রম্ভা থেকে উড়িষ্যার গোপালপুরে কলিঙ্গ হোটেলে উঠে দলের অন্যান্যদের মত আমারও মুড অফ হয়ে গেল । দলের প্রমিলা মহলের ক্রোধান্বিত রুপের কাছে সেটাকে ধরা না দিয়ে যথাসাধ্য আগামী দুদিন কিভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে বরং তাদের সঙ্গে শোকযাপন করতে লাগলাম । অথচ হোটেল বুকিং এর সময় রিভিউ তে ভালো- মন্দ উভয় ই দেখালেও বাস্তবে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও বদ্ধ হোটেলটিতে আপাতত কোনো ভালো গুণ আমাদের চোখে পড়ল না । কাউকে তাই হোটেলের রুমে ঢুকতে আগ্রহী দেখছি না । লাগেজ পত্র গুলিকে রুমের সামনে ডাই করিয়ে আমরা যথারীতি বসে পড়লাম সমুদ্রের ধারে খোলা বারান্দায় । ব্যালকনিতে বসে নিরস বদনে উত্তাল সমুদ্র ও মাঝে মাঝে বাকিদের মুখের প্রতিক্রিয়ায় অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন মনের এই দুর্যোগের অবসান ঘটে।
কবি জাহিদ অনিকের কথাই বলতে হয় আমি বাপু নিপাট ভদ্রলোক । ঝুট-ঝামেলা পছন্দ করিনা । শিয়ালদা স্টেশনে হাজার লোকের মধ্যেও খবরের কাগজ বিছিয়ে আমি ঘুমাতে পারি । কাজেই হোটেল কলিঙ্গের অপছন্দ কে প্রশ্রয় দিয়ে আমার ভ্রমণ আনন্দকে মাটি করতে আমি আগ্রহী নই । কিন্তু দলের অন্যান্য সফরসঙ্গীদের সূক্ষ্ম ভাবাবেগকে আঘাত না করতে আমার একটু গোমরা মুখো হয়ে বসে থাকা আরকি ।
দুপুরের মেনুটি আগে থেকে দুরাভাষ এ বলা ছিল । কাজেই মনের মধ্যে দাবানল যখন পাকস্থলীতে প্রসারিত হতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ডাইনিং টেবিলে খাবার মুখে দিয়ে বিদ্রোহী কয়েকজনের মুখে হাসি দেখে আমার মনের ক্যানভাসে হঠাৎ এক ঝলক উষ্ণ বাতাস বয়ে গেল । সে উষ্ণতার ঝলক দেখাতে গিয়ে হঠাৎ মনিরা আপুর কথা মনে পরল । অত্যন্ত কৃপণ হয়ে মুখে কোন শব্দ না করে রামগরুড়ের ছানা হয়ে মধ্যাহ্ন সারতে লাগলাম। খাওয়া শেষে অবশ্য আমরা যে যার রুমে চলে যাই । পূর্বে আপুকে কথা দেওয়া ছিল মোহময়ী ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখবো । কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে তেতো অভিজ্ঞতা হল তা যে কতটা প্রকাশযোগ্য সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায় ।
বিকেলে কলিঙ্গের খোলা বারান্দায় বসে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেল তার খেয়াল ছিল না । যখন সম্বিৎ ফিরলো , বাবাই আচমকা মাকে জড়িয়ে ধরতেই চারিদিকে অন্ধকার তার মধ্যে খোলা আকাশের নিচে নিজেদেরকে আবিষ্কার করলাম তখন বেশ রাত হয়ে গেছে ।
-মা তিতলির মত সমুদ্রের ঢেউ যদি এক্ষুনি আমাদের হোটেলটা কে উড়িয়ে নিয়ে যায় , তাহলে আমরা সবাই ভেসে যাব মা ?
