৯৮-৯৯ সালের দিকে যখন কলেজে পড়তাম, তখন একবন্ধুকে দেখতাম, সে মাঝে মাঝে গল্প করতো বিভিন্ন কম্পুটার গেমস নিয়ে। তার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, সেই ভাইয়ের কম্পুটার ছিলো বাসায়। গল্প শুনতাম, আর ভাবতাম, কম্পুটার একটা স্বপ্নের মতো। এটা সবার কাছে থাকে না, শুধু মাঝে মাঝে অধিক ভাগ্যবান ২-১ জনের কাছে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিংএ এক বড়ভাই কম্পু নিয়ে গল্প করতো। বলতো, হলে কম্পুটার রেখে বাড়ী চলে আসছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কম্পু যদি চুরি হয়ে যায়? বলল, না, তেমন ভয় নাই।
সেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দেখলাম, হলে কম্পু সবার রুমে রুমে।আগে মনে করতাম, যারা কম্পুটার সায়েন্স পড়ে, তারাই কম্পু চালায়। কিন্তু হলে এসে আমার সেই ভুল ভাঙলো। মোটামোটি ৮০% ছেলের কাছেই কম্পু আছে। আর কম্পুতে তারা কি করতো?
সিনেমা দেখা, গান শুনা, এইসব, রাত জেগে হলের ল্যান নেটওয়ার্কে এনএফএস রেসিং গেম খেলা। এই হলো কম্পুর কাজ। বড়ভাইরা গেম খেলতো, আমি ভয়ে ভয়ে পাশে বসে দেখতাম (বড় বলতে একটু বেশি বড়, আমি একটা আদু ভাইদের রুমে ছিলাম।)
একদিন এক ভাইয়ের পাশে বসে কার রেসিং গেম দেখছি, ভাইকে একজন ডাকতে আসছে, ভাই তখন বললো, তুমি খেলবা? আমি রাজী হয়ে গেলাম।
সেই প্রথম আমার কোনো চালু কম্পুর মাউসে হাত দেওয়া। কার্সর এদিকে দেই, চলে যায় ঐ দিকে। তারপরও কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সে এক অন্য অনুভূতি।
আর একদিন রুমের অন্য এক বড়ভাই বললো, তোমার পিসি কি বাসায়? আমি অনেক লজ্জ্বাতে বললাম, আমার কোনো কম্পুটার নাই।
পাশের রুমে আমাদের ব্যাচের এক ছেলে ছিলো। সে এক দুপুরে বললো, আসো সিনেমা দেখি, রুমে বড়ভাই কম্পু চালু রেখে গেছে, সিনেমা দেখতে পারবো এই ফাকে। দেখতে দেখতে কম্পুর একসময় হ্যাং করলো। আমরা তো ভয়ে শেষ, কম্পু কি নষ্ট হয়ে গেল?। বোঁ করে একটা শব্দও করছে। আমরা ২ জনে কিছুই বুঝতে পারছি না কি হলো? পরে ২ অন্য ফ্লোরের আমাদের ব্যাচের কম্পুতে পড়া এক ছেলেকে ডেকে আনলাম, সে কি কি করলো, আর কম্পু ঠিক। অনেক দিন পরে বুঝলাম, সে টাস্ক ম্যানেজারে গিয়ে এপ্লিক্যাশনন ফোর্সড শাট ডাউন করেছিলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় সেমিস্টারে সি প্রোগ্রামিং ছিলো। অতএব আমার মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা কম্পু কিনার জন্য হালকা আবেদন জানালাম, পড়ালেখার জন্য একটা কম্পু দরকার। অনেক চেষ্টার পর একটা সেলেরণ ১.১১ গিগাহার্জ, ৪০ জিবির হার্ডডিস্ক, ১২৮ র্যামের একটা কম্পু কিনা হলো ২৭,০০০ টাকা দিয়ে।
আব্বা দিলো ১৫,০০০ টাকা, আমার কয়েক বছরের ঈদ উপলক্ষে পাওয়া সেলামী, আম্মা থেকে বাজারের টুপাইস হিসাবে জমানো, হাবি জাবি সব নিয়ে ৬ বছরের সঞ্চয় ১০,০০০ টাকা আর মেঝ ভাই দিলো ২০০০ টাকা।
কম্পু কিনে দিলো মেঝ ভাই। তখন কম্পুর কিছু বুঝতাম না, খালি বুঝতাম, হার্ডডিস্ক সবচেয়ে বড় হলো ৪০ জিবি। যতবড় হার্ডডিস্ক, ততবেশি জিনিস রাখা যায়, তাই একটাই দাবী, আমাকে যেন একটা ৪০ জিবির হার্ডডিস্ক ওয়ালা কম্পু কিনে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একাডেমিক কাজে কয়েকটা পাওয়ারপয়েন্ট রিপোর্ট, ২-১টা সি প্রোগ্রামিং, কিছু রিপোর্টের কাজে এবং শেষের দিকে চাকুরীর জন্য সিভি তৈরীর কাজে কম্পু ব্যবহার করা হলো। বেশি ব্যবহৃত হলো গান শুনা, সাদাকালো পুরোনা বাংলা সিনেমা দেখা, বাংলা নাটক দেখার কাজে।
হলে কম্পু রাখার বিপদও আছে, হঠাৎ করে হল ভ্যাকেন্ট করে দিলে সেই অনির্দিষ্টকালের জন্য কম্পু হলে ফেলে রাখা ভালো হবে না, তাই বাসায় নিয়ে যেতাম। পোটলা বেধেঁ মনিটরের বক্স, সিপিউর বক্স, ক্রিয়েটিভের ২:১ বক্স, নিজের কাপড়ের পোটলা সব নিয়ে যখন রাস্তায় নামতাম, তখন রাস্তায় কয়েকশত ছেলে মেয়ে, কিন্তু কোনো রিক্সা নাই, ভ্যান নাই, সিএনজি নাই, কি যে বিপদ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মনে হয় ৪বার কি ৫বার হল ভ্যাকেন্টের পাল্লায় পড়েছিলাম।
একবার ঢাকার ২ বন্ধুকে বললাম, আমাকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। সায়েদাবাদে গিয়ে টিকেট করার পর অপেক্ষা করছি, এমন সময় ২টা ষণ্ডা মার্কা কুলি এসে বললো, এইটাই আপনার বাস, আপনার কম্পু আমরা গাড়িতে তুলে দিচ্ছি। আমি বললাম, আমার সাহায্য লাগবে না, তারপরও তারা জোর করে আমার কম্পু গাড়িতে তুলে দিলো। দিয়ে ১০০ টাকা হুমকী দিয়ে কেড়ে নিলো।
বাস উঠার পর জানলাম, ওটা ৩.৩০ এর বাসা, আর আমার বাস ৪.০০টায়, পরের বাসে। তখন ঐ কুলিগুলোকে আর খুজে পেলাম না।
সেই কম্পু এখনো চলে, তবে আমি এখন ল্যাপটপ ব্যবহার করি। বাসায় এইচপির ল্যাপি আর অফিসে ডেলের ডেস্কটপ।
পোস্টখানা একটু বেশি বড় হয়ে গেছে, কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।