পরের সপ্তাহে প্রথম দিন অর্থাৎ সোমবারে বিদ্যালয়ে পৌঁছে শুনি একজন অভিভাবক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন । ধরে নেই যিনি অপেক্ষা করছেন তিনি আর কেউ নন, সৈকতেরই অভিভাবক হবেন। কারণ অন্য কাউকে ইতিমধ্যে কল করিনি। উল্লেখ্য পরের দিন থেকে অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকে বিদ্যালয়ে শর্ট টেস্ট বা ফাস্ট টার্ম পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল।আগে থেকেই সৈকতকে জানিয়েছিলাম অভিভাবক না আনলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া সম্ভব হবে না। যাইহোক হাজিরা খাতায় সই করে স্টাফরুমে প্রবেশ করে যতোটা দ্রুত সম্ভব হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে জায়গায় বসতেই দূরে দরজার দিকে দৃষ্টি চলে যায়। জিজ্ঞাসু চাহনিতে এক ভদ্রলোককে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে বুঝতে পারি উনিই সম্ভবত অপেক্ষমান ব্যক্তি হবেন। চোখাচোখি হতেই বাইরে বেরিয়ে আসি। দরজার আড়ালে সৈকতকে দেখে নিশ্চিত হই আমার অনুমান সঠিক। বাবার হাত ধরে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকবছর আগেও ভদ্রলোককে একবার দেখেছিলাম। আজ ওনার স্বাস্থ্য এতোটাই ভেঙে গেছে যে শুরুতে চিনতেই পারছিলাম না।মানতে কষ্ট হচ্ছিল সেবার ছেলের সাফল্যে দেখা করতে আসা সুঠামদেহী দীর্ঘাঙ্গি মানুষটি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এক্ষণে আমার সামনে হতশ্রী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।মুখ ভর্তি দেড় দু-সপ্তাহের কাঁচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উসকো-খুসকো চুল, শীর্ণকায় চেহারার মানুষটি ঘাড় বেঁকিয়ে অনেকটা গুলতির মতো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । সৈকত পরিচয় করিয়ে দিতেই ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে হাসি হাসি মুখে মাথাটা উঁচু করে দুহাত তুলে নমস্কার করে আবার মুখ নিচু করে রইলেন। আমিও পালটা নমস্কার করলাম। ওনার এমন অস্বস্তিতে দাঁড়াতে দেখে বুঝতে পারলাম উনি শুধু অসুস্থই নন গুরুতর অসুস্থ আর কি। তবে তা সত্ত্বেও মিষ্টি একটা হাসি মুখায়বের মধ্যে ছড়িয়ে আছে।যেন হাসি দিয়ে শারীরিক অসুস্থতাকে লুকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিষয়টি যে কারো নজরে পড়ারই কথা। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে ,
- আপনি কি অসুস্থ?
- আজ্ঞে আগে ছিলাম। কিন্তু এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছি।
অবাক হই! দাঁড়াতে পারছেন না,ছেলেকে আগলে কোনক্রমে ধরে সোজা হয়ে আছেন, সেই মানুষ বলে কিনা অনেকটাই সুস্থ। তাহলে উনি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন না জানি কি অবস্থায় কাটিয়েছেন।
দেখতে দেখতে বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আমার যেহেতু প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস থাকে কাজেই বারে বারে দৃষ্টি যাচ্ছিল হাত ঘরির দিকে। এমন সময়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য দেবুদা এসে জানালেন শিক্ষার্থী কম থাকায় কম্বাইন্ড ক্লাস হবে। আমার ক্লাসটি মার্জ হয়ে অন্য সেকশনে ঢুকে গেছে।ফলে আমাকে আপাতত ক্লাসে যেতে হবে না। দেবুদার এমন মুশকিল আসানে সৈকতের বাবার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য বাড়তি আরও কিছু সময় পেয়ে যাই।ফলে ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে সৈকতকে কম্বাইন্ড ক্লাসে যেতে নির্দেশ দিয়ে ওর বাবাকে পাশের ঘরে যেতে ইশারা করি। অসুস্থ মানুষ, সাহায্য করতে চাইলে অস্বীকার করেন সাহায্য নিতে। কিন্তু তড়িঘড়ি এমন ভাবে পা ফেলতে উদ্যত হলেন যে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিলেন। অপ্রত্যাশিত এমন ঘটনায় আমি প্রচন্ড ঘাবড়ে যাই।ফলে এবার আর ওনার সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করে একপ্রকার জোর করেই ওনার ডান হাতটা চেপে ধরে নিয়ে পাশের ফাঁকা ঘরে নিয়ে বসাই। মানুষটি আমার সামনে বসতে পর্যন্ত লজ্জা বোধ করছিলেন। যাইহোক মুখোমুখি বসতেই ভদ্রলোক বলতে লাগলেন,