-না বাবা , এখন সে ভয় নেই। তবে তিতলির সময় হোটেলটির যেহেতু কোনো ক্ষতি হয়নি কাজেই অনুমান করা যায় সে রকম কিছু হবে না ।
সেদিন সন্ধ্যায় সমুদ্র তীরের খোলা বড় ঝুল বারান্দায় বসে দ্বাদশীর চাঁদ আর নিচে উত্তাল সমুদ্রের ফেনিল জলরাশির মুহুর্মুহু গর্জন এর মধ্যে হঠাৎ মনে দুটি প্রশ্ন জাগিয়ে দিল । শ্রদ্ধেয় খায়রুল আহসান স্যার বলে উঠলেন , প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য শুক্লা দ্বাদশীর নয় জ্যোৎস্না রাতে হওয়া সমীচীন ছিল । আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম
- হ্যাঁ স্যার এটা ঠিক করে নিচ্ছি । ওটা জোসনা রাতেই হবে ।
পাশেই দেখলাম আরেকজন শ্রদ্ধেয় চাঁদগাজী সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন । আমি মুখ তুলতেই উনার প্রশ্ন ,
-আচ্ছা ! গোপালপুরের অধিবাসীদের জীবিকা কি ?
-জি স্যার , ওরা সমুদ্রে মাছ ধরে । একটা মরশুমে ট্যুরিজম ওদের জীবিকা আর প্রান্তিক লোকজনের অবশ্য সমুদ্রের ঝিনুক থেকে তৈরি বিভিন্ন সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি ও বেচার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে । এছাড়া ছোট বড় ব্যবসা ও বেলাভূমিতে আছে ।
অসহায়ের মত হাতের এন্ড্রয়েড সেটটি নিয়ে যখন সবে ব্লগে ঢু দিয়েছি অমনি পাশ থেকে বাবাই বলে উঠলো ,
- মা! দেখো দেখো , পাপা ঘুরতে এসেও ব্লগিং করছে ।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফেবুতে গিয়ে দেখালাম যে না আমি ফেসবুকে আছি। পাশে দেখলাম আমার ছোট ভাই রাকু হাসান দাঁড়িয়ে ।
- ভাইয়া পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে এভাবে ব্লগিং করাটা ঠিক নয় ।
আমতা করতে করতে,
-হ্যাঁ না ঠিক না আসলে আমি ঠিক ব্লগিং করছিলাম না ,আমি একটু ফেসবুক দেখছিলাম ।
একে একে রাকুর পাশে প্রিয় কাওসার ভাই, চঞ্চল হরিণী আপু ,আরোগ্য ভাই ,মামুন ভাই ,করুনাধারা আপু সবাই কে দাঁড়াতে দেখলাম । প্রত্যেকের মুখে একই কথা পরিবারের সঙ্গে ব্লগিং করা করা চলবে না । একসঙ্গে এতজনকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে এল । করিডর দিয়ে হাঁটা লাগালাম ডাইনিং রুমের দিকে । কিন্তু ওখানে আবার জুন আপু দাড়িয়ে। ছেলেদের উনি ডাইনিং রুমে ঘোরাঘুরি একদম পছন্দ করেন না । কোনক্রমে পা টিপে টিপে সামান্য জল খেয়ে আবার খোলা বারান্দায় বসতে , সামনে ঢাবিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে ।
-পদাতিক দা, আপনাদের ওখানে সমুদ্র খুব শান্ত । কি সুন্দর শৃঙ্খলিত সমুদ্রের ঢেউ গুলি ছবির আকারে একটার পর একটা আসছে, আর তটভূমিতে মিলিয়ে যাচ্ছে । আর আমাদের এখানে সমুদ্রও বড় উশৃংখল । স্থলভাগে রাজনীতিকরা আর জলভাগে সমুদ্র যেন মিলিতভাবে দেশটাকে শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছে । একে একে ঢাবিয়ান ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে লাগলেন ব্লগার প্রান্ত , লিটন ভাই ,সাদা মনের ভাই যুক্তি না নিলে যুক্তি দাও ভাই ,তারেক ভাই, ফাহিম ভাই , মাহমুদুর রহমান সুজন ভাই ,লতিফ ভাই, শামচুল ভাই , মাশরেকী ভাই, রানা আমান ভাই, আখেনাটেন ভাই, শাহিন ভাই ,ফাহিম ভাই ,বাশার ভাই, ইসমত ভাই , পল্লব দা, ঠাকুর মাহমুদ ভাই, তাজুল ভাই, বাবু ভাই প্রমুখকে । এরমধ্যে আবার কলাবাগান ভাই চিৎকার করে উঠলেন ,
- এসব অপপ্রচার ও কুৎসাতে শাসকদলের কোন ক্ষতি হবে না । আগামী নির্বাচনেও আমরা হাসতে হাসতে ক্ষমতায় আসব ।
এসব রাজনৈতিক যুদ্ধে আমার তখন বেচারার মত অবস্থা । প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম এমন সময় দেখলাম আবার একদল ব্লগার ছুটে আসছেন সমুদ্রের দিকে । ঘাড় উচু করতেই একে একে আমার বোন কথার ফুলঝুরি ,সূর্যালোক ,অচেনারিদি, মৌরি হক দোলা , ওমেরাআপু, সমুদ্র ডি সমুদ্র দয়িতাআপু , সোহানীআপু , প্রভাআপু, মিথিআপু , শিখাআপু ,শায়মাপু, নীলপরীআপু , নাজআপু , টিয়াআপু সবাই ছুটে এসেছেন ....
