জ্ঞান কী ? শুরুতেই এই প্রশ্ন । উত্তর টা সাদাসিদে । অবাক হবার, বিস্ময়ের অভিভুত হবার প্রত্যয় থেকে পরিত্রান পাবার নামই জ্ঞান । বিজ্ঞান, বিশেষ জ্ঞান । এই বিজ্ঞান টার কাজ ই হল, অতীন্দ্রিয় মহাজগতের অস্পষ্ট রহস্যের ডিমিষ্টিফাই বা তার আবরন উন্মোচন করা, তার বিমূর্ত কল্পনাকে তার আইডিয়া কে মূর্ত রূপ দেয়া । যতই আপনি এ পথে পরিনত হতে থাকবেন , আপনার জৈবিক, মানসিক আর সময় পঞ্জির বয়স যতই বাড়তে থাকবে ততই ক্ষীয়মান হতে থাকবে অবাক হবার প্রত্যয় । তার কারন আপনি অধিক জেনে ফেলেছেন, অধিক বোঝা হয়ে গেছে ইত্যবসরে। যদি চাইবেন যাত্রা বিরতি , তবে তাই হোক । এটাকে উল্টিয়ে দেখলে কেমন হয় ? কেমন হয় সেই জানার মর্মে করাঘাত করলে ? দেখা যাবে ,সত্যিকার অর্থে আপনি কিছুই জানেন না । আপনি কিছু ধার করা জ্ঞান নিয়ে অহং এ ভুগছেন । এক বারের জন্যেও ভাবেন নি যে , এটা অহংকার আর অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয় ।
সেক্ষেত্রে পুরুষরা বেশ বাড়া । আর নারী অনেক টা শিশুর মতো । অনেক বেশি শিশু ।
বিশ্ব বিখ্যাত কবি দার্শনিক খলিল(কহলিল) জিব্রানের বিখ্যাত মহাকাব্য ধর্মী গ্রন্থ 'দ্য প্রফেট' এ এক নারীকে জিজ্ঞাসা করতে দেখা যায়, তিনি বলছেন , " এবার বেদনার কথা বলুন " - গ্রন্থের উত্তম পুরুষ আল মোস্তফা প্রজ্ঞাবান তার উত্তরে বললেন,
'তোমার বেদনা সেই ভেঙ্গে যাওয়া খোসা
যা তোমার বোধির মাঝে ঘন সন্নিবিষ্ট,
এমনকি পাথুরে ফল - যা ভাঙ্গে, তার হৃদয়
সূর্যালোকে চোখ মেলে, সেভাবে তুমি
তোমার বেদনাকে ছোঁবে, এবং তুমি তোমার
হৃদয়কে বিস্ময়ের গভীরে ডুবিয়ে যেতে দেবে ।
প্রতিদিনের এই অলৌকিক তোমার প্রতিভাসে ,
তোমার আনন্দের চেয়ে তোমার বেদনা অপার নয় ;
.................................
তোমার বেদনা গুলো তুমি ই বেছে নিয়েছ নারী । যা তেঁতো
ঔষধির মতো, যা তোমার অন্তরগত সুন্দর , সারিয়ে তুলবে
পীড়িত আত্মা । তাই সেই সুন্দরে আস্থা রাখো হে, নীরবে
নিভৃতে পান করো সেই শুশ্রষার সোমরস ।' (স্বকৃত অনুবাদ)
এখানে আল মোস্তফা যেন বিস্মৃত, যে প্রশ্নটা এখানে নারীর , সেটা কিন্তু শুধু নারীর নয় - পুরুষের ও । কিন্তু তার ব্যবধান দুস্তর । দুই সত্যের মাঝখানে রয়েছে আলো আঁধারের ব্যবধান, যা শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে বিরাজমান এবং পুরুষের অগম্য । তা শুধু নারীর আপন অস্তিত্বের নীরব সহচর । জিবরানও নারীকে বলছেন , যে বেদনাকে অতিক্রম করে যাওয়া ই কাম্য, কারন তার গভীরে পুরুষের আধিপত্য । সত্য এটাও যে, বীজ তার মৃত্যুর ভিতর দিয়ে অঙ্কুরোদ্গম করে বিটপীর, তার ফুল ফল, তার সৌন্দর্য রাশীর । তাহলে সেই খোলসটা কী ? কবি তাঁর ক্রসিফিকেশন থেকে নিজেকে উদ্ধার করলেন - সেই খোলস তার প্রজ্ঞা, সকল সংস্কার, নিজেকে ধরে রাখার স্বনিরবাচিত মন্ত্র, তার অধিগত সমাজ আর সভ্যতা - তার সব টুকু মিলেই তৈরি আমাদের খোলস যার মাঝে নারী বন্দী।
