বি ডি নিউজে মতামত বিশ্লেষণে রামপাল অভিযোগ নামা শিরনামে চার পর্বের যে ধারাবাহিক লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে তার শেষ পর্বে, আমার লেখা বিদ্যুৎ প্রকল্প: রামপাল ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি” শিরোনাম প্রথম আলো তে প্রকাশিত লেখার সমালোচনা করা হয়েছে। রামপাল অভিযোগ নামা শিরোনামের লেখক দ্বয়ের লেখার সাথে যারা পরিচিত, তাঁরা দেখেছেন যে উনারা লেখায় শ্লেষ, বিদ্রুপ, উদ্ধত, জাজমেন্টাল মন্তব্য লিখে আসছেন। আমার লেখাটির সমালোচনা করতে গিয়ে উনারা সব কিছুর প্রয়োগ করেছেন। যেমন প্রথমেই লেখাটি পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে লিখেছেন, “প্রথম আলো নামের পত্রিকাকে আলোকিত করা একটিভয়ংকর লেখার ব্যাপারে”। বিদ্রুপ, শ্লেষকে পাশে রেখে আসুন আমরা দেখি সমালোচনা গুলো কোথায় কোথায় করা হয়েছে?
লেখাটা সম্পর্কে বলেছেন, “লেখাটা আর কিছুই নয়, এ বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অ্যালায়েন্স(HEAL) নামক একটি প্রোপাগান্ডানির্ভর NGO-র বস্তাপচা ডেটা সম্বলিত একটি রিপোর্টের সারমর্ম। “ দুর্ভাগ্য, উনারাই লেখাটা ভাল করে পড়েই দেখেননি। পাঠককে আবারো লেখাটা পড়তে অনুরোধ জানাই। লিঙ্কঃ Click This Link লেখাটিতে বলা হয়েছে, বিপুল আয়তন ই আই এ রিপোর্টে জনস্বাস্থ্য বিষয়টা গুরুত্ব পায়নি। লেখাটির প্রথম দিকে ই আই এ তে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কোথায় কী বলা আছে সেটা দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে এটা অপর্যাপ্ত মূল্যায়ন। কেন অপর্যাপ্ত মূল্যায়ন সেটা বোঝানর জন্য কয়লা পোড়ানোর ফলে যে মুল দূষক গুলো উৎপন্ন হয়, সেগুলোর স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখানো হয়েছে, দেখানো হয়েছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ইউরোপের ২৭ টি দেশে পরিচালিত জরিপে যে স্বাস্থ্য অভিঘাত তৈরি হয়েছে তার ফল। এই ফলাফলটা HEAL প্রথম প্রকাশ করে, যা প্রথম আলোর লেখায় উপযুক্ত রেফারেন্স দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরে লেখাটিতে আফ্রিকার একটা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ই আই এর রেফারেন্স দিয়ে দেখানো হয়েছে এই জনস্বাস্থ্য ইস্যুটিকে কীভাবে তাঁরা অ্যাড্রেস করেছে। এবং লেখার শেষে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে এই প্রস্তাবিত কয়লা প্রকল্পের কারণে অস্বাভাবিক স্বাস্থ্য খরচ রাষ্ট্রের উপর চেপে বসবে কিনা?