আমি অবাক হয়ে তাকাতেই একজন বলে উঠলেন ,
- আজ দ্বাদশীর চাঁদেসমুদ্র দেবী আবির্ভূত হবেন । ভ্রমরের ডানা ভাইয়ের কাছ থেকে খবর পেয়ে সবাই এসেছেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে ।
আমিও এমন সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজি নই। তুলে নিলাম ফটাফট কয়েকটি ছবি । কিন্তু পরক্ষনেই মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল । সমুদ্র দেবী দেখা দিয়ে চলে গেলেন অপূর্ব তার বর্ণছটা , কি মায়াবী তার রূপ । মনের মধ্যে তাকে কিছুটা ধারণ করতে পেরেছি কিন্তু ক্যামেরাবন্দি যেটা করেছি সেটা ব্লগে আমার ছোট ভাই রাজীব নূর 'আমার ফটোগ্রাফিতে 'স্থান দেবে বলে মনে হলো না ।
কিছুটা নিরাশ হয়ে একটি কাগজ কলম নিয়ে ভাবলাম শ্রদ্ধেয় সনেট কবি ভাইয়ের জন্য একটি সনেট লিখতে পারি কিনা চেষ্টা করি । ওরে বাবা ! কয়েক ঘণ্টা পার হলেও একটাও শব্দ লিখতে পারলাম না । এমন সময় দূরে হাততালির শব্দে তাকিয়ে দেখি বিদ্রোহী ভৃগু ভাই হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন । পাশে কবি সেলিম আনোয়ার ভাই ,বাকপ্রবাস ভাই ,টুটুল ভাই ,নকীব ভাই, বিজনদা ,প্রামানিক ভাই , নয়ন ভাই, হেনা ভাই, ফেনা ভাই , সোহেল ভাই , পদ্মপুকুর ভাই , কবির ভাই, সেতু ভাই, আরোগ্য ভাই ,স্রঞ্জিসেভাই সহ এক ঝাঁক নবীন প্রবীণ কবি । হাঁটতে হাঁটতে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লেন ।
- স্যার বিশ্বাস করুন , আমি কবিতা লিখি নি । এমনি একটা কাগজ নিয়ে বসে আছি ।
-ঠিক আছে । তোর মুখের কথা বিশ্বাস করলাম । মনে রাখবি ব্লগে কবিতার মান নেমে । কাজেই যা ইচ্ছে তাই লিখে ছাড়বি না । আমরা কবিরা মিলে ঠিক করেছি কবিতার মানোন্নয়নে একটা পরিকাঠামো বেঁধে দেব । তোদের মত মরশুমি কবিদের জন্য আমাদের মতো ধ্রুপদী কবিদের কবিতা পাঠের পাঠক সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে ।
-ওকে স্যার , কথা দিচ্ছি। আর কক্ষনো কবিতা লেখার চেষ্টা করব না ।
উনারা চলে যেতেই আবার সামনে একদল ব্লগার চলে এলেন। আহমেদ জি এস ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন , একে একে জুনায়েদ ভাই সিগনাস ভাই ,সাইনবোর্ড ভাই , নিজাম উদ্দিন মন্ডল ভাই , ঋত আহমেদ ভাই ( সরি ও কার টি আনতে পারছি না ) নূর ভাই ,ঢাকার লোকভাই ,নীলাআকা নজসুভাই, শ্রদ্ধেয় সোনাবীজ ভাই, সামিউল ইসলাম বাবু ভাই , স্বপ্নীল ফিরোজ ভাই , তালগাছ ভাই, চাঙ্কু ভাই , ডক্টর আলী ভাই , তাজুল ভাই, পবন দা, সুমনদা , কে ত ন ভাই, অন্তরন্তর ভাই , রূপক বিধৌত সাধু দা, মামুন ভাই ,হাবিব স্যার , মাইদুল ভাই , সাজ্জাদ ভাই , মাহের ভাই, টারজান ভাই সবার সঙ্গে ।
