কুরআন এ কি আছে?
আমাদের অধিকাংশরই ধারণা, কুরআনে খুব কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যা বোঝার যোগ্যতা আমার নেই। তা শুধু আলেম এবং আরবী ভাষায় পারদর্শী ব্যক্তিরাই বুঝতে পারবে। ঠিক এই ভাবনা থেকে আমরা যারা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তারা কুরআন থেকে দূরে থাকি। কিন্তু কুরআন কি আদৌও সেরকম রাশভারী কথা দিয়ে ভরা নাকি সাধারণ বিষয়ও এর মাঝে বিদ্যমান। সে কথা কি আমরা জানি?
হয়তো জানি কিংবা যতোটা জানা প্রয়োজন ছিল আমরা ততোটুকু জানি না। আমাদের বাংলাদেশিদের মধ্যে যে হালহাকিকত তাতে ধরে নিতে হবে আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি না, কুরআনে তাওহীদ এবং আল্লাহর একত্ববাদ ছাড়া আমাদের জন্য আর কি কি বলা আছে! আমাদের জীবনের জন্য কি বলা আছে? আমাদের দৈনন্দিন পথ চলার জন্য কি বলা আছে? আদৌও কি কুরআন এসব নিয়ে কিছু বলেছে।
আল্লাহপাক তাঁর পবিত্র কালামে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কাছে এমন একটি কিতাব নাজিল করেছি, যাতে তোমাদের কথা আছে, অথচ তোমরা তা চিন্তা ভাবনা কর না।’ (সূরা আম্বিয়াঃ ১০)
আল্লাহপাক এই আয়াতের মাধ্যমে মানুষকে বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য একটি বই পাঠিয়েছি। সেই বইটিতে তোমাদের কথাই বলেছি। অথচ তোমরা তা পড়তেছো না। বুঝার চেষ্টাও করছো না। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করা উচিত। আসুন দেখি আল্লাহপাক আমাদের জন্য কি কি পাঠিয়েছেন!
আল্লাহপাক মানুষকে সভ্য হবার শিক্ষা দিয়েছেন। সভ্যতা বিকশিত হয় ভাষার মাধ্যমে। একে অপরের মধ্যে কথা বলার মাধ্যমে। কিন্তু আমরা কথা বলব কিভাবে? আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে এই কথা বলারও পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন। তাহলে লক্ষ্য করুন-
* মানুষের সাথে কথা বলার সময় ভদ্র, মার্জিতভাবে উত্তম কথা বলবে। | ২:৮৩ |
* সত্য কথা বলবে। ভনিতা না করে, ধোঁকা না দিয়ে, স্পষ্ট করে বলবে। | ৩৩:৭০|
* চিৎকার করবে না। কর্কশভাবে কথা বলবে না, নম্রভাবে নিঁচু সুরে কথা বলবে। | ৩১:১৯ |
* সত্যি মনোভাবটা মুখে প্রকাশ করবে। মনে এক, মুখে উল্টো কথা বলবে না। | ৩:১৬৭ |
* ফালতু কথা বলবে না এবং অন্যের ফালতু কথা শুনবে না। | ২৩:৩ |
* কাউকে নিয়ে উপহাস টিটকারী ব্যঙ্গ করবে না। | ৪৯:১১ |
* অন্যকে নিন্দা করবে না কারো মানহানি করবে না। | ৪৯:১১ |
* কাউকে বাজে নামে ডাকবে না। | ৪৯:১১ |
* কারও অনুপস্থিতে তার নামে বাজে কথা বলবে না। | ৪৯:১২ |
* মানুষকে বিচক্ষণভাবে, মার্জিত কথা বলে আল্লাহর পথে ডাকবে। তাদের সাথে অত্যন্ত ভদ্র, শালীনভাবে যুক্তি-তর্ক করবে। | ১৬:১২৫ |
* মিথ্যা কথা বলবে না। | ২২:৩০ |
