somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ । দুজন দু পথের পথিক । দুই বিশ্ব বিখ্যাত বাঙ্গালী মনীষা। একই জায়গায়, একই সময়ে তাঁদের বিচরন অথচ একান্ত ভাবে মিল হয়নি উভয়ের, কেউ কাউকে দিয়ে অনুপ্রাণিত হননি কোনদিন - এ এক বিরল এবং বিস্ময়কর ঘটনা । একসময় বিবেকানন্দ ব্রাহ্ম সমাজের সভায় যেতেন এবং সেখানে 'রবি বাবুর' লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত গাইতেন। তাঁর গানের গলা ছিল ভালো। উভয়ের দেখাদেখি হতো। কিন্তু সম্পর্ক গড়ে উঠেনি কস্মিন কালেও । ১৮৯৯ সালের ২৮ জানুয়ারি শনিবারের এক বিকেলে বসেছিল চা-পানের আসর। বিবেকানন্দ শিষ্যা নিবেদিতা (মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল) ঠিক করেছিলেন তাঁর বাগবাজারের বাড়িতে তিনি চা-পানের আমন্ত্রণ জানাবেন রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু এবং বিবেকানন্দকে। এর আগে বহু বার নরেন্দ্রনাথে(বিবেকানন্দ) র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছে। এমনকী রবীন্দ্রনাথের কাছে বসে গানও শিখেছেন তিনি। কিন্তু ঘটা করে আয়োজিত সেই চা-পানের আসরে বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথের কোনও কথাই হল না। দু’জন যে দু’জনকে চিনতেন সে কথাও প্রকাশ করলেন না কেউই। চা-পানের আসরে নিবেদিতার অনুরোধে গান শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে, শূন্য ঘাটে একলা আমি, পার করে লও খেয়ার নেয়ে’। কেন দু’জন একে অপরকে উপেক্ষা করলেন সেই প্রশ্ন নিরন্তর তাড়া করেছে অনুরাগীদের । ঠাকুরবাড়ী তথা রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিবেদিতার ছিল পক্ষপাত এবং সুসম্পর্ক । নিবেদিতার উদ্যোগ সত্ত্বেও বিবেকানন্দ ও ঠাকুরবাড়ির মধ্যে সম্পর্কের শীতল বরফ গলেনি। বরং আরও কঠোর হাতে নিবেদিতার রাশ টেনে ধরেছেন বিবেকানন্দ। নিবেদিতার স্মৃতি কথায় দেখা যায়, বিবেকানন্দ বলছেন As long as you go on mixing with that (Tagore) family Margaret, I must go on sounding this gong. Remember, that family has poured a flood of erotic venom over Bengal.” বলেছিলেন ‘নিবেদিতা, তুমি যত দিন ওই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা করবে তত দিন আমাকে বারবার সাবধান করে যেতে হবে। মনে রেখো, ওই পরিবার বাংলাদেশকে শৃঙ্গার রসের বন্যায় বিষাক্ত করছে।’ নিবেদিতা বললেন, ‘আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।’ তখনই বিবেকানন্দ ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতা শোনালেন। বললেন, ‘তোমার কি মনে হয় না এই কবিতা পুরোপুরি শৃঙ্গার রসে পরিপূর্ণ?’ কিন্তু যতই পরিনত রবীন্দ্রনাথ এগুতে থাকলেন 'মানুষের ধর্ম' র দিকে, অল্প বয়সে লেখা কড়ি ও কোমল কে অতিক্রম করে যে 'চিত্রা' য় লিখলেন ‘...ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির/মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শতাব্দীর/বেদনার করুণ কাহিনি, স্কন্ধে যত চাপে ভার’- সন্যাসী বিবেকানন্দ তার খবর রাখলেন না। জন্ম-মৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে ইশ্বরের অনন্ত রূপ অন্বেষণই তাঁর জীবনের ব্রত। রবীন্দ্র সাহিত্যের ক্রম বিবর্তন সম্পর্কে মনোযোগী থাকার মত অবসর বা ইচ্ছা কোনওটাই তখন বিবেকানন্দের ছিল না । পরিশেষে নিবেদিতা সে সম্পর্ক আর রাখেন নি। একবার তিনি জোসেফিন ম্যাকলয়েড কে লেখেন “So we are to give up …. After all, who are these Tagores?” (Letters of Sister Nivedita, vol-1) । রবীন্দ্রনাথ তাতে বিচলিত হননি । একবার তিনি নিবেদিতাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর মেয়েকে ইংরেজি শেখাতে, কিন্তু নিবেদিতা রাজি হননি। এমনকি বিবেকানন্দের আদেশে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্টার চেষ্টার সময় রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে জোড়াসাঁকোর একাংশ জমি দিতে চেয়েছিলেন । অনুমান করা যায়, তিনি বিষয়টি নিয়ে তাঁর ‘রাজা’র (এই নামেই তিনি মাঝে-মধ্যে স্বামীজিকে সম্বোধন করতেন) সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই প্রস্তাবটি তিনি গ্রহণ করতে অপারগ। বিবেকানন্দ ভারতবর্ষকে দেখতে চেয়েছিলেন আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে । তাঁর গন্তব্য ছিল হিন্দু ধর্ম কে বিশ্ব সভায় সুমহান ভাবে প্রতিষ্টিত করা। সব মতাদর্শ কে একটি কমন প্লাট ফর্মে আনতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। শিকাগো তে তিনি এ কথাই বলেছিলেন আমেরিকান দের। সকল ধর্ম এবং প্রবর্তকদের প্রতি ছিল তাঁর অকুন্ঠ সহমর্মিতা । রামকৃষ্ণ মিশন এবং বেদান্ত সমাজ তাঁর প্রতিষ্টা । অপরদিকে ঠাকুর বাড়ী ছিল ইহজাগতিক কর্মের সাথে নিবিড় । তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্ম - অদৃশ্য এক ইশ্বর এ ছিল তাঁদের আস্থা। কোন দেব দেবী কে আরাধনা ছিল তাতে বারন। রবীন্দ্রনাথেরও ছিল সেই একই পথ, যা আজও প্রতিষ্টিত শান্তি নিকেতনে । তারপরও বিবেকানন্দের মতাদর্শের প্রতি তাঁর বিরূপতার কোন নজির নেই । রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছিলেন 'যদি ভারত কে জানতে চাও, বিবেকানন্দ কে জানো, তাঁর মাঝে কোন নেতিবাচক নেই, সবই ইতিবাচক"। বিবেকানন্দে দেখা যায় বিপরীত। এই বিরূপতার সঠিক কারন কি শুধু মতাদর্শ গত বিভেদ, নাকি তাঁর দুশ্চিন্তা ছিল শিষ্যা নিবেদিতা কে নিয়ে, তা পরবর্তীতে অনেকের লেখায় ঊঠে এসেছে । প্যারিস থেকে নিবেদিতাকে লেখা একটি চিঠির কথা উল্লেখিত হয়েছে যেখানে গুরু লিখেন , ‘......নিবেদিতা, তুমি যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ তাদের সম্বন্ধে আমার কোনও ঈর্ষা নেই। আমার শুধু ভয় তোমার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মেশার ফলে তোমার মন যে দিকে ঝুঁকবে, তুমি অন্যের ভিতর জোর করে সেই ভাব দেবার চেষ্টা করবে। আমি এই কারণেই সেই বিশেষ প্রভাব থেকে তোমাকে দূরে রাখতে চেয়েছি.......।’ রবীন্দ্রনাথের উপর এসব ক্রিয়ার কোন প্রতিক্রিয়ার ছাপ কোন দিন পড়তে দেখা যায়নি । ১৯০৪ সালে গুরু বিবেকানন্দের প্রয়ানের পর প্রকাশিত নিবেদিতার বই wave of Indian's life বইটির ভুমিকা লিখে দেন কবি । এটাও ইতিহাস যে, নোবেল পাবার আগে প্রি অক্যুপাইড(প্রাক ধারনা বদ্ধ) বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথ কে অচ্যুত করার চেষ্টায় ছিলেন এবং তাকে মেনে নিতে কুন্ঠিত ছিলেন । ১৯১৩ তে এই একমাত্র বাঙালি যখন নোবেল পান , তার এক দশক আগেই বিবেকানন্দ প্রয়াত। যদি তিনি সে সময় বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়ত দৃশ্যপট পাল্টে যেত । হয়তো বিবেকানন্দ অভিনন্দিত করতেন কবিকে। কবির লেখা তার প্রিয় গান "মহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপতি " গান টি হয়ত গেয়ে শুনাতেন বা শুনতে চাইতেন। তাঁদের দুজনের মাঝে সম্পর্ক হয়নি। কিন্তু এর মিথস্ক্রিয়া চোখ এড়িয়ে যাবার নয় । একজন জীবে দয়ার মাঝে প্রথাগত ইশ্বর কে পেয়েছিলেন, অন্যজন নতুন ইশ্বরের সন্ধানে 'মানুষের ধর্ম' প্রতিষ্টায় নিজেকে সমর্পণ করেন আমৃত্যু । দুজনেই স্ব স্ব জায়গায় ছিলেন অনড় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:৫৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×