পুলিশের পোশাকে নীলআকা ভাই এগিয়ে এসে বললেন,
- আমি সেই শুভ দারোগা । শবনম কেস টা আপাতত মিটে গেছে এবার তোকে নিয়ে পড়লাম । ইন্ডিয়ার চ্যানেলগুলি আমাদের দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছে। আর তুই ওখান থেকে অখাদ্য-কুখাদ্য লিখে ব্লগের অবনমন করছিস । আমরা তাই দলবদ্ধভাবে তোকে সতর্ক করে গেলাম । টারজান ভাই আমার হাত ধরে সবে পশ্চাদ্দেশে আঘাত দিতে উদ্যত হতেই নীলাআঁকা অবশ্য থামিয়ে দিলেন ।
-জি স্যার , কাভাভাই তো ব্লগের মডু ।
-হ্যাঁ, উনি ব্লগের মডু ঠিকই । কিন্তু মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য করে আমরা ব্লগকে সচল রাখি ।
-জি স্যার, তাহলে তাই হবে । এখন থেকে আমি আর কোন পোস্ট দেব না । এমনিতেই ' মরীচিকা ' নিয়ে একটু মরীচিকায় আছি । তারপরে আপনার এ সতর্কবার্তা ভালোই হলো।
পাশ ফিরে শুতে হঠাৎ ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম । আসলে টু বেড রুমে তিনজন থাকলে যা হয় । পাশে থাকা বাবাই এর ঘুম ভেঙে গেল।
- মা, পাপা বাউন্ডারি হয়ে গেছে ।
- আহ! ছেলেটা হয়েছে বাপের মতো । ঘুমের মধ্যে খেলা করে ।
- না না মা ! তুমি দেখো ,পাপা সত্যিই বাউন্ডারি হয়ে গেছে।
চোখ ঘষতে ঘষতে শ্রীমতি বলে উঠলেন,
-ওমা ! তুমি নিচে পড়ে গেছ? লাগেনি তো ?
- না না একদম লাগেনি । তবে ঘুম বেটার একটু লেগেছে । আগামী আধঘন্টা ও আর এদিকে আসবে বলে মনে হয় না । মাথার উপর ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম তখন তিনটে বাজে ।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল উড়িষ্যার কাশ্মীর নামে পরিচিত দারিংবাড়ি ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য -১ আনন্দটা বেশিরভাগ ব্লগারদের সঙ্গে শেয়ার করলাম । অনেকেই নাম উল্লেখ করতে ব্যর্থ হলাম । প্লিজ একটু আপনাদের নামটা দিয়ে দেবেন যতটা সম্ভব অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করব । কথাতে কাউকে আঘাত করে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী প্লিজ ক্ষমার দৃষ্টিতে নেবেন
২- মরীচিকা পর্ব 6 এ এই মুহূর্তে কোন কমেন্টের প্রতি মন্তব্য করতে পারছি না । বারে বারে 404 পেজ টি নট ফাউন্ড দেখাচ্ছে । এজন্য যারা ইতিমধ্যে কমেন্ট করেছেন ,উনাদের প্রতিমন্তব্য না দেওয়াতে অত্যন্ত দুঃখিত । যদি সামুর সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ।
ছবিগুলি ওড়িশার রম্ভা থেকে নেওয়া চিলকা লেক এর বিভিন্ন দৃশ্য । একটি ছবিতে আমার পুত্র মেঘ সঙ্গে কলিগ এর পুত্র গুঞ্জন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:১৬