আমার লেখার সমালোচকরা সম্ভবত “বস্তাপচা” ডেইটা বলতে ২৭ টি দেশে পরিচালিত জরিপের কথা বুঝিয়েছেন। উনার অভিযোগ যদি সত্যও হয় HEAL এর ডেইটা যদি বস্তাপচা ও হয়, যদি ইউরোপের ২৭ টি দেশে কোন জরিপ নাও হয়ে থাকে তবে প্রথম আলোর লেখাটির অন্য অংশ গুলো খারিজ হয়ে যায়না। আচ্ছা এবার আসুন HEAL এ প্রকাশিত ডেইটার গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে উনাদের অভিযোগের প্রসঙ্গে। উনারা অবশ্য “প্রোপাগান্ডানির্ভর NGO-র বস্তাপচা ডেটা সম্বলিতকথাগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রোপ্যাগান্ডা কেন বলেছেন? বলেছেন কারণ, উনাদের ধারণা এইসব এন জি ও গুলি ভয় দেখিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে টাকা বা ফান্ড জোগাড় করে। উনারা অবশ্য প্রোপ্যাগান্ডার নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন। আসলে প্রোপ্যাগান্ডা হতে হলে মিস লিডিং এবং বায়াসড তথ্য দিতে হয়। যেই মিস লিডিং এবং বায়াসড তথ্য উনার লেখায় অসংখ্য ব্যবহার আছে। যেমন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কত দূরে হওয়া উচিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সে সংক্রান্ত অসত্য লিঙ্ক। সুন্দরবনকে ‘আবাসিক ও গ্রাম্য’ এলাকা দেখানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর কে উল্লেখ করে শহর/আবাসিক/গ্রাম্য এলাকাভিত্তিক কোনো Classification নেই বলে দাবী করা। ছাই দিয়ে ১৪১৪ একর জমি ভরাট প্রসঙ্গে অসত্য তথ্য দেয়া। একজন লেখকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম HEAL এ প্রকাশিত জরিপে কোথায় WHO-এর ২০০৬-সালের ডেটা ২০১৩-তে ব্যবহার করা হয়েছে? তিনি উত্তর দেননি, বরং ব্লগে আমার প্রথম আলোতে লেখা নিবন্ধের সমালোচনা প্রকাশ করবেন বলে জানিয়েছেন। কৌতূহল উদ্দীপক হচ্ছে, WHO-এর ২০০৬-সালের ডেটা ২০১৩-তে ব্যবহার করা হয়েছে বলে উনারা আমার পুরো নিবন্ধকেই বাতিল করে দিতে চাচ্ছেন কিন্তু রামপাল ই আই এ রিপোর্টে পশুর নদীর পানি প্রবাহের হিসাব করার সময় ২০০৫ সালের ডেইটা ব্যবহারে উনাদের কোন আপত্তি নাই।
উনারা দাবী করেছেন, “ HEAL-এর লেখা থেকে জনমনে আতঙ্ক উৎপাদনকারী কতিপয় অনুমান ও মন্তব্যকে কাট-পেস্ট বা ভাবানুবাদ করে লেখক লোখাটা সাজিয়েছেন।“ উনারা কিন্তু নির্দিষ্ট করে বললেন না কোনটা অনুমান? লেখায় একটি মাত্র বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে, লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক পল উইকিন্সনের যিনি জন স্বাস্থ্য বিষয়ে পৃথিবীতে একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি। উনার মন্তব্য ও যদি ফেলনা হয় তবে আর কার মন্তব্য উনারা গ্রহন করবেন? নাকি উনার মন্তব্য কয়লা পোড়ানোর বিরুদ্ধে গেছে জন্য উনাকে এতো অপছন্দ? উনারা কি বলতে চান, পার্টিকুলেট পদার্থের স্বাস্থ্য ঝুঁকির ডেইটা অনুমান? উনারা কী বলতে চান, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের স্বাস্থ্য ঝুঁকির তথ্য অসত্য? উনারা কি বলতে চান ডায়ক্সিনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে বাড়িয়ে বলা হয়েছে? উনারা কি বলতে চান গর্ভস্থ শিশুর উপর সিসার কনো প্রভাব নেই?
উনারা দাবী করেছেন, আমার লেখার তথ্য গুলো ১) নিরপেক্ষ কোনো সূত্র দ্বারা সমর্থিত নয়, ২) সাধারণভাবে সুনির্দিষ্টও নয়। উনাদের যদি HEAL এর ২৭ টি দেশের জরিপের রিপোর্ট নিরপেক্ষ মনে না হওয়ায় নাকচ ও করে দেন তবে বাকি তথ্য গুলোতো এনভারনমেন্টাল টক্সিকলজির অসংখ্য টেক্সট বইয়ে আছে? সেটাও উনাদের কাছে নিরপেক্ষ মনে হল না? সুনির্দিষ্ট মনে হল না? উনাদের জন্য বারটান্ড রাসেলের একটা উক্তি প্রণিধানযোগ্য, তিনি সুনির্দিষ্ট তা সম্পর্কে বলেছেন, "All exact science is dominated by the idea of approximation. When a man tells you that he knows the exact truth about anything, you are safe in infering that he is an inexact man."
তাহলে উনাদের কাছে নিরপেক্ষ কোনটা? উনারা অবশ্য উনাদের মতে নিরপেক্ষ পক্ষের কথা বলেছেন। উনারা বলেছেন, “HEAL-এর ওই রিপোর্ট বের হবার পর
European Association of Coal and Lignite (EURACOAL)
European Aকঠোর ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করে Position Paper প্রকাশ করে। সেখানে তারা যাচ্ছেতাইভাবেHEAL-এর দাবি ও অপব্যাখ্যামূলক অবস্থানের ব্যাপারটি তুলে ধরে নিন্দা জানায় এবং কোনো রকম পাবলিক রেসপন্সে অসম্মতি জ্ঞাপন করে।“
HEAL এর রিপোর্ট ছিল কয়লা পোড়ানোর বিপদ সম্পর্কে জানানো। উনারা কী আশা করেন কয়লা ব্যবসায়ীদের সংগঠন European Association of Coal and Lignite European Association of Coal and Lignite (EURACOAL) এই পেটে লাথি মারা রিপোর্টকে টুপি খোলা অভিবাদন জানাবেন? আর Europea"ইউরোকল"AsEuropean AssociationEuropean Associউনাদের কাছে নিরপেক্ষতার প্রতীক হয়ে গেলো? শুটকির বাজারে কি উনারা বিড়াল চৌকিদার চান? "ইউরোকল" কয়লা ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান EURACOALযারা কিনা "হিলHE"ALএর রিপোর্ট সম্পর্কে কোন পাবলিক রেসপন্স করতে অস্বীকার করেছিল, তাদের পজিশন পেপারের নিন্দা কিন্তু প্রতিবাদ হীন ছিল না। সেই প্রতিবাদ অবশ্য উনাদের ভাষায় মায়াকান্না। উনারা লিখেছেন, “আরেকটা হাস্যকর তথ্য হল, "ইউরোকল" এর পজিশন পেপার পেয়ে এবং "হিল" কাঙ্খিত প্রচার না পেয়ে HEAL-এর মায়াকান্না। ইউরোকলEU Eএর কাছে পাঠানো হিলHEAL এর প্রতিবাদ লিপিটা উনারা হয়ত পড়েও দেখেননি। কারন সেই চিঠিতেই HEAL তাঁর ডেইটার সাইন্টিফিক ভ্যালিডিটির ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং প্রয়োজনে রিপোর্টের কন্টেন্টের বিষয়ে গন বিতর্কে অংশ নেয়ার ইচ্ছা জানিয়েছে।
পৃথিবীর সব দেশেই প্রকৃতি আর প্রাণ বিনাশী সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে অ্যাক্টিভিস্টরা দাঁড়ান। তাঁদের সামর্থ্য, ভালবাসা আর কমিটমেন্টের সবটুকু দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এর বিপরীতে লুটেরাদের পক্ষে কিছু বিশেষজ্ঞ দাঁড়ান, সেই বিশেষজ্ঞদের পাশে দাড়ায় শক্তিশালী মিডিয়া; যেন অ্যাকটিভিস্টদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়। তাই অ্যাক্টিভিস্টরা প্রচার পান না, কিন্তু তাঁরা ইতিহাসের কাছে বীরের মর্যাদা পান। আর ভাড়াটে বিশেষজ্ঞরা পায় কলঙ্কের তিলক। শেষ বিচারে বিজয়ী হয় জনগনের পক্ষে দাঁড়ানো অ্যাকটিভিস্টরা, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।