- সৈকত গত সপ্তাহে বলেছিল বাবা, তোমাকে আমার ক্লাস টিচার ডেকেছেন একবার বিদ্যালয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা তখনো পর্যন্ত এতটাই খারাপ ছিল যে নিজের পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসার মত অবস্থায় ছিলাম না। বলছিলাম স্যার যদি খুব জোর করেন সেক্ষেত্রে না হয় দাদার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ওর সাহায্য নিয়ে যাবো। কিন্তু পরে আবার ও বেঁকে বসে।বললে,স্যারকে বলে ম্যানেজ করে নেব। তুমি চিন্তা করো না। আমি বলেছিলাম, তোকে তো ক্লাসে ঢুকতে দেবে না বলে জানিয়েছিস।ও ছেলে পাল্টা জানিয়েছিল,
- তুমি ভেবো না বাবা, আমি স্যারকে বলে কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নেব।আর তাছাড়া ওর কথাকে ফেলতে পারি নি; সেবার এসে স্বচক্ষে দেখেছিলাম আপনি ওকে কি অসম্ভব স্নেহ করেন।
আমি সৈকতের বাবাকে একটু থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করি,
-আমার সম্পর্কে আর কি কি জানিয়েছে?
- আপনি ভগবান মানুষ মাস্টারমশাই!বলে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে আরো একবার প্রণাম করলেন।
সামনাসামনি এমন স্তুতিতে আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ি। কিন্তু সেদিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ না করে উনি বলতে লাগলেন,
-একেতো জখন্য করে চুল কাটা। আপনারা মাস্টারমহাশয়রা শুধু নন, আমি বাবা হয়েও যখন প্রথম শুনি তখনই মানতে পারছিলাম না ওর এমনভাবে চুল কাটাতে।তার উপর প্রতিদিন ক্লাসে বসে ঘুমিয়ে পড়ে। পড়া বলতে পারে না।অথচ আপনারা সবকিছুই একপ্রকার মেনে নিয়ে ওকে ক্লাসে অনুমতি দিয়ে যাচ্ছেন। চেষ্টা করছেন যাতে ওকে আবার পড়াশোনার মধ্যে ফেরানো যায়।বাড়ি ফিরলে এই নিয়ে আমাদের বাবা ছেলের মধ্যে কতো কথা হতো। শাস্তির প্রসঙ্গ উঠলে বলতো যে খুবই সামান্য একটু আধটু ভোগ করলেও সেটা বলার মধ্যে ছিল না। অন্যান্য শিক্ষক মহাশয়দের নিয়েও কথা হতো। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কথা হতো আপনাকে নিয়ে।
সৈকতের বাবার কথা শুনে এবার আমি সত্যিই ভীষণ লজ্জায় পড়ি।ওর বাবা বলেন কি! আমি তো এতোটা সদয় আচরণ ওর প্রতি কখনোই করি নি। বুঝতেই পারছি বেশি বেশি করে শিক্ষকদের স্নেহপ্রবনতা বাবার কাছে তুলে ধরেছে। তবে তার মধ্যে অবাক হলাম বাবার অসুস্থতার কথা ও একবারের জন্যেও মুখে আনলো না কেন ভেবে। অথচ দিনের পর দিন নির্বিকার ভাবে শাস্তি মাথায় পেতে নিয়েছে। কোনো ভাবেই কিছু করতে না পেরে কথার চাবুকেও বিদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। আসলে তখন উদ্দেশ্য ছিল যেন তেন প্রকারে অভিভাবক হাজির করানো। কিন্তু এ ছেলে একবারের জন্যেও বলেনি যে বাবা অসুস্থ। আচ্ছা মানলাম বাবা অসুস্থ। কিন্তু মা তো আছেন,তিনিও তো আসতে পারতেন। কিন্তু বাবা মা কারোর ব্যপারে একটা কথাও বের করতে পারি নি।আর এসবের জন্যেই ওর প্রতি শেষের দিকে যথেষ্ট রূঢ় আচরণ করেছি। এমতাবস্থায় বাবার মুখে আমাদের ভালো আচরণের কথা শুনে খুশি হলেও অন্তরে এবার রীতিমতো আশঙ্কা তৈরি হয় আমাদের অসদাচরণের কথা বাবাকে বলেনি তো? হয়তো বললেও ভদ্রলোক ইচ্ছে করেই সেগুলো গোপন করে যাচ্ছেন।
কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে জিজ্ঞেস করি,
- আপনার অসুস্থতাটা ঠিক কী? কীভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন?