* যদি কোন ব্যাপারে তোমার সঠিক জ্ঞান না থাকে, তাহলে সে ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখো। তোমার মনে হতে পারে, এসব সামান্য ব্যাপারে সঠিকভাবে না জেনে কথা বললে অত সমস্যা নেই, কিন্তু তুমি জানো না, সেটা হয়তো আল্লাহর কাছে কোন ভয়ংকর ব্যাপার। | ২৪: ১৪-১৬ |
এরপর আসি ভদ্রতা নিয়ে। লোকে বলে ব্যবহারই বংশের পরিচয়। ভদ্রতার সাথে সেই ব্যবহারের সম্পর্কটা রক্তের সম্পর্কের ন্যায় জোরালো। তাহলে আসুন দেখি কুরআন আমাদেরকে ভদ্রতার শিক্ষা কিভাবে প্রদান করছে। লক্ষ্য করুন-
* মার্জিত পোশাক পরবে। | ৭:২৬ |
* প্রয়োজনের বেশি খাবার খাবে না, পান করবে না। | ৭:৩১ |
* নিজেই নিজের গুন জাহির করে অন্যের কাছে ভালো সাজার চেষ্টা করবে না। | ৫৩:৩২ |
* কারও সাথে ফুটানি করবে না, নিজেকে নিয়ে গর্ব করবে না। | ৩১:১৮ |
* দেমাগ দেখিয়ে চলাফেরা করবে না। | ১৭:৩৭ |
* তাড়াহুড়ো করবে না, খুব ধীরতাও নয়; মধ্যম স্বাভাবিক গতিতে চলাফেরা করবে। | ৩১:১৯ |
* বিনয়ের সাথে চলাফেরা করবে। | ২৫:৬৩ |
* বেশি অনুমান করবে না, কিছু অনুমান আছে যেটা করা গুনাহ। আন্দাজে ঢিল মারবে না। একে অন্যরে উপর গুপ্তচরগিরি করবে না। |৪৯:১২ |
* কারও অনুমতি ছাড়া তার ঘরে কখনো ঢুকে পড়বে না। | ২৪: ২৭ |
* কারও সাথে দেখা হলে তাকে সুন্দরভাবে সম্ভাষন জানাবে, সালাম দিবে। কেউ তোমাকে সম্ভাষন জানালে তাকে তার চেয়েও ভালোভাবে উত্তর দিবে। নতুবা অন্তত সে যেভাবে জানিয়েছে সেভাবে জানাবে। | ৪:৮৬ |
* অজ্ঞ, বর্বর, বিপথগামী লোকজন অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, খামোখা যুক্তি তর্ক করতে গেলে তাদের সালাম/শান্তি বলে সরে যাবে। | ২৫:৬৩ |
* আল্লাহ যাদের বেশি দিয়েছেন তাদের হিংসা করবে না। | ৪:৫৪ |
নৈতিকতা মানুষের সবচেয়ে বড়গুন। নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষকেই বাস্তবিক অর্থে মানুষ বলা হয়ে থাকে। আসুন দেখি কুরআন কিভাবে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করছে। তাহলে লক্ষ্য করুন-
* সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঘোলা করবে না এবং জেনে-শুনে সত্য গোপন করবে না। | ২:৪২ |
* নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে আগে ঠিক করো। | ৬৬:৬ |
* কারও কোন উপকার করলে তা তাকে মনে করিয়ে কষ্ট দিবে না। | ২:২৬২ |
* কারও কোন উপকার করলে তার বিনিময়ে তার কাছ থেকে কোন উপকার, এমনকি ধন্যবাদও আশা করবে না। | ৭৬:৯ |
* কাউকে কথা দিল অবশ্যই কথা রাখবে। তোমার প্রত্যেকটা অঙ্গিকারের ব্যাপারে তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে। | ১৭: ৩৪ |
* যারা ভালো কাজ করছে তাদের ভালো কাজে সাহায্য করবে, উৎসাহ দিবে, তাদের সাথে ভালো কাজে যোগ দিবে। খারাপ কাজে কাউকে কোন ধরনের সাহায্য করবে না। | ৫:২ |