গৌতম বুদ্ধ একজন পুরুষ - মহাকাশ্যপ, সারিপুত্র, মৌজ্ঞলায়ন - সবাই ছিলেন পুরুষ । একজন নারী কি তাঁদের একই চেতনায় অভিসিক্ত হতে পারতেন না । বুদ্ধের কথা নাহয় বাদই দিলাম । তাঁর শিষ্যদের ক্ষেত্রে , কি তা অসম্ভব ছিল । বুদ্ধ প্রথমে নারীকে প্রবজ্যা দিতে চাইলেন না । কেউ কেউ তাঁর অর্থ করলেন, নারী পুরুষেতর ।
অতএব তাকে পৌরুষ অর্জন করতে হবে । বুদ্ধ মনে করতেন পুরুষ হচ্ছে আড়াআড়ি অনেক পথ (ক্রস রোড ) এর মতো - যেখান থেকে যে কোন গন্তব্যে যাওয়া যায় - পরম আলোকে, নির্বাণে, মুক্তিতে ।
সর্বত্রই প্রশ্ন জাগ্রত হয়, নারী কি সেই একই পথের চিহ্ন ধারন করে না ? নারী কি শুধু অন্ধকার এভিন্যু, যেখানে মিউনিসিপাল করপোরেশন কোন বাতি লাগানো র ব্যবস্থা করে না ? যে অন্ধকার এভিন্যু ধরে কোথাও যাওয়া যায় না ? তাই বুঝি পুরুষ আলোকিত মহা রাজপথ এবং তাই নারীকে পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মাতে হবে এবং সে পর্যন্ত অপেক্ষা ? তারপর সেই শরীরের দিয়ে বিচ্ছুরিত হবে জ্ঞানের আলকচ্ছটা ?
আমরা বিস্মৃত হই , আমাদের নারী, পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি শিশু । পুরুষ হওয়া তাই তাদের সাজে না ।এই প্রপঞ্চই তাদের সৌন্দর্যের উৎস এবং অংশ । তাদের নির্মলতা, নিস্কলুষতা,অপাপবিদ্ধতা । পুরুষ কখনো নারীকে এগিয়ে ধরেনি, রাখেনি আলোয় তুলে ধরে । কিন্তু কেউ কেউ হাতে তুলে ধরেছে পদ্মটি, যেমন ধরেছিলেন মহাকারুনীক গৌতম বুদ্ধ । কিন্তু তিনি বলেছিলেন নারীকে - "তুমি প্রজ্ঞাবান হও , তুমি জানো " - থেরী গাথার নারীরা তার স্বাক্ষ্য বহন করে । বৈদিক ঋষি যাজ্ঞবল্কের দুই স্ত্রীর মাঝে কাত্যায়নী ছিলেন গৃহ পরায়না, সংসার ধর্মে নিপুনা - সন্তান ধারন, রন্ধন, পরিবেশন,স্বামী সন্তানের দেখভাল । আর মৈত্রেয়ী ছিলেন বহিরজগতের প্রতি অনুসন্দিতসু । তাঁর ছিল জ্ঞান পিপাসা এবং তিনি বলতে পেরেছিলেন ' যে নাহং নাঅম্রিতষ্যম, কিমহম তেন কুরযাম ?' - যার মাঝে অমৃতের স্বাদ গন্ধ নেই, তা দিয়ে আমি কী করব ? তার মানে পুরুষ আনেনি, নারী স্বত প্রবৃত্ত হয়েই এগিয়ে এসেছে , তার আপন আলোয় জগত কে দেখতে । কাত্যায়নী চাইলেই পারতেন, যেখানে যে মুহূর্তে মর্মরিত হবে তাঁর অনুপ্রেরনা, ঠিক সেই মুহূর্তেই, সেখানেই আদৃত সব কিছু ফেলে রেখে তাঁর অভীষ্টে যাত্রা করতে । সবার ক্ষেত্রে তা হয় না, তাই ই সত্য ।