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
- ট্রলারে দুর্ঘটনা থেকে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,
- ট্রলার দুর্ঘটনা! কীভাবে ঘটলো?
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন,
- সমস্যার সূত্রপাত মাস ছয়েক আগে থেকেই।পেশায় আমি একজন মৎস্যজীবী। ছোট থেকেই বাড়ির পাশে গঙ্গায় মাছ ধরে বড় হয়েছি। কিন্তু এখানে তেমন মাছ ধরা পড়ে না যে তার উপরে জীবিকা নির্বাহ করা যায়। বিয়ের কয়েক বছর আগের ঘটনা। এক ঠিকাদারের মাধ্যমে পাড়ার অনেকের সঙ্গে আমিও পুরীতে গেছিলাম। ওখানে কাজ ছিল ট্রলারে করে সমুদ্রে মাছ ধরা। খুব আনন্দ হতো দলবেঁধে একসঙ্গে সমুদ্র যাত্রা করার সময়। অনেকগুলো ট্রলারে করে মৎস্যজীবীরা যাত্রা শুরু করতো।প্রায় দেড় দুই সপ্তাহ ধরে সমুদ্রে মাছ ধরে মোটামুটি নৌকার খোল পরিপূর্ণ হলে আবার আমরা উপকূলে ফিরে আসতাম। তীরে পৌঁছে মহাজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে ট্রেন ধরে সোজা বাড়ি। পরিবারের সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে আবার ফিরে যেতাম পুরীতে। তবে আমি অবশ্য সবসময় যে বাড়ি ফিরতাম তা নয়। যেহেতু তখন বিয়েশাদী করিনি। ফলে এমনো হয়েছে পরপর দুটি ট্রিপ করে বাড়ি ফিরেছি। বিয়েশাদী করার পর অবশ্য অন্নদা মানে সৈকতের মায়ের চাপে প্রতি ট্রিপ শেষে বাড়ি ফিরতাম।আর সৈকত জন্ম নেবার পর তো এমনিতেই মুখিয়ে থাকতাম কবে বাড়ি ফিরতে পারবো।সে যাইহোক ঘটনার দিন আমরা একটু আগেভাগেই মোহনায় চলে আসি। লক্ষ্য থাকতো কত আগেই ট্রলার খালি করা যায়। একদম ভোর বেলায় মোহনায় পৌঁছে যতোটা সুবিধা পাওয়া যায় বেলা বাড়লে অত্যধিক ভীড় হয়ে যেতো।ফলে কাজ করতে অসুবিধা হতো। পাশাপাশি মাছগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আড়োৎয়ে পৌঁছে দেওয়াও লক্ষ্য থাকতো। সেদিন আমরা অনেকটা ভোরবেলায় সবকাজ শেষ করে মোহনার একটু ভিতরে ট্রলারটি নোঙর করতে এগিয়ে যাই।সারেংয়ের নির্দেশমতো হাতে গ্রাফিন নিয়ে ট্রলারের সাইডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লক্ষ্য ছিল পছন্দমতো একটা জায়গায় ট্রলারটিকে নোঙর করা। আশপাশে তখন অন্যান্য মাছভর্তি ট্রলার গুলো রে রে করে মোহনার দিকে ছুটে আসতো। অনেকদিন পর একে অপরকে দেখে তারমধ্যে একটুআধটু হাসি ঠাট্টা হয়ে যেতো। সেদিন এরকমই একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেখেয়াল হয়ে যাই। এমতাবস্থায় অন্য একটা ট্রলার সজোরে ধাক্কা মারে আমাদের খালি ট্রলারটিকে। আমার হাতে গ্রাফিন ছিল ফলে টাল সামলাতে না পেরে তার উল্টোদিকে জলে গিয়ে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় ঢেউ আমাকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেয়।এর পরের ঘটনা আর আমার মনে নেই।
