ বছর বয়সে তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল ১১ বছর। এরা এক স্ত্রী তে আজীবন সমর্পিত ছিলেন। স্ত্রীর সাথে স্বামীর বয়সের দুরত্ব বেশি কমে ১০ বছর। কারোই বৃদ্ধস্য তরুনী ভার্যা নয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বিয়ের ব্যাপারে একরকম চাপে পড়েই শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথের তর্জনী উপেক্ষা করে অকৃতদার থাকবে সেটা ছিল অভাবিত ।তা না হলে কুড়ি বছরের নিয়মের মাঝেই যার জন্যে পাত্রীই পাওয়া যাচ্ছিল না, গা গেরাম থেকে অনুঢ়া মেয়ে একটা নিয়ে এসে বাইশ/তেইশ বছরে বিয়ের পিরীতে না বসে উপায় কি ছিল । আর তা না হলে তিনি কি করে লিখলেন, 'মা কেদে কয় ‘মঞ্জুলী মোর ঐ তো কচি মেয়ে/ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে বয়সে ওর চেয়ে/পাঁচগুণো সে; বড়ো /তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়ো সড়ো/এমন বিয়ে, ঘটতে দেবো নাকো।' (“নিষ্কৃতি,” ‘পলাতকা’) ।কেনই বা নিজের বিয়ের চিঠিতে নিজেই পাদটীকা লিখেন "আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়'।
তাছাড়া তাঁর রচিত ছোটগল্প ‘দেনাপাওনা’, ‘ত্যাগ’, ‘ঘাটের কথা’, ‘মেঘ-রৌদ্র’ ইত্যাদি গল্পে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁকে কেনই বা সোচ্চার হতে দেখা যায়। তাঁর বিভিন্ন শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধে নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলে সমাজে পুরুষের পাশাপাশি আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে কেনই বা উৎসাহিত করেছেন। সেই রবীন্দ্রনাথ কে শিশুকামী বানাতে চাইলে সত্যিকারের শিশুকামীতার মনোবিজ্ঞান ভিত্তিক ময়না তদন্ত আবশ্যক।