আমরা বাস্তব জীবনে দেখি, পুরুষ যখন কোন কিছু শুনে, কোন বিশেষ বার্তা কোন তথ্য, কোন ভাবনার বিষয়,শিল্পের কথা , সঙ্গীতের কথা, যে কোন সুকুমার চিন্তার কথা - তখন অবলীলায় বলে বসে - আরে আমি এসব জানি, এটা নতুন কিছু নয় ইত্যাদি । এর প্রতিভাস কি ? এটা হল তার অহং, তার কঠিন খোলস। তা কঠিন শিলাস্তরের মতো, যা যা শতাব্দী কাল ধরে পুরু হতে হতে হয়ে উঠেছে দুর্ভেদ্য ।তাহলে তাকে কিভাবে বদলানো যায় ? কিভাবে একজন পুরুষ হয়ে উঠবে শিশুর মতো ? উত্তর এই যে - কঠিন অহং এর খোলস ভাঙলে পরে পুরুষ হয়ে উঠবে শিশুর মতো, হয়ে উঠবে নারীর মতো ধৈর্য সহ্য, অপ্রগল্ভ,চিন্তাশীল, দায়িত্বসচেতন এবং সর্বোপরি একজন ভালো শ্রোতা । তার চোখের চাহনী, মুখের অভিব্যক্তি বলে দেয় যে তিনি বিস্মিত, আনন্দিত , চিন্তিত এবং অনুপ্রাননায় ঋদ্ধ ।
জিব্রানের 'প্রফেট' এ নারীই একমাত্র সুন্দর বাস্তবোচিত প্রশ্নকর্তা, সকল আরাধ্য বিষয়ে তার প্রশ্ন - তার প্রনয়, পরিনয়, সংসার, শিশু, দুঃখ সুখ বেদনা । ঈশ্বরের অনুসন্ধানে প্রশ্ন নয়, নয় কোন দার্শনিক গুঢ় তত্ব কথা, আছে শুধু সম্যক জীবনের চিন্তা নিতান্তই সাদামাটা এবং প্রতিদিনের রৌদ্র জলে মোড়ানো ব্যঞ্জনাময় মহাকাব্য । কিন্তু উত্তরদাতা বিচার করছেন না, কে প্রশ্নকর্তা । তাঁর কাছে প্রশ্ন কর্তার চেয়ে যেন প্রশ্নটাই বড় । সেভাবেই তিনি প্রশ্ন কে সরলী করন করছেন, যেন রাম শ্যাম যে কেউ প্রশ্ন করেছেন। অথচ এটাই স্বতসিদ্ধ যে উত্তরটা নিবিড় হয় যখন প্রশ্ন কর্তার চোখে চোখ রাখা হয় ।
আচ্ছা এ সকল প্রশ্ন কেন শুধু নারীর মাঝেই অনুরণিত হয়, পুরুষের মাঝে কেন নয় ? এখানে উত্থিত এই মোটা দাগের প্রশ্ন । তার একটাই কারন, আর সেটা হল নারীই সকল দুর্ভোগের শিকার - দাসত্বের, অমর্যাদার ,আর্থিক দৈন্যতার এবং সর্বোপরি তার সন্তান ধারনের অন্তহীন ক্লান্তি । অন্য একটি জীবন কে ধারন করার জন্যে নিজের জীবন নিয়ে বাজি ধরা বার বার । শতাব্ধীর পর শতাব্ধী তার এই করুন বেদনার চালচিত্র। জঠরে বাড়ন্ত শিশু, তাকে খেতে দেয় না,তার খাদ্যে অরুচী, বমনেচ্ছা। একটি পুরনো জীবনকে একেবারে নিশেষ করে দিয়ে নিভৃত অন্ধকার থেকে আলোয় নেমে আসে পরিপূর্ণ জীবন । অথচ এই চক্রবুহ্য থেকে তার মুক্তি নেই । তার পুরুষ আবার তৈরি হয় পুনরায় গর্ভ সঞ্চারে, সন্তান প্রবিষ্টে । তাহলে নারী কি শুধু এটি মানব পাল তৈরির কারখানা শুধু ?