যখন জ্ঞান আসে, বুঝতে পারি আমি হসপিটালে আছি। গোটা শরীরেই যেন ব্যান্ডেজ করা সঙ্গে অসম্ভব ব্যথা। হাত পা মাথা কোনো কিছুই নাড়াতে পারছিলাম না। চারদিকে নানা রকমের পাইপ জোড়া। কোনোটাতে অক্সিজেন কোনটাতে বা স্যালাইন, আরও কতো রকমের পাইপ সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। এমনকি বেশ কয়েকদিন কথাও পর্যন্ত বলতে পারি নি ।কদিন যেতেই জানতে পারি শরীরের একাধিক জায়গা ভেঙে গেছে। ডান হাতের কব্জি সহ ডানপায়ের হাঁটুর নিচে অংশটা ভেঙে গেছে। সঙ্গে মেরুদণ্ডের হাড়েও চিড় ধরেছে। এসবের সঙ্গে সারা গায়ে ছিল অজস্র ক্ষতবিক্ষত।প্রথম তিন দিন নাকি আমার জ্ঞান ছিল না।খবর পেয়ে অন্নদা চলে আসে হসপিটালে।মহাজন খারাপ মানুষ ছিলেন না। আমার যাবতীয় চিকিৎসার পাশাপাশি ওর মায়ের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। কিন্তু মাসখানেক যেতেই উনি বেঁকে বসেন। জানিয়ে দেন যে ওনাকে যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ বহন করতে হচ্ছে তাই ওর মায়ের দায়িত্ব নিতে পারবেন না। খবরটা শুনে আবার দুশ্চিন্তায় পড়ি। অথচ সেসময়ে অন্নদা ছাড়া আমার এক মুহূর্ত চলছিল না। হসপিটালে চিকিৎসার সুযোগটুকু পেলেও আমার খাওয়া পড়া মাখা স্নান করানো বাথরুমে নিয়ে যাওয়া সবই কাজ একা হাতে ওই সামলাচ্ছিল।ফলে মহাজনের সিদ্ধান্তে গভীর সমস্যায় পড়ি।কি হবে কি হবে ভেবেই আরো কটা দিন পার হয়। এমতাবস্থায় কোনো উপায় না থাকায় আমাকে ফেলে রেখে অন্নদা বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। গরিবের হয় ঘোড়া রোগ।হাতে পয়সাকড়ি নেই অথচ রোগব্যাধির শেষ নেই। একাকী হসপিটালের বেডে শুয়ে এই সময়টা যে কি দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছিল তা কেবল উপরওয়ালাই জানেন। সপ্তাহখানেক পরে দেখি অন্নদা আবার হসপিটালে চলে এসেছে। মুখে চওড়া হাসি।ঐ প্রথম শুনি সৈকত কাজ করে মাকে টাকা পাঠানোর একটা ব্যবস্থা করেছে। সৈকত টাকা পাঠাবে! এইটুকু ছেলে কি কাজ করবে? কে দেবে ওকে কাজ? কাজেই এই বয়সে রোজকার করছে শুনে অবাক হয়ে মুষড়ে পড়ি। অথচ আমার যে কতো স্বপ্ন ছিল ওকে নিয়ে। একনাগাড়ে বলে ফেলি,এখনই রোজগারের রাস্তায় নামলে লেখাপড়া যে ওর চিরদিনের মত বন্ধ হয় যাবে? তাহলে আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে? না এখবরে আমি খুশি হতে পারিনি। অন্নদা আমার কপালে হাত রেখে কথা দিয়েছিল, না ওর লেখাপড়া বন্ধ হবে না। মায়ের কাছে নাকি সৈকত কথা দিয়েছে,শত অসুবিধার মধ্যেও লেখাপড়া ঠিক চালিয়ে যাবে।
সৈকত টাকা পাঠাতো? কি কাজ করতো ও?
প্রশ্ন করতেই,
কম্পিত গলায় ভদ্রলোক বলতে লাগলেন,
-ছোট মানুষ তেমন কোনো কাজ তো আর পারত না অথচ টাকার দরকার। এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল আমার এক ভাগ্না। কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে একটি হোটেলে কাজ করতো। লেখাপড়া কম জানায় কোনো ভালো কাজ জোটেনি।
কি কাজ করতো সৈকত? আমি আবার প্রশ্ন করি।
- মাস্টারমহাশয় বাবা হিসেবে ঠিক মুখে আনতে পারছি না।অথচ এই কাজটি যে আমাদের সংসারে কতটা উপকারে এসেছিল সে কথা বলে বোঝাতে পারবো না।
কলকাতা শহরে প্রচুর ছোটখাটো হোটেল রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে সন্ধ্যার পর বড়লোকের ছেলেরা তাদের মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করতে আসে। এরা নানা রকম খাবার-দাবারের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে মদ খায়। কখনো কখনো অত্যধিক বমি করে জায়গাটা ভীষণ নোংরা করে ফেলে। খাবারদাবারের নোংরা কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মদ খেয়ে বমি পরিষ্কার করতে হোটেলের ওয়েটাররা রাজি হতে চায়না।