আমার রবীন্দ্রনাথ, উপেক্ষার মাঝে পাওয়া। ছাত্রজীবন, বাম আন্দলনের প্রবল জোয়ার, সেই আবেগের স্রোতে সাঁতরানো। নকশালবাড়ী অস্ত গেলেও তার ঝাঁজ চাদ্দিকে । রবীন্দ্র বুর্জোয়া , তিনি অচ্যুত, তাঁকে ছাড়ো। তাঁর নিশ্বাস প্রাশ্বাসও তখন অসহ্য । আমাদের অস্থির চিত্তকে সম্মোহিত করতে কলকাতার কোন এক কবি লিখলেন, অবিকল মনে নেই । ঠিক যেন এরকম- 'সূর্যকে পিঠে রেখে, যে মানুষটি / গাছের গুড়ি ঠেলে চলছে/ সে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।' এরকম আর কত ভয়াবহ আরতি । সেই অর্বাচীনতা, সেই অশুভ বোধন, টের পাই অনেক পরে। তারপর আবার ফিয়ে পাওয়া, তাঁর সাথেই বেড়ে উঠা। বিভিন্ন রবীন্দ্রনাথ এর মাঝে, কবি গীতিকার সুরকার আর শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে কাছে রেখে দেই। আগন্তকের মতো অনেককেই , শিউরে উঠতে দেখেছি একেবারে উন্নাসিকতার সর্বশেষ ধাপে দাঁড়িয়ে, তাঁর সেই(যেন সমসাময়িক) সব প্রবন্ধ গুলো পড়ে । 'সভ্যতার সংকট', 'মানুষের ধর্ম' ইত্যাদি আরও বা বই 'রাশিয়ার চিঠি'। সে আর এক রবীন্দ্রনাথ। অনেকেই তাঁকে সে অর্থে গোনে। তিনি নানা জনকে নানা ভাবে মুগ্ধ করেন, নানা উৎকর্ষতায় । দিনুবাবু(দিনেন্দ্রনাথে ঠাকুর) র কন্ঠে তাতক্ষনিক যে গান তিনি একে একে তুলে দিয়েছিলেন, তাঁর সে গান আর আজকের দিনে চেনা যায় না। সেভাবে রয়ে গেলে অনেক আগেই তা আড়ালে থেকে নিঃশেষ হয়ে যেত। শ্রদ্ধা আর অনুরাগ দিয়ে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম, একটি অবয়ব থেকে আরেকটি অবয়বে , নব নব রূপে চলছে তার স্বয়ম্বর অভিষেক। মানুষ তাই তাকে কন্ঠে ধরে রেখেছে আজ অবধি, যেন আনকোরা। সেই সাজানো যদি বিরামহীন হয়, তাহলে তাঁর গান হবে কালজয়ী। সেখানেই আমার রবীন্দ্রনাথ এর আশ্রয়।
আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ ? বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ। সেখানে তিনি শুধু কোন এক ব্যক্তি নন । একাত্তরে সেই চেতনার নবজন্ম । মৈত্রেয়ী দেবী, তাঁর একটি বইয়ের ভুমিকায় লিখেছেন, " বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ একজন প্রধান সৈনিক। এইরকম আমরা ভাবছিলাম । তখন শ্রদ্ধেয় শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন যে, তিনি প্রধান শহীদও, কারন যখন তাঁর বসত বাড়ীতে সৈন্যরা আক্রমন চালায় তখন কোন মানুষ নয়,দেওয়ালে টাঙ্গানো রবীন্দ্রনাথের ছবিটির বুকে তারা গুলি করে ও ছবিটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়" । ওপারে জন্ম হয়েছে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি র শীর্ষপদ এপারে। শিলাইদহ, পতিসর, শাজাদপুর। ভাইজি ইন্দিরা দেবী কে লেখা অসংখ্য চিঠিতে সে সবের প্রতি তাঁর ভালবাসা,তার রোমান্টিক নিসঙ্গতার ছবি, জানান দেয় কীভাবে এই পূর্ব বঙ্গের মানুষ আর প্রকৃতিকে তিনি একান্ত আপনার করে নিয়েছিলেন। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন টা জাগে, বাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ) এ যদি তাঁর জীবন না কাটতো, তাহলে আজকের এই রবীন্দ্রনাথ কি রকম হতো ? কি রকম দেখতে হতো তাঁর সৃষ্টির অবয়ব ? কারন, যত ফসল তিনি ঘরে তুলেছেন তার সিংহভাগ তো বাংলাদেশের পদ্মা পাড়ের । হয়তো পরিনতি শান্তিনিকেতনে । আরেকটি বিশেষত্ব, পাকিস্থানীদের নির্বাসন কে ঠেকাতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষ লড়েছিল । তাঁকে অর্জন করেছিল । জন্ম সুত্রে পাওয়া ধর্মের মতো তাৎপর্য হীন নয় তা । সেটাও অভিনব ওপারের কাছে । কারন বাংলাদেশে তিনি ব্যক্তির চেয়ে অধিক একটি প্রতীক। বাঙ্গালীর আত্ম পরিচয়ের এক অদৃশ্য অনুবাদ - পথ চলার সঙ্গী। কালে কালে সেই গ্রন্থি হয়েছে বন্ধনহীন । সেই ই আমাদের রবীন্দ্রনাথ ।