এমতাবস্থায় পুরুষের অবস্থান কি ? তার একটাই কথা ' আমি তোমায় ভালবাসি ' । আসলে কি তাই ? তা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই ধরিত্রী জন সংখ্যা ভারে নুয়ে পড়ত না । সেই 'ভালবাসা ' নিছক প্রপঞ্চ । মন ভোলানো । তাই বুঝে জ্ঞানী পুরুষ বসে থাকেনি । তারা ইনিয়ে বিনিয়ে উপস্থাপন করেছে, সন্তান ধারনেই নারী জীবনের পরিপূর্ণতা, তার সঞ্চিত অহংকার । কি মনোরম প্রতারনা ? কি অনবদ্য ছলনা ? অতএব নারীর কাছে 'ভালবাসা' একটি শূন্যতার নাম । নারী আক্ষরিক অর্থে যেন গবাদি পশু।
জিব্রানের আল মোস্তফা বলছেন 'এবং তুমি তোমার অন্তরের পরিপূর্ণতাকে হাত পেতে নাও । যেভাবে গ্রহন করো তোমার শষ্য ক্ষেত্রের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ষড় ঋতু - and you would accept the seasons of your heart, even you have always accepted the season, that pass over your field - সত্য, নির্মম সত্য । তুমি তোমার অন্তরের ধনকে যেভাবে বুকে তুলে নাও, সেভাবে মেনে নাও । মেনে নেবার মাঝে সুখ আছে, আছে শান্তি, আছে সমাধি । নেই ক্রোধ, নেই ভয়, নেই সংশয় - জানো যে তুমি, তুমি এসব অবলীলায় অতিক্রম করে যাবে । তবে নারীর বেদনার ঋতুর কোন অদল বদল নেই, তা সে অতিক্রম করতে পারে না কোন কালে । তার নেই গ্রীস্ম, নেই বর্ষা, বসন্ত । নেই পুস্প সমারোহ, নেই বৃষ্টি ধারা, নেই বৈশাখী প্রলয় মাতন ।এই এক একটি জীবন এই গোলার্ধের নারীর।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, নারী কি গ্রহনে ধারনে সমৃদ্ধ হবে, নাকি বিদ্রোহ করবে ? বলে উঠবে 'না' ? এই বেদনা তো তৈরি অপরের হাতে, সেটা গ্রহন করে তৃপ্তি কোথায়? অতএব বিদ্রোহ চাই, চাই অস্বীকার আর সাথে অঙ্গীকার - নতুন জীবনের সাথে একীভুত হবার ,নতুন জন্মের কাছে নিজেকে সঁপে দেবার । জিব্রান বলছেন - তোমার বিষাদের অশ্রু জলে তুমি সেই বেদনাকে প্রত্যক্ষ করবে, কেন - এ কেমন কথা ?যেটা আমরা বদলাতে পারি , তা কেন শুধু প্রত্যক্ষ করব বসে বসে ? যা প্রাকৃতিক, যা আমার হস্তক্ষেপের অধিগত নয়, তা আমি প্রত্যক্ষ করতে পারি । কিন্তু এ তো তা নয় ।
তাই নারী যতক্ষন অস্বীকারের অঙ্গীকারে দ্রবীভুত নয়, ততক্ষন তিনি প্রানবন্ত নন ।
"তোমার বেদনা গুলো তুমি ই বেছে নিয়েছ" - এটাই সত্য । তোমার দুর্ভোগ - যা তুমি বেছে নিয়েছ, তাকে ফেলে রেখে দাও । কোন প্রত্যক্ষ নয়, তোমার সম্যক দৃষ্টি দিয়ে বোঝো, কী তুমি বেছে নিয়েছ তোমার নিজের পাথেয় হিসেবে । অতএব ছুঁড়ে ফেল, তা যদি তোমাকে অহরহ পেহনে টেনে ধরে রাখে । অন্যরা দেখুক সেই ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্য, অনুপ্রাণিত হোক ।
তোমার হিংসা, তোমার লোভ,রাগ, অনুরাগ - সবটাই তোমার বেদনার আড়ম্বর , যা তুমি বেছে নিয়েছ ।
অতএব হে সুশীলা সেই তেঁতো ঔষধ , নীরবে নিভৃতে পান করো, পান করো তার শুশ্রষার সোমরস । মনে রেখ প্রকৃতি ই তোমার জীবদাত্রী, তোমার চিকিৎসক । কৃতজ্ঞতার সাথে তার আশীর্বাদ গ্রহন কর। দুহাত ভরে তুলে নাও তার বরাভয়, যে তোমাকে নিয়ে যাবে চেতনার বহুলায়তনে ।
##########