আর এখানেই মেলে কাজের সুযোগ আমার সৈকতের মতো গরিব অসহায় বাবা মায়ের সন্তানদের। বড়লোকের উচ্ছিষ্ট বমি যত পরিস্কার করবে ততোই টিপস মিলতো অভাবী সন্তানগুলোর।অন্য হোটেলে বা রেস্টুরেন্টে হলে ওয়েটাররা এই টিপসে ভাগ বসাতো। কিন্তু সৈকত আমার ভাগ্নার সঙ্গে থাকায় টিপসের সবটাই নিজে রাখতে পারতো। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছেলেগুলোকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হতো কখন কে কোথায় নোংরা করে বা বমি করে। প্রায়ই দিন রাতে ঘুমানোর সুযোগ এক আধ ঘণ্টার বেশি মিলতো না। ভোরবেলায় বাড়ি ফিরে আবার দুই ভাইবোনের জন্য রান্না করতে হতো। এরপরে বোনকে স্কুলে পাঠিয়ে তবেই নিজে স্কুলে যেত।যেদিন ঠিকমতো গুছিয়ে উঠতে পারতো না সেদিন আর ওর স্কুলে যাওয়া সম্ভব হতো না।আর স্কুলে গেলেও ঘুমিয়ে পড়তো। তবে বোনের ব্যাপারে প্রচন্ড সিরিয়াস ছিল। দাদা হিসেবে ওর পড়াশোনায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।দুই ভাইবোনের বয়সের ব্যবধান দুই বছর।অথচ দায়িত্বশীলতা বা কর্তব্য পালনে ও যেন বাবা হিসাবে আমাকেও হার মানিয়েছে।
কথা বলতে বলতে সৈকতের বাবার গলাটা ধরে এলো। শেষের দিকের কথাগুলো রীতিমতো আদ্র গলায় কোনোক্রমে শেষ করে অন্যদিকে ঘাড় বেঁকিয়ে রইলেন। সত্যিই তো এমন কাহিনী শ্রোতা হিসেবে যে কোন মানুষের হৃদয়কে সিক্ত করতেই পারে।আর যার জীবনের কথা তার পক্ষে অবিচল রাখা একপ্রকার অসম্ভব। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল উনাকে সান্ত্বনা দেই। কিন্তু পরক্ষণে প্রসারিত হাত আবার টেনে নিলাম। তাই তো কি বলেই বা আর সান্ত্বনা দিব। কাজেই ভারাক্রান্ত হয়ে বসে রইলাম। কিছু সময়ের মধ্যে উনি নিজেকে সামলে নিলেন। আবার বলতে লাগলেন,
-বমি পরিষ্কার করতে হয় সেটা না হয় কোনো কাজ ছোট নয় এই যুক্তিতে মেনে নিলাম। তাইবলে ভদ্রলোক কাস্টমারদের কাছে বিশেষ ম্যাথর হিসেবে চেনানোর জন্য কানের উপর থেকে মাথার দুদিকে চুল সম্পূর্ণ কামিয়ে দিয়ে ব্রহ্মতালুর উপর অংশে সজারুর কাটার মতো বিশেষ করে চুল কাটতে বাধ্য করা - এটাকে বাবা হিসাবে কীভাবে মেনে নিই বলুন দেখি। প্রথমবার ওরাই কেটে দিয়েছে।আর এভাবে চুল না কাটলে নাকি চাকরি থাকবে না। ভদ্র অভিজাত পরিবারের সদস্যরা যাতে একদৃষ্টিতে এমন ম্যাথরকে চিনতে পারেন তাই এমন নিয়ম নাকি।
এতক্ষন ধরে আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এক অভাবী অসহায় বাবার অসীম ধৈর্যশীল বিচক্ষণ সন্তানের মর্মন্তুদ কাহিনী শুনে চোখ দিয়ে নীরবে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। মনে মনে বললাম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই কখনো চোখে দেখিনি মাঝে মাঝে গল্প বা উপকথায় পড়েছি। কিন্তু আজ জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক কিশোর নাবিকের বিচক্ষণতার, তার অসীম ধৈর্যশীলতা, পারিবারিক মূল্যবোধের যে কাহিনী শুনলাম তা রুপালি পর্দার কাহিনীকেও হার মানাবে।
নাহা! তারপর থেকে আর কখনো আমি ওকে পড়াশোনার জন্য কোনোরকম চাপ সৃষ্টি করিনি। কোনোক্রমে অষ্টম শ্রেণী পাস করলেও নবম দশম শ্রেণীতে আর পাঁচ জন সাধারণ ছাত্রের মতোই ভীড়ের তলে তলিয়ে যায়। তারপর দীর্ঘদিন পর আজ এই শিমলার ম্যালে অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ লাভ।