* যারা ফাজলামি, ছ্যাবলামি করে তাদের কাছ থেকে নিজের সম্মান বজায় থাকতে সরে যাবে। | ২৫:৭২ |
* নোংরামি অশ্লীল কাজের ধারে কাছেও যাবে না, সেটা গোপনে হোক আর প্রকাশ্যে। | ৬:১৫১ |
* বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দৃষ্টি নত রাখো। কাম দৃষ্টি নিয়ে তাকাবে না। এক পলকের জন্যও না। | ২৪:৩০, ২৪:৩১ |
* কারও সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনলে তার সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখো, যতক্ষন পর্যন্ত না তুমি তার সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাচ্ছো। অন্যদের নির্দোষ হিসেবে নিবে, যতক্ষন না তার দোষ প্রমানিত হয়। | ২৪:১২ |
* তোমার যা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই, তার অন্ধ অনুসরন করবে না; কারণ আল্লাহর আদালতে তোমার দৃষ্টি, শ্রবণ এবং হৃদয়- এই সবকিছুর বিচার করা হবে। | ১৭: ৩৬ |
* ঘুষ খাবে না, ঘুষ দিবে না। | ২: ১৮৮ |
* অন্যের টাকা পয়সা, সম্পত্তি জেনে শুনে দখল করবে না। | ২: ১৮৮ |
* জাতি-বর্ণ-ভাষা-যোগ্যতা ইত্যাদির বিভিন্নতা থাকা স্বত্বেও মানুষকে সম্মান করবে। | ১৭: ৭০ |
এবার আসি পারিবারিক এবং আত্নিয়তার সম্পর্ক নিয়ে। সামাজিক জীব হিসাবে আমরা পরিবার ছাড়া বাস করতে পারি না। আর পরিবার কেন্দ্রীক জীবন যাপনের কারণে আমাদের আত্নিয়তার সম্পর্কও গড়ে ওঠে। এই সম্পর্কগুলোকে কেন্দ্র করেও আল্লাহপাক কুরআনে কিছু কথা বলেছেন। তাহলে লক্ষ্য করুন-
* কথা বলার সময় কারও পক্ষপাতিত্ব করবে না, সেটা যদি নিকট আত্নিয় এর বিরুদ্ধেও হয়। | ৬: ১৫২ |
* বাবা-মার সব ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা নিবে। | ২: ৮৩ |
* বাবা- মার সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রাখবে, ভালো ব্যবহার করবে। | ৪: ৩৬ |
* কাছের আত্নিয়দের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখবে। | ২:৮৩ , ৪: ৩৬ |
* এতিম এবং অভাবী মানুষদের সাহায্য করবে। | ২: ৮৩ ' ৪: ৩৬ |
* বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক রাখবে। | ৪: ৩৬ |
* বিপদে পড়া পথিক-যাত্রীদের সাহায্য করবে। | ৪: ৩৬ |
* যারা তোমার অধীন বা দাস-দাসী তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করবে।
কুরআনকে পাঠানোর আসল কারণ আল্লাহপাক স্বয়ং নিজেই বলছেন এভাবে, ‘আমি তোমাকে (মুহাম্মাদ) কিতাবটি পাঠিয়েছি সবকিছু পরিষ্কার করে বর্ণনা করে; যারা আল্লাহর প্রতি অনুগত তাদের জন্য পথ প্রদর্শক, অনুগ্রহ ও সুসংবাদ হিসেবে।’ | ১৬: ৮৯ |
তাই আসুন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষনে আল্লাহর আদেশ মেনে চলার চেষ্টা করি। আর আল্লাহর আদেশগুলো স্মরণ রাখতে কুরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৪