কঠিন শব্দ ও বাক্যে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বন্ধুমহলে অনেক সাহসী কৌতুক করতেন। এ কৌতুক থেকে তার বাবা-মাও বাদ পড়ত না। এমনি একটি কৌতুক বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির মুখে দেখাও যায়, শোনাও যায়। দুই বন্ধু নিয়ে মাইকেল বাবার কাছে দাঁড়ালেন। বাবা তখন হুকো টানছিলেন। পুত্রকে দেখে বাবা বললেন, মধু! হুক্কাটা রেখে এসো। মধুসূদন হুক্কাটা বাবার কাছ থেকে নেওয়ার আগেই পাইপটা নিলেন। টানতে থাকলেন বেদম। অতঃপর হুক্কাকে টানতে টানতে বন্ধুসহ একসঙ্গে বেরিয়ে এলেন।
বন্ধুরা চোখ বড় বড় করে বললো, তুই তোর বাবার সামনে হুকো খাস?
মধুসূদন জমিদারি কায়দায় হেসে দিয়ে বললেন, পাগলের দল। হুক্কা কি রে! আমি যে মদ খাই তাও বাবা জানে।
দেশের রাজনীতিও চলছে ঐ রকম। কে কতটুকু দুর্নীতি করে, কে কতটুকু করেছে, কে গণবাহিনী, কে সন্ত্রাসী, কে হলমার্কের টাকা মেরে খায়, কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কোপায়, কারা কুরআন পোড়ায়, কারা মসজিদ দখল করতে বলে, কারা মাদরাসার সংখ্যা কমাতে চায়, কারা পাঠ্য বইয়ে ব্ল-ফিল্ম লেখে, আল্লাহ মাফ করুক কারা পাঠ্য বইয়ে সমান্তরাল করে দেবদেবীকে আল্লাহর সমান্তরাল দেখায়, কারা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দেয় আবার আল্লাহর নামে মনোনয়নপ্রার্থীর শপথ লেখায়, কারা জনগণকে ক্ষমতার উৎস মনে করে আবার আল্লাহ ক্ষমতার মালিক- এ কথা সংসদে দাঁড়িয়ে বলে, কার ছেলে কয়টা বিয়ে করেছে, হিন্দু নাকি খ্রিস্টান, ইহুদি নাকি মুসলমান- সবই মানুষ জানে।
কত টাকা সিঙ্গাপুরে আছে, কত টাকা ফেরত এসেছে, ভবিষ্যতে টাকা কত যাবে, কে কয়টা বাড়ি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর এবং মার্কিন মুলুকে ক্রয় ও ভাড়া করেছে, কার কার স্ত্রী-পুত্র, ছেলেমেয়ে ইতোমধ্যে সেসব বাড়িতে বসবাস শুরু করেছে এগুলো কারো অজানা কথা নয়।
কাকে কে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে, কার বিরুদ্ধে কে কী মামলা দিয়েছে, কে কয়জন দলীয় লোককে বিচারক ও জজ ম্যাজিস্ট্রেট বানিয়েছে, কে কতটুকু বিচারের মধ্যে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করছে, কিভাবে স্বৈরপন্থায় সংবিধান পরিবর্তিত হয়েছে, নির্বাচন কমিশন কার আজ্ঞাবাহক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোন সরকার কী আচরণ করেছে, কার আমলে কে বেশি মানুষকে নির্যাতন করেছে, কে কতজনকে মেরেছে, কে কয়টি গণমাধ্যম বন্ধ করেছে এবং কয়টি চালু করেছে, কার আমলে কতজন সাংবাদিক মরেছে, মার খেয়েছে- সবই এখন মানুষ জেনে গেছে। কেন দুই নেত্রী সমঝোতার বৈঠকে বসছেন না- এটা এখন রিকশাওয়ালাও জানে।
দ্রব্যমূল্যের অবস্থা কী, কাজের বুয়ারা ভালো বলতে পারে। দিনমজুর এবং সাধারণ মানুষ কী কষ্টে আছে, এর সবটাই দুই নেত্রী জানে। কেন ক্ষমতার লড়াই- এটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাওয়া যাবে।
বিদ্যুৎ সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়েছে; কিন্তু বিদ্যুতের বিল কতটা বেড়েছে- এটা প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেত্রী না জানলেও যারা বিল দেন তারা কিন্তু জানে।
১৯৯০ থেকে এদেশের মানুষ সরকার পতন এবং ক্ষমতাসীন হওয়ার সশস্ত্র নাটক দেখে আসছে। নাটকের নাম গণতন্ত্র। এখন মানুষ বলতে শুরু করেছে, দেশটা এখন দুই নেত্রীর। একজন সাবেক সচিব টক শো’তে বলছেন, দেশের দুইজন প্রধানমন্ত্রী রাখলেও ক্ষতি হবে না।
ব্যাপক এই জানাজানির মধ্যে স্বৈরাচার, আমের আচার, তেঁতুল এবং তেঁতুলের পাইকার, রাজাকার, মুরগির আড়ৎদার- সবই এখন একাকার। সেই বিজ্ঞাপনের মতো জনগণ অপেক্ষা করছে ঘুটা দেওয়ার। কিন্তু জনগণকে জনগণের সম্পদ ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতার ভাগাভাগিটা অনেকটা বানরের পিঠা ভাগের মতো এখন গল্প-কার্টুন এবং সংবাদের শিরোনাম। আমরা তার বাইরে নই।
সংকটাপন্ন দেশ। ভাবনা অস্থির মানুষ। এর মধ্যে জোট-মহাজোট। ছোট জোট। বড় জোট। নতুন জোট। পুরাতন জোট। ভাঙবে জোট। গড়বে জোট। এই জোটের আলোচনায় যে যা পারছে, তা-ই বলছে। যে যা করছে, সবই জনগণ দেখছে। এরা কে কী করবে, তাও জনগণ জানে।
বিষয়টি বাসি ভাত আর পান্তা ভাতের মতো। জনগণ পারছে না সরাসরি বিষয়গুলোর ফায়সালা করতে। সরকার এবং তার দল চাচ্ছে, জনগণ রাস্তায় নেমে বিশাল একটা কিছু করুক। তাহলেই তারা পথে আসবে। বিপরীতে জনগণ ভাবছে, তাদেরকে নামিয়ে কী লাভ হবে? যারা আসার জন্য ভাগিদার, তারা কি জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলন করে?
আন্দোলনকারীরা একের পর এক আহ্বান জানাচ্ছে, রেডিও-টেলিভিশন আর ফেইসবুকে। ওরা নিজেরা মাঠে নামে না, অথচ দেশের মানুষকে মাঠে নামতে বলে। আবার বিরোধী দল মাঠে নামতে দেয় না। আন্দোলনকারীদের অফিসের সামনে, অফিসগুলোর সামনে পুলিশ এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ায়, মনে হয় এরা নির্লজ্জের মতো গণতন্ত্রের জানাযা পড়ছে। এ যেন জানাযারই কাতার। পাঁচ জনের মিছিলেও এক শ’ জন পুলিশের হামলা হয়। দাঁড়ি-টুপি দেখলে তো কথা-ই নেই।
অপরদিকে ক্ষমতাসীন দল হেলিকপ্টার আর পরিবারের সন্তানদের রাজকীয় নিরাপত্তা দিয়ে বিরোধী দলকে গালাগালির ব্যবস্থা করেছে। সাথে চাচ্ছে ভোট। লক্ষ্য একটাই, লুট আর লুট। লেখাটি হতাশাবাদীদের মতো অনেকের কাছে মনে হলেও, দেশের আজকের বাস্তবতা এটাই। এ থেকে মুক্তি পাবার যে পথটি খোলা আছে, সরকারি দল যদি সে পথটি প্রত্যাশা করে তাহলে দেশের কী যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা তারা কল্পনা করতে পারবে না।
ক্ষমতার মোহে যা করছেন, যতই চেষ্টা করেন, ২৪ জানুয়ারির পর তাদের সৃষ্ট সংবিধানই তাদেরকে বলে দেবে ‘গুডবাই’। তখন কে কত দ্রুত পালাবার উদ্যোগ নেবে- সেটাই ভাববার বিষয়।
গ্রাম্য প্রবাদ হলো, ‘আমারে রাগাইস না, রাগাইলে পরে কান্দনেরও সময় পাইবি না, সময় পাইবি না মাফ চাইবার।’
- See more